‘দেখুন আজকের রাতের জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত না,আপনি কি আমায় একটু সময় দিবেন?’ সদ্য বিয়ে করা নতুন বউয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাতুল সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেলো। মনের ভেতর স্বশব্দে যেনো কতগুলো তোলপাড় শুরু হয়েছে।একে তো বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন,তার উপর বিয়ের আগে পাত্রীর সাথে কথা বলার ও সুযোগ পান নি।যদিও তিনি বারবার বলছিলেন তার মামা কে,কিছুটা সময় দিতে।কিন্তু মামা এক কথার মানুষ। তার এক কথা,বয়স ত্রিশ পার হয়েছে সেই কবে,আর কয়দিন এভাবে কাটাবি।ভালো ঘরের মেয়ে, যদি হাতছাড়া হয়ে যায়?
রাতুল ঘামছে শুধু।মাথার উপর ফ্যান চলছে তাও যেনো গোসল করিয়ে দিচ্ছে ঘাম।রাতুলের বারবার মনে হচ্ছে, তার বউয়ের কি কোনো এফেয়ার ছিলো? তার লাইফ কি গল্প সিনেমার মত হয়ে যাচ্ছে নাকি।মা বাবা গত হওয়ার পর থেকে রাতুলের দেখাশুনা মামাই করেছে।রাতুল গম্ভীর টাইপের হলেও বাস্তবতা বুঝে।ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা বউয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে বারান্দায় চলে গেলো সে।মামাকে কল দিয়ে বলতে মামা খেঁকিয়ে উঠলেন। রাতুল হতাশ হয়ে রুমে এসে গম্ভীর ভাব নিয়ে বললো,তোমার কি কোনো সমস্যা আছে আজ?
“না তেমন কোনো সমস্যা না।
” তাহলে?
নীরা ঘোমটা তুলে বসলো।সাবলীল ভাবে একে একে সেফটিপিন গুলো খুলতে লাগলো শাড়ির।রাতুল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর লাগছে কেন নীরা কে আজ? যেদিন দেখতে গেছিলো তার থেকেও সুন্দর। মেকাপের কারণে হয়তো।
“এদিকে আসুন না একটু।
” হ্যাঁ?
“এদিকে আসতে বললাম।আমাকে একটু হেল্প করুন। রাতুল অবাক হয়ে এগিয়ে যেতেই নীরা রাতুলের সামনে এসে বসলো।
” এই যে মাথায় এতগুলো ক্লিপ করা,এগুলো সব এক এক করে খুলুন তো।
“আমি?
” হ্যাঁ হ্যাঁ পারবেন।তাড়াতাড়ি করুন,গোসল করবো আবার আমি।
রাতুল বোকার মত বসে বসে নীরার ক্লিপ খুলছে আর হাতে দিচ্ছে।নীরা সেগুলো এক এক করে গুনে গুনে রাখছে।
“চব্বিশ টা হলো। এবার হাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে করে চুলের জট গুলো খুলুন তো।আমার চুলের বারোটা বাজিয়ে দিলো এরা।বিয়ে বলেই কি এত সাজা লাগবে নাকি।নীরা আপনমনে বকছে,রাতুল চুল খুলছে আর হতভম্বের মত শুনছে।একটু আগের বলা কথাটার সাথে এই বলা কথাগুলো মিল নেই।রাতুলের মাথায় এখনো আগের কথাটাই ঘুরছে।
নীরা উঠে টাওয়াল নিতে নিতে বললো, রাতুল সাহেব, শুনুন আমি কিন্তু মোটেই এত সুন্দরী না।এই যে গোসল করে আসবো এখন,তখন চিনতেই পারবেন না আর।প্লিজ তখন আবার রুম থেকে দৌড়ে পালাবেন না যেনো। হু?
রাতুল ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলো। নতুন আরেকটা চিন্তা যোগ হয়েছে,নীরার ফ্যামিলি কি তবে ঠকিয়েছে? আগে একবার দেখেছে তখন ও তাহলে পার্লার থেকে সাজিয়েছিলো। রাতুল আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো, না জানি অর্জিনাল নীরা দেখতে কেমন।কালো হোক সুন্দর হোক তাতে সমস্যা নেই,শুধু দেখতে মায়া হলেই হবে।
একটু পর নীরা বেরিয়ে আসলো একটা সুতি শাড়ি পড়ে। একদম তরতাজা ফুলের মত লাগছে তাকে।রাতুল এর মনের সব ভয় হাওয়ার মত মিলিয়ে গেলো। মেয়েটা আদতেই সুন্দর। মায়াময় সুন্দর। এর সাথে সাদা কালোর প্রভেদ চলেনা।সুন্দর মানে সে রংবিহীন সুন্দর। আচ্ছা বলো নি তো তোমার কি সমস্যা?
” আমি প্রেগন্যান্ট।
“হোয়াট?
” এটা ভাবেন নি?
“মানে।এটা কেন ভাববো।
” ওহ হ্যাঁ। আপনি ভাবছেন আমার কোনো রিলেশন চলছে?
“হ্যাঁ। রাতুল সহজ স্বীকারোক্তি দিলো।
” আপনি ভুল।চিন্তাভাবনা এমন লেইম হলে হবে? এর পরে বলেন।
“তাহলে কি তোমার আমাকে পছন্দ না?
” আপনার কি মনে হয় আপনাকে অপছন্দের কারণ আছে?
“আছে বৈকি।
” এডুকেটেড,ভালো জব, একটা সুন্দর বাড়ি,দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ, ভদ্র এসব তো মায়ের মুখে শুনে শুনে মুখস্ত আর কিছু?
“আমার বয়স! তুমি কি জানো আমাদের বয়সের তফাৎ?
” মাত্র ৯বছর।রাইট?
“হুম
” আপনি জানেন, আমার সবচেয়ে সুন্দরী ফ্রেন্ডের হাজব্যান্ড মিনিমাম চল্লিশ পার করেছে।মাথার অর্ধেক চুল মিলিয়ে গেছে।দেখি আপনার আছে কিনা। নীরার হাতের মুঠোয় রাতুলের চুল।রাতুল হতবাক হয়ে যাচ্ছে নীরার কান্ড দেখে।মামা কি ইচ্ছে করেই তাকে নাজেহাল করার জন্য এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করিয়েছে?
“না চুল ঠিক আছে।তাহলে বলুন,সে হিসেবে আমি লাকি।আপনি মাত্র ত্রিশ পার করেছেন। এ আর এমন কি?
” তাহলে সমস্যা টা কি নীরা? রাতুলের অসহায় মুখ দেখে নীরা হেসে পাশে বসলো।
“সমস্যা টা হলো প্রেম..
” আবার প্রেম,বললে যে রিলেশন নেই।
“প্রেম।মানে আমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা টা।এখনো কি আমাদের মাঝে কোনো প্রকার টান,মায়া, বা প্রেম জাতীয় কিছু এসেছে? এসব কিছু ছাড়াই আমি আমাকে কি করে আপনার হাতে তুলে দিই?শুধুমাত্র মোহের বশে? নাকি শারীরিক আবেদনে?
রাতুল তাকিয়ে রইলো নীরার দিকে।সত্যি ই তো,তাদের মাঝে তো প্রেম নেই।মায়াটা তো সময়ের ব্যাপার।নীরাকে তার ভালো লেগেছে দেখেই।সেটা মোহ ধরা যায়।কিন্তু ভালোবাসা টা তো সময়ের সাথে সাথেই প্রকাশ পায়।সেই সময়টুকুন কত সময় তা সে জানেনা।আবার সে যেভাবে ভালোবাসবে নীরা কি সেভাবে বেসে উঠতে পারবে কিনা এই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।শরীর দিয়েই একটা ভালোবাসার স্বপ্ন শুরু করতে হবে এটা ভাবতেই ভয় লাগলো রাতুলের। শরীর দিয়েই কেন শুরু হবে? প্রেম দিয়েই শুরু হোক স”দেখুন রাতুল সাহেব,আপনাকে দেখে যে কারো তাক লেগে যাবে।ট্রাস্ট মি।প্রথম যেদিন আমাকে দেখতে গেছিলেন মামার সাথে,আড়ালে দেখে আমার ও লেগেছিলো। আপনাকে বিয়ে করার জন্য যে কারোর ই মন আনচান করবে। আমার ও করেছে।শুধুমাত্র আপনাকে দেখেই।তাহলে ভাবুন,আপনার কাছে আসার জন্য আমার কেমন উদগ্রীবতা? তবু সময় চাইছি,কারণ আমি আমাদের সুন্দর সম্পর্ক টা ধীরেসুস্থে সাজাতে চাই। একদম নিশ্চিন্ত হয়ে বুঝলেন।
” নিশ্চিন্ত বলতে?
“ধরুন আপনার সাথে আমার প্রেম থাকলে একটা চিন্তা হতো বিয়ে হবে কি হবেনা।স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে কিনা।কিন্তু আমাদের তো তা ছিলো না।সোজা বিয়েটাই হয়ে গেলো। ব্যাস একদম নিশ্চিন্ত আমি।এবার নিজের জিনিস যেমন খুশি ইউজ করবো।সুন্দর না? নীরার মুখে এমন ভাবে কথাগুলো বের হচ্ছে, রাতুল হা করে শুনছে আর হাসছে।
” হুম খুব বেশি সুন্দর। যতটা ভয় পাচ্ছিলাম তার থেকেও বেশি।
“কি?
” তুমি।যাক আমি স্যরি।এই কথাগুলো আমার বলা উচিত ছিলো আসলে।কি অদ্ভুত তাইনা,মন ছোঁয়ার আগেই আমরা শরীরে ডুবে বসে থাকি।এই সময় টুকুন আমার ই দেয়া উচিত ছিলো তোমাকে।একটা অচেনা অজানা মেয়ের ভেতরকার রহস্য উদঘাটন করার আগেই আমরা তার গায়ের গন্ধ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
“ভয় পেয়ে গেছিলেন তাইনা প্রথমে?
“ভীষণ। আমার সাদাসিধে জীবন নীরা।একা একা মানুষ। ক্যারিয়ার নিয়ে এত সিরিয়াস ছিলাম যে আর কিছুই গা ঘেষে নি। দাম্পত্য বা সংসার কেমন হয় আমি জানিনা।মা বাবা ছিলেন না তো।ভয়ে ছিলাম কে আসবে জীবনে,কেমন হবে।এই ভয়েই বয়স পেরিয়ে গেলো। এট লাস্ট মামা হুট করেই এসব করে বসলেন।রাগ হয়েছিলো তার উপর প্রচুর।
“এখনো মামার উপর তাহলে ক্ষেপে আছেন।
” নাহ।তা নয়।একটু আগে অব্দি ছিলাম।মনে হয়েছিলো মামা আমাকে জব্দ করার জন্য তোমাকে জুটিয়েছে।
“কিহহ?
” না,মানে এখন ঠিকঠাক সব।
“সিওর?
” হুম।
সব মেঘ কেটে গেছে।এবার একটা স্বচ্ছ আকাশখোলার দিন আসবে।সেই দিনে আমাদের ভালোলাগা,ভালোবাসার এক এক সূত্র তৈরি হবে।তারপর হুট করেই আমি তোমার মায়ায় বাধা পড়ে যাবো,তুমি টের ও পাবেনা। নীরা রাতুলের হাত টা শক্ত করে ধরলো। এই হাত ভরসায় ধরা,নিজস্ব অধিকারের ধরা,নতুন একটা শুরুর জন্য ধরা।