অস্তিত্ব

অস্তিত্ব

বাসর ঘরে সব সময় বউ আগে বসে থাকে । তারপর বর আসে এটাই নিয়ম। কিন্তু আমার বেলায় হয়েছে উল্টা । আমি যখন বাসর ঘরে ঢুকলাম তখন দেখি আমার স্বামী আগের থেকে বসে আছেন । কথা টা শুনে আপনাদের অনেক অবাক লাগছে তাই না। ঠিক এর থেকে বেশি অবাক আমি হয়েছিলাম সেদিন যেদিন জানতে পারলাম আমাকে একটা দৃষ্টিহীন লোকের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে । কেন হচ্ছে আমার সাথে এমন বলার সাহস কখনও হয়নি। সৎমায়ের চোখের দিকে তাকাতে যে মেয়ে থরথর করে কাঁপে সে কিভাবে করবে প্রতিবাদ। জমিদার বাড়ি । নতুন বউ দেখতে লোকজন গিজগিজ করছে । আমি পুতুলের মতো গহনা পরে বসে আছি। আমার থেকে গহনার ওজন বেশি । এটা আমার কম কিসের । আর এমন ভাগ্য কয়টা মেয়ের থাকে । বিয়ের শাড়িটা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে । কি ভারী এটা ।

এই তো সেদিনের কথা । আমার গায়ের জামাটা বসে বসে সেলাই করছি। সৎ বোনের গায়ে নতুন জামা দেখে মায়ের কাছে আব্দার করেছিলাম আমাকে একটা এরকম জামা কিনে দিতে । সৎমা সেদিন আমাকে এমন কিছু কথা বলেছিল যে সারা রাত কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ছিলাম । তাঁর মধ্যে সব থেকে ভাল কথাটা ছিল ,” যা যা পতিতালয়ে যা। দেহ বেঁচে রঙের রঙের জামা কাপড় কিনে শখ পূরণ কর। কেউ কেউ আমাকে দেখে ফিসফিস করে বলছে ,” আহারে এতো সুন্দর একটা মাইয়া ওমন অন্ধ পোলার লগে বিয়া দিল। কথা গুলি অবশ্য আমার এখন সয়ে গেছে । মনে মনে হিসেব মিলাতে থাকলাম একজন অন্ধ লোকের সাথে আমার উঠাবসা কিভাবে হবে ।

সবাই খুশি এই বিয়েতে । আমি আমার সৎমা শ্বশুর বাড়ির লোকজন । আমি খুশি কারণ পেট পুরে তিন বেলা খেতে তো পারবো। নিজের পছন্দ মতো গহনা শাড়ি কাপড় পরে ঘুরে বেরাবো । বসে বসে আর রাতের আধারে ছেঁড়া জামা সেলাই করতে বসতে হবে না আর সৎমা খুশি মোটা অঙ্কের টাকা আর একটা বাড়ি পেয়ে । অন্য মেয়ে গুলির এবার ভাল জায়গায় বিয়ে দিতে পারবেন । শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুশি কারণ তাদের একমাত্র অন্ধ ছেলের একটা গতি তো হলো। সবাই খুব খুশি। আচ্ছা তাহলে আমার বাবা কেন নিরবে নিরবে চোখের পানি ফেলছে ? বাবার ও খুশি হওয়ার কথা । তাঁর মেয়ে জমিদার বাড়ির বউ। বিয়ের আগের দিন রাতে বাবা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলেছিল ,” মারে আমাকে পারলে মাফ করে দিস। এই পঙ্গু বাবা টাকে মাফ করে দিস। বাবার এই কান্না দেখে আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এক ফোঁটা চোখে পানি আসেনি। আচ্ছা আমার চোখের পানি কি শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে ???

আমাকে বাসর ঘরে নেওয়া হলো। ঘরে ঢুকে ঘাবড়ে গেলাম । ভুলে কোনও রাজার ঘরে ঢুকালো নাতো। ছোট বেলায় মায়ের মুখে রুপকথার গল্প শুনেছিলাম । আমার মা চুল বেঁধে দিত আর গল্প বলতে বলতে আমাকে বলতো ,” আমার মায়াবতীর ও এমন সুন্দর ঘরে বিয়ে হবে। রাজ কুমার আসবে ঘোড়ার চড়ে । মায়ের কথা শুনে আমি খিলখিল করে হেসে উঠতাম । মায়ের কথা সত্যই হয়েছে । জমিদার বাড়ির বউ আমি । আমাকে আমার স্বামীর পাশে বসানো হলো। এখনও তাকে দেখিনি। সবাই চলে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় একজন খোঁচা দিয়ে হাসতে হাসতে বললো ,” যাইগো ভাবি। অনেক রাত হইছে ।

সবাই চলে যেতে আমি আমার বরের দিকে তাকালাম । খুব শান্ত একজন মানুষ । চেহারার একটা জমিদারি স্পট ফুটে আছে । দেখলে মনে হচ্ছে প্রতিটা কথা বলে মেপে মেপে। গাম্ভীর্য সারা চোখে মুখে । আমি আমার হাত বাড়িয়ে তাঁর পায়ে সালাম করলাম । তিনি বুঝতে পেরে ভারি কন্ঠে বললেন ,” আপনি আমার মাথার মুকুট । পা ধরে নিজেকে ছোট করবেন না। তাঁর কথা শুনে কেমন যেন শান্তিতে মনটা ভরে গেল । তারপর আবার বললেন , ” দেখুন সব সময় মনে রাখবেন আপনি আমার সহধর্মিণী । এই বাড়ির একজন সদস্য ।

আপনি কেমন দেখতে আমি জানিনা। কোনও দিন দেখতে পাবো কিনা তাও জানি না। আপনি এটা জেনেও এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন আমি খুবই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি চুপচাপ তাঁর কথা গুলি শুনে যাচ্ছি । এমন সময় হাত বাড়িয়ে কিছু খুঁজতে লাগলেন । তাই দেখে বললাম ,” আপনার কিছু লাগবে ? কয়েকটা ঢোক গিলে বললো ,” একটু পানি খাব। দিতে পারেন ? পাশে থাকা পানি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলাম । ঢকঢক করে পানি টুকু খেয়ে আমাকে বললো ,” আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন অনেক রাত হয়েছে । এমন সময় একটা চিৎকার কানে ভেসে এলো কেউ কাঁদছে আর বলছে ,” আমাকে ছাড় আমি বাবার কাছে যাব। আচমকা এমন চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গেলাম । ওদিকে চিৎকার করেই যাচ্ছে । আমি বাবার কাছে ঘুমাবো আমাকে যেতে দাও।

আমার স্বামী দুই হাত বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন । হাতড়ে হাতড়ে দরজার কাছে চলে গেলেন । আমি হা করে তাকিয়ে আছি। দরজা খুলতেই একটা ফুটফুটে মেয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো ,” বাবা বাবা , তোমাকে ছাড়া আমার একদম ঘুম আসেনা। আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল। এটা তাঁর সন্তান । তিনি শুধু অন্ধ নন। বিবাহিত ও বটে । এটা ছিল আমার জীবনের আরেক টা ধাক্কা । ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে । এটা কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নাকি কোনও পাপের ফল।

মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো আমার একমাত্র মেয়ে পরী। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে হলো সত্যই কোনও পরী । পরী আমাকে দেখে গাল ফুলিয়ে রাগ করে বললো ,” এই তুমি আমার আম্মুর ঘরে কি করছো ? আমি অবাক হয়ে গেলাম মেয়েটার কথা শুনে। পরীর বাবা পরীকে বললো ,” মামনি তোমাকে বলেছিলাম না তোমার আম্মু ওইযে আকাশের তারা হয়ে আছে একদিন তোমার কাছে ফিরে আসবে দেখ আজ সত্যই এসেছে। পরী আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললো সত্যই তুমি আমার আম্মু ? সেদিন পরীর কথাটা শুনে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলাম । একটা মা মা বোধ নিজের ভিতরে চলে এলো। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বললাম , ” হুমমম মামনি আমি তোমার আম্মু ।

পরী আমার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে গেল । পরীর বাবা বললো ,” সত্যি আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব। ওকে কতো সহজে আপন করে নিলেন । আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে । সেটা লুকিয়ে হাসি মুখে বললাম  পরীতো আমার ও মেয়ে । পরীর বাবার মুখটা খুশিতে ভরে গেল । রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে । আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুরের ওই চাঁদ দেখছি। পরী ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে । মায়ের মুখটা আজ বড্ড মনে পড়ছে । আচ্ছা মা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে ? তাহলে মাকে জিজ্ঞাসা করতাম ” আচ্ছা মা তুমি তো কখনও এটা বলোনি রাজার রাজ্য সহ একটা ফুটফুটে রাজকন্যা ও আমি পাব।

একটু পর সকাল হবে । আমার অনেক কাজ । আমি এখন নতুন বউ না। একজন মা একজন সহধর্মিণী । যার উপরে নির্ভর করে কয়েকটা মানুষের সব কিছু । পরীকে ডেকে তুলতে হবে । তৈরি করে পাঠাতে হবে স্কুল এ। পরীর বাবার চোখের দৃষ্টি এখন আমি । আমার উপরে এখন সে ভরসা করতে শুরু করেছে । জীবনে আর কিছু চাইনা।
একেক করে গহনা খুলে রাখলাম । নতুন ভারি শাড়ি খুলে একটা সুতি শাড়ি জড়িয়ে নিলাম । আস্তে আস্তে চলে গেলাম রান্না ঘরের দিকে । আমার যে অনেক কাজ বাকি অনেক কাজ ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত