অন্তর্দহন

অন্তর্দহন

– খুব ডিপ্রেসড্ আছি, একটু সময় দেয়া যাবে?

ডিমভাজি টা মাত্র কড়াই থেকে নামিয়েছি, এর মধ্যেই ম্যাসেঞ্জারে টুং করে আওয়াজ হল। মেসেজ সীন করেও ডাইনিং টেবিলের উপর ফোন টা রেখে দিলাম। আগে আমার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বড় দেখতে বাচ্চা বোনটা কে ডিমভাজি দিয়ে ভাত খাইয়ে দিতে হবে। তারপর অন্য কাজ। ব্যাচ পড়ানো শেষ করে আজ আমার বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। তাই তিনি অভিমান করে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমাকে ছাড়া বোকা মেয়েটা রাতের খাবারটা খেতেই চায় না।

সারাদিন আমাকে কাছে পায় না তাই রাতে অন্তত একসাথে খাওয়ার বায়না ধরে সবসময়। বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে আম্মু কে বললাম খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে যেতে। আমি মেহের কে নিয়ে একসাথে খাবো। শাওয়ার নেয়ার পর ভাত খেতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই এক মগ কফি বানিয়ে কোচিংয়ের পরীক্ষার খাতাগুলো নিয়ে বসেছিলাম। কাল পরশুর মধ্যে জমা দিতে হবে। খাতা দেখতে দেখতে ১২ টা বেজে গিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরে গিয়ে মেহেরের প্রিয় ডিমভাজি করলাম। তারপর ডিমভাজি আর এক প্লেট ভাত নিয়ে মহারাণী কে অনেক ডাকাডাকির পর ঘুম থেকে তুলতে সক্ষম হয়েছি। ডিমভাজির ঘ্রাণ পেয়েই মেহেরের ঘুম উধাও হয়ে গেল। একবার ডিমভাজির দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে সে। ওর হাসি দেখে দিলাম এক ঝাড়ি,

– মজা না খুব? না খেয়ে শুয়ে পড়েছিলি কেন? মেহের অভিমানী সুরে বললো,
– তুমি তাহলে এত লেট করেছো কেন? আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওকে খাইয়ে দিতে শুরু করলাম।
– তুমি খাচ্ছো না কেন?
– খাবো। আগে তোকে খাইয়ে নিই। সকালে স্কুল আছে না?
– একসাথে খাও। একবার তুমি, একবার আমি। হুম?
– উফ, মেহের, তুই না বড্ড জ্বালাস।
– জানি তো।

খাওয়া শেষ করে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখ লেগে গিয়েছিলো আমার। হঠাৎ আবারো মেসেঞ্জারে টুং করে আওয়াজ হতেই ঘুমের রেশ কেটে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম সেই একই মানুষের মেসেজ,

– আপনি কি ব্যস্ত? দিন না একটু সময়! প্রথমে খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে ঠিকই রিপ্লাই দিলাম,
– বলুন, সময় দিচ্ছি।

খেয়াল করে দেখলাম, এই পাবলিক আমার ফ্রেন্ডলিস্টের পুরাতন বাসিন্দা। কিন্তু এতদিনে তার সাথে আমার ইনবক্সে কোনো চ্যাট হয় নি। অবাক হলাম না আমি। কারণ মানুষ ডিপ্রেশনে থাকলে অচেনা নতুন মানুষদের সংগ উপভোগ করে, তার সাথে সব কিছু বলে নিজেকে হালকা করতে চায়। পরক্ষণেই আবার মেসেজ আসলো,

– ভয়েস কলে কথা বলা যাবে?

আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি উত্তর দিবো। রাত বাজে ১.১৫। এত রাতে অপরিচিত কারো সাথে সাধারণত আমি ভয়েস কলে যাই না। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমি “না” করতে পারি নি। ভদ্রলোক আমার অনুমতি পেয়ে মেসেঞ্জারে কল দিলেন,

– হ্যালো।
– আপনি কি নিয়ে ডিপ্রেসড?
– সবকিছু নিয়ে। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।
– আমার সাথে কেন কথা বলতে চাইছেন? কিছু শেয়ার করতে চান আমার সাথে?
– হ্যাঁ। বলতে চাই। আপনার সাথে কথা বলতে চাইছি কারণ আপনি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত কেউ না। আপনার সময় হবে শোনার?
– আপনি আপনার কথা বলুন। আমার সময় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
– তিন বছর হল আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।

কিন্তু এখনো কোনো চাকরী যোগাঢ় করতে পারি নি। অসুস্থ বাবা এখনো হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছে। অথচ আমি ছেলে হয়ে কিছুই করতে পারছি না। যে বয়সে বাবার ঢাল হওয়ার কথা ছিল, সেই বয়সে আমি নিজেই বাবার রোজগারে বসে বসে খাচ্ছি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক দম নিলেন,

– এই হচ্ছে আমার অবস্থা। জানেন আজকাল আমি নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। নিজেকে এত ক্ষুদ্র আর নগণ্য মনে হয়!
– ডিমভাজি পছন্দ করেন? শান্তনার বদলে এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক যথেষ্ট চমকে গেলেন,
– স্যরি?
– বলছি যে, ডিমভাজি পছন্দ করেন?
– না। কেন?
– আপনি যখন প্রথমবার নক দিয়েছিলেন তখন আমি আমার ছোটবোনের জন্যে ডিমভাজি করছিলাম।

তারপর ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দেরী হয়ে গেল। আমার পড়াশুনা এখনো শেষ হয় নি। মাত্র থার্ড ইয়ারে এখন। একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিই, দুটো টিউশনি করি আর একটা ব্যাচ পড়াই। আমার বাবা নেই। মা আর ছোট বোনের দায়িত্ব আমার উপর। তার সাথে নিজের পড়াশুনার খরচ তো আছেই। বাবা মারা যাওয়ার পর হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এই দিশেহারা অবস্থা টা মা আর ছোট বোন কে একটুও বুঝতে দিই নি। ধৈর্য্য ধরে উদ্দেশ্য স্থির রেখে সামনে এগিয়ে চলেছি। আল্লাহ্ আমাকে হতাশ করেন নি। সকাল ৭ টায় বের হয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৮/৯ টা বেজে যায়। বাসায় এসে যখন মা আর ছোট বোনের হাসিমাখা মুখ দেখি তখন সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়।

– আপনার কষ্ট হয় না?
– কষ্ট তো হয় না, তবে পরিশ্রম হয় অনেক। মাঝে মাঝে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে রাস্তাঘাটে যখন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিগুলো সামলে নিতে হয় তখন শুধু কষ্ট হয়।
– আপনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন খুব।
– জীবন টা গোছাতে গোছাতে কথাগুলোও গুছিয়ে উঠেছে।

এভাবে আমাদের প্রায় অনেকক্ষণ কথা হয়। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ধ্রুব’র বেকারত্বটাই তার ডিপ্রেশনের আসল কারণ। কিন্তু কথা বলতে বলতে বুঝতে পারলাম তিনি যেটা কে ডিপ্রেশন বলছেন, সেটা আসলে ডিপ্রেশন না, সাময়িক অস্থিরতা মাত্র। কারণ কথা বলার শুরু তে তিনি যতটা মিইয়ে ছিলেন, ধীরে ধীরে তা অনেকটা কেটে যায়। ডিপ্রেশন এত সহজে কেটে যায় না। সাময়িক অস্থিরতা বলেই মাত্র ঘন্টাখানেক লেগেছে তার সতেজতা ফিরে আসতে। সত্যিকার অর্থে ধ্রুব’র দরকার ছিল একজন সাময়িক কথাবন্ধু। সেদিনের পর ধ্রুব’র সাথে আমার আর কথা হয় নি। সেও নক দেয় নি। আমিও ব্যস্ততার কারণে খোঁজ নিতে পারি নি। একদিন কোচিং এ ক্লাস নেয়া শেষ করে করিডোর পার হতেই মঈন ভাইয়্যার সাথে দেখা হল,

– আরে মায়া, তোমাকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না। ক্লাস শেষ করেই দৌঁড় দাও।
– এখান থেকে আবার ব্যাচ পড়াতে যেতে হয় ভাইয়্যা। তাই দৌঁড়ের উপরেই থাকতে হয়।
– ওহ্। কিন্তু আমি তো ভাবছিলাম অন্য কথা।
– কি কথা ভাইয়্যা?
– ক্লাস টেন এর কেমিস্ট্রি ক্লাস টা এখন থেকে তোমাকে নিতে হবে। যে মেয়েটা কে রেখেছিলাম সে এখন আর সময় দিতে পারছে না। তাছাড়া তাকে আমরা সন্তুষ্টও করতে পারছি না। কিন্তু তুমি পড়ালে তোমাকে ন্যায্য সম্মানীই দেয়া হবে। তোমার টিচিং স্কিল মারাত্মক।

– বুঝতে পারছি। কিন্তু মঈন ভাইয়্যা, আমার তো সময়ই হয়ে উঠে না। এমনিতেই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৮/৯ টা বেজে যায়। আম্মু খুব বকাবকি করেন। তার উপর আবার…
– কিন্তু আমরাও তো নিরুপায়। ওদের এক্সামের আর কতদিন ই বা আছে বলো। প্লিজ তুমি না করো না মায়া।
– আচ্ছা, আমি দেখছি কি করা যায়।

বাসায় ফেরার সময় রিক্সাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে খানিকটা বাকবিতণ্ডা হয়। উঠার সময় বলেছে ৩০ টাকা, আর নামার পর বলছিলো ৪০ টাকা। আজ পা ব্যথা করছিলো খুব তাই বাধ্য হয়ে রিক্সায় আসতে হয়েছে। আমি খুব সহজে রিক্সায় উঠতে চাই না। স্বল্প উপার্জন তাই হিসেব করে চলতে হয়। অবশেষে তর্ক করে ৩৫ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। তারপরও তো আমার ৫ টাকা জলে গেল। এই নিয়ে মেজাজ টা ধরে ছিল। বাসায় এসে দেখি মেহের আয়নার সামনে নিজেকে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে। ওর এইসব রংঢং দেখে মেজাজ টা আরো বিগড়ে গেল।

– এই মেহের, আয়নার সামনে এতক্ষণ ধরে কি করছিস? পড়াশুনো নেই?

আমার ধমক খেয়ে মেহের চুপসে গেল। আর আমি শাওয়ার নিতে চলে গেলাম। ভাত খাওয়ার সময় মেহের তার কানের দুল ইশারা করে খুব কৌতুহল নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– মায়াবিনী দেখো, দুল টা সুন্দর না?
– হুম।

আমি এক পলক দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। মেহের ছোটবেলা থেকে আহ্লাদ করে আমাকে মায়াবিনী ডাকে। আজ অব্দি কখনো “আপু” ডাকে নি। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি, এক্সট্রা ক্লাস কিভাবে নিবো! আমার পক্ষে তো আর ১ ঘন্টা সময়ও বের করা সম্ভব না। কোনো একটা টিউশনি যে ছেড়ে দিবো তারও কোনো উপায় নেই। এদিকে মঈন ভাইয়্যা তো নাছোড়বান্দা। বলেছে যখন করতেই হবে নয়তো অন্য কাউকে ম্যানেজ করে দিতে হবে। ধুর বাবা, ভাল লাগছে না আর। এর মধ্যে মেহের আমার পাশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। আমাকে জেগে থাকতে দেখে পটরপটর শুরু করে দিলো,

– মায়াবিনী জানো, আজ যখন নিজাম স্যারের কাছে পড়তে যাই…
– মেহের ঘুমা না এখন, সকালে স্কুল আছে না? তুইও ঘুমা, আমাকেও ঘুমোতে দে। সাথে সাথে মেহের ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো।

সারাদিন বাইরে থাকার পর বাসায় এসে বাড়তি কোনো কথা বলতে একদম ইচ্ছে করে না আমার। আগে আমি আম্মু আর মেহের কে যতটুকু সম্ভব সময় দিতাম। ছুটির দিনগুলো তে আশেপাশে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতাম। ঘুরতে যাওয়ার টাকা না থাকলে মেহের কে নিয়ে ফুচকা খেতে চলে যেতাম। মেহের খুব খুশি হত। আমার এই ছোট বোন টা একটা জলজ্যান্ত পুতুল। বিশেষ করে ওর চোখজোড়ায় দুনিয়ার সব মায়া জড়ো হয়ে আছে। আমি তো প্রায়ই বলি, মায়া নাম টা মেহের এর জন্য ঠিক ছিল। আমার জন্য নয়। অল্পতেই পুতুল টা খুব খুশি হয়ে যায়। ওকে খুশি করার জন্য আহামরি কিছু করতে হয় না।

আমার হাতের ডিমভাজি ওর খুব পছন্দ। অথচ আমার করা ডিমভাজি তে আলাদা কোনো বিশেষত্ব থাকে না কখনো। কিন্তু এখন আর আগের মত সময় দিতে পারি না ওদের। আজকাল সপ্তাহে তিনদিন হিসেব মিলাতে গিয়ে শুক্রবারও ব্যাচ পড়াতে হয়। নিজের পড়াশুনার প্রেশারও নেহায়েত কম নয়। ব্যস্ততার কারণে মেহেরের পড়াশুনার খোঁজ খবর নিতে পারি না বলে ওকে স্কুলের টিচার নিজাম স্যারের ব্যাচে দিয়ে দিয়েছি। এত ব্যস্ত থাকতে থাকতে মেজাজও কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছে। তবে এই মেজাজ বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে না। বাইরের মানুষের সাথে আমি যথেষ্ট সাবলীল এবং সহজ সরল আচরণ করি। তাদের সাথে কথা বলার সময় আমার ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে থাকে সবসময়।

আমার সব রুক্ষতা কেবল আমার আপনজনদের জন্যে। আর আমার আপনজন বলতে আম্মু আর মেহের। আম্মুর সাথে তো তেমনভাবে কথা বলতে পারি না তাই সব ঝড় যায় মেহেরের উপর দিয়ে। আমার আশেপাশে আমি কোনো নেগেটিভ ভাইবস রাখি না। বন্ধুমহলে যদি কারো কাউন্সিলিংয়ের দরকার হয়, ছুটে আসে আমার কাছে। আমার সাথে ১০ মিনিট কথা বললে নাকি তাদের সব অস্থিরতা, বিষণ্ণতা কেটে যায়। অথচ আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলি। জীবনটা কে আমি খুব সহজভাবে দেখতে চেষ্টা করি। হতাশা আর আবেগ এই দুটো জিনিস আমাকে খুব সহজে কাবু করতে পারে না। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম দিনগুলোও আমি অনায়াসে হেসে হেসে পার করে দিয়েছি।

পরেরদিন বিকেলবেলা মঈন ভাইয়্যা কল দিলেন। আবারো সেই একই আবদার। তখনো আমি বললাম, “পরে জানাচ্ছি”। মঈন ভাইয়্যার সাথে কথা শেষ করে ফোন রাখার পর আমি চ্যাটলিস্ট ঘাঁটতে শুরু করলাম। অনেকেই মাঝে মাঝে আমাকে টিউশনি ম্যানেজ করে দিতে বলে। ভাবলাম, ওখান থেকে যদি কাউকে পাওয়া যায়। তেমন বিশ্বস্ত কাউকে পেলাম না তবে ধ্রুব’র নাম টা চ্যাটলিস্টে থাকায়, একবার মনে হল উনাকে একবার বলে দেখা যায়। তারপর মেসেঞ্জার থেকে উনার সেল নাম্বার নিয়ে কন্টাক্ট করলাম। ভদ্রলোক প্রথমে বলছিলেন,

– কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে কি আমার পোষাবে? আমি আশ্বস্ত করলাম এই বলে,

– দেখুন আপনি তো এখন পুরোপুরিভাবে বেকার হয়ে আছেন। একেবারে কিছু না করার চেয়ে কিছু একটা তে লেগে থাকা সম্মানজনক। তাছাড়া আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সায়েন্স। সিজিপিএ এত ভাল, ফার্মাসী ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করেছেন। আপনার মত মানুষের এভাবে বেকার বসে থাকা মানায়?

– ঠিক আছে। আমি করবো।

মঈন ভাইয়্যার সাথে ধ্রুব কে কথা বলিয়ে দিলাম। দু’একটা ক্লাস নেয়ার পর স্টুডেন্টদের রেসপন্স দেখে মঈন ভাইয়্যা ধ্রুব’র উপর খুব সন্তুষ্ট হন। এর মধ্যে ধ্রুব’র সাথে মঈন ভাইয়্যার বেশ খাতির জমে যায়। একই কোচিংয়ে ক্লাস নেয়ার সুবাদে ধ্রুব’র সাথে প্রায়ই আমার দেখা হত। আর মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত। এভাবে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়তে থাকে, সাথে ঘনিষ্ঠতাও। মানুষ হিসেবে ধ্রুব ছিল খুব সৎ যার কারণে তার চাকরী পেতে অসুবিধে হচ্ছিলো। পুরুষ মানুষের অল্পতেই ভেঙে পড়তে হয় না, কিন্তু ধ্রুব ছিল সেই কাতারের পুরুষ যে কিনা আকাশে মেঘ দেখলেই ঘরে দরজা বন্ধ করে মাথার উপর ছাতা মেলে ধরে বসে থাকে। তবে আমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে সে নিজেকে অনেকটা শুধরে নিতে শুরু করে। আমার মানসিক শক্তি আর ধৈর্য্য দেখে সে নাকি নিজের কাছে ছোট হয়ে যায়। একদিন শরীর খারাপ লাগছিলো খুব। রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম। সেদিন ভার্সিটির ক্লাস শেষ করেই বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে কোনোরকমে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। আম্মু রান্নাঘর থেকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আমার ঘরে আসলেন,

– কি রে আজ এত তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে? শরীর খারাপ নাকি?
– হ্যাঁ আম্মু। শরীর টা দূর্বল লাগছে খুব।
– লাগবে না! সারাদিন যা খাটা খাটনী যায়। এক গ্লাস দুধ গরম করে দিই?
– না, লাগবে না। আমি এমনিই ঠিক হয়ে যাব। দুধ টা মেহেরের জন্যে রেখে দাও। ও স্কুল থেকে আসে নি এখনো?
– না, চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম,
– আম্মু, এবারের বাড়িভাড়া টা দিতে একটু দেরী হবে। তুমি বাড়িওয়ালা আংকেল কে বুঝিয়ে বলো।
– কেন রে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
– সমস্যা না। মেহেরের স্কুল থেকে পিকনিকে যাচ্ছে সবাই। গত পরশু আমার কাছে বলেছে, আমার তখন মেজাজ খারাপ ছিল বলে দু’একটা কড়া কথা শুনিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

সেদিন সারাদিন বাসায়ই ছিলাম। বের হয় নি কোথাও। মেহের স্কুল থেকে এসে আমাকে দেখে খুব খুশি হল। আমার সাথে অনেক গল্পও করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমার শরীর খারাপ লাগছিলো বলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মাস খানেকের মধ্যে মঈন ভাইয়্যার মাধ্যমে একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে ধ্রুব’র একটা ভাল চাকরী হয়ে যায়। এই খুশির খবর টা ধ্রুব খালি মুখে দেয় নি আমাকে, এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার সাথে সাথে আমাকে কল করে ধ্রুব,

– হ্যালো মায়া।
– জ্বী বলুন। এই অসময়ে কল করেছেন যে? কিছু কি হয়েছে?
– এখনো হয় নি তবে হবে।
– মানে? কি হবে?
– বিয়ে হবে।
– বিয়ে? কিসব আবোলতাবোল বকছেন।
– মায়া, আমি এতদিন আপনাকে কিছু বলতে পারি নি কারণ আমার আর্থিক জোর ছিল না। কিন্তু আজ আমি দাপটের সাথে আপনাকে

– এক মিনিট। আপনি চাকরী পেয়েছেন?
– হুম। এপয়েন্টমেন্ট লেটার টা হাতে এখনো।
– কংগ্রাচুলেশনস। কিন্তু ধ্রুব, আমার পক্ষে রিলেশনে জড়ানো সম্ভব না। আমার এই যান্ত্রিক জীবনে প্রেম ভালবাসার জন্য কোনো সময় আমি বরাদ্দ রাখতে পারি নি।
– প্রেম ভালবাসার কথা তো আমি বলছি না। আমি ফ্যামিলির মাধ্যমে আগাতে চাই। শুধু আপনার সম্মতির অপেক্ষা করছি।
– সম্মতি দিলাম।

এক কথায় সম্মতি দিয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা উথালপাতাল অনুভূতি হতে লাগলো প্রথমবারের মত। কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেল চোখে। সময় এভাবেই যাচ্ছিলো। আর কিছুদিন পরেই ধ্রুব’র বাবা আর চাচা আমাদের বাড়িতে আসবেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আম্মু খুব খুশি। খুশি হতে পারছে না শুধু আমার পুতুল টা। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। আমি বুঝতে পারি বিয়ের পর আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবো বলে তার এই মন খারাপ। ব্যাপার টা নিয়ে মেহেরের সাথে কথা বলা দরকার মনে করেও সময় হয়ে উঠছিলো না সেরকমভাবে। দু’তিন দিন পর কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছিলাম, হঠাৎ মায়ের কল আসে,

– মায়া, বাসায় আয় তাড়াতাড়ি।
– কেন আম্মু, কি হয়েছে। তুমি কাঁদছো কেন? হ্যালো হ্যালো….

ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না। ক্লাস শেষ না করে হুড়মুড় করে কোচিং থেকে বের হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। এসে যা দেখলাম, তা আমার কল্পনারও বাইরে। আমার পুতুলের নিথর দেহ টা মাটিতে পড়ে আছে লাশ হয়ে। ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মেহের আত্নহত্যা করেছে। বিলাপ করতে করতে আম্মু বলছিলো,

– স্কুল থেকে এসে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি তখন রান্নাঘরে ছিলাম। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা খুলছিলো না দেখে পাশের বাসার ভাইজান কে দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখি আমি নিস্পলকভাবে চেয়েছিলাম পুতুলটার মুখের দিকে। একই মায়া মিশে আছে এখনো পুরো মুখটা জুড়ে। আমার পুরো দুনিয়াটা ঝাপসা হয়ে আসছিলো। বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ পাচ্ছিলাম না। বুকটা ভীষণ ভার ভার লাগছিলো। কাঁদতে পারছিলাম না একটুও। কি এমন কষ্ট পেয়েছিলো পুতুল টা, যার জন্য ওকে আত্নহত্যা করতে হল! কারণ খুঁজতে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। মেহেরের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী “সানিয়া” খবর পেয়ে ততক্ষণে চলে এসেছিলো। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়েই থাকতো সে। ভীড় ঠেলে সানিয়া আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললো,

– আপু, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আলাদা রুমে নিয়ে গেলাম ওকে। তারপর ও বলতে শুরু করলো,

– নিজাম স্যারের ব্যাচে আমাদের সাথে একটা ছেলে পড়ে। নাম “রাজ”। দুই মাস আগে রাজ আগ বাড়িয়ে মেহেরের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে। কানের দুল চকলেট এসব গিফট করতো প্রায়ই। ধীরে ধীরে ওদের মেলামেশা বেড়ে যায়। কয়েকদিন আগে রাজ ওকে নানা ধরনের কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। মেহের রাজি না হলে ওকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। বলে, ওর কাছে নাকি মেহেরের কিছু ছবি আছে যা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবে। আমি অবাক হয়ে বললাম,

– কিন্তু মেহের তো ফেসবুক চালাতো না। সানিয়া মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,

– রাজ ওকে একটা মোবাইল গিফট করেছিলো। আপনি বাসায় না থাকলে এটা দিয়ে মেহের ফেসবুক চালাতো। ইদানীং মেহের প্রায়ই বলতো, আপনাকে সব কিছু খুলে বলবে। কিন্তু আপনি নাকি তাকে সময় ই দিতে পারছেন না।
আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। বুঝতে পারলাম গত কয়েকদিনের মনমরার কারণ আমার বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়। আসল কারণ এটা। অথচ আমি ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারি নি মেহেরের মনের ভেতর এসব চলছে! বাইরের মানুষের হতাশা দূর করে বেড়াই আমি, অথচ ঘরের মানুষ টা যে দিনের পর দিন ধুকে ধুকে মরেছে তার কোনো খবরই রাখি নি! বর্তমান যুগ টা যে এত খারাপ হয়ে গেছে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। মেহের চলে যাওয়ার পর প্রায় অনেকদিন আমি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলাম। সেই সময়ে ধ্রুব আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। আম্মুর ভরণপোষণ আর আমার চিকিৎসার খরচ সব ধ্রুব চালিয়েছে। কিশোর অপরাধে রাজ কে খুব বেশিদিন জেলে থাকতে হয় নি। বাবার টাকার গরমে ঠিকই কিছুদিন পর সে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলো।

পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে উঠার পর পারিবারিকভাবে আমার আর ধ্রুব’র বিয়ে হয় কোনেরকম জাঁকজমক ছাড়াই।
আজ পাঁচ টা বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো মেহেরের মৃত্যু’র ক্ষত টা আমার বুকে দগদগ করছে। আজও আমি ডিমভাজি খেতে পারি না, এমনকি করতেও পারি না। মেহেরের বয়স টা ভুল করার মতন বয়স ই ছিল। আমার কাজ তো ছিল সেই ভুল টা শুধরে দেয়া। ও তো আমাকে সব কিছু বলতেও চেয়েছিলো। কিন্তু আমার সময় হয়ে উঠে নি পুতুলটার সব কথা শোনার। সেদিন যখন মেহের আমাকে কানের দুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, কানের দুল টা কেমন লাগছে। তখন যদি আমি প্রশ্ন করতাম এই নতুন কানের দুল টা কে দিয়েছে তাহলেই কিন্তু মেহের গড়গড় করে সব টা বলে দিতো। অথবা ও যখন আমার সাথে গল্প করতে চাইতো, তখন যদি ওর গল্পগুলো শুনতাম তাহলেও সব টা জানতে পারতাম। কথা লুকিয়ে রাখার মত মেয়ে মেহের ছিল না। মেহেরের প্রতি আমার উদাসীনতাই আজ আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। না জানি কত কষ্ট আর অভিমান বুকে নিয়ে আমার মেহের গলায় ওড়না পেঁচিয়েছিলো। শেষ নিঃশ্বাসটুকু থাকা পর্যন্ত নিশ্চয়ই আমার নাম ধরে ডেকে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছিলো।

আজও আমার স্বপ্নে মেহের আসে তার চাপা অভিমানগুলো আঁকড়ে ধরে আর বারংবার আমাকে একনাগাড়ে বলে যায়-“মায়াবিনী, এখানে আমার আর কোনো কিছুর পিপাসা পায় না। শুধু তোমার হাতের ডিমভাজির পিপাসা পায়”
সুস্থ স্বাভাবিকভাবে এখনো বেঁচে আছি আল্লাহ্র অশেষ রহমত তো আছেই, তার সাথে আছে “গুঞ্জন”। গুঞ্জন হচ্ছে ধ্রুব’র ফুফাতো বোন। ধ্রুব’র কোনো ভাইবোন নেই। গুঞ্জন ছোটবেলা থেকে ধ্রুবদের কাছেই থাকে। ওর মা মারা যাবার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করে। তারপর আমার শ্বশুর ওকে এখানে নিয়ে আসেন। গুঞ্জন এখন ক্লাস এইটে পড়ে। ওর মধ্যে আমি মেহের কে খুঁজে পাই। ওর চোখগুলো যেন মেহেরের কার্বনকপি। কিন্তু গুঞ্জনের ডিমভাজি একেবারেই পছন্দ না। গুঞ্জন কে আমি যথেষ্ট আগলে রাখি। আজ দুপুরে রান্না করার সময় গুঞ্জন রান্নাঘরে উকি দিয়ে বলছিলো,

– ভাবী, তোমার সাথে একটু কথা ছিল। রান্নায় ব্যস্ত থাকায় বলে দিয়েছিলাম,
– রান্না করছি দেখতে পারছিস না? বিরক্ত করিস না তো এখন গুঞ্জন।

মন খারাপ করে গুঞ্জন চলে গেল। পরক্ষণেই আমার বুক টা আঁৎকে উঠলো। চুলা থেকে তরকারি টা নামিয়েই ছুটে গেলাম গুঞ্জনের কাছে। গুঞ্জনের সব কথা শোনার পর বুঝতে পারলাম, “আরেকটা রাজের কবল থেকে আমার গুঞ্জন কে রক্ষা করতে হবে। সমাজের চিত্র এখনো কিছুই পালটায় নি।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত