পোড়ার গন্ধ মাখা ভালবাসা

পোড়ার গন্ধ মাখা ভালবাসা

মেয়েটা যখন একদম রিফাতের গা ঘেঁষটে উপুর হল তখন আমার চোখ আটকাল। নরমালি আমি কখনও দেখিনা, কে আসল কে গেল। রিফাতও আনইজি ফিল করছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার ডেস্ক থেকে। রিফাতের এ অবস্থা দেখে আমার বেশ মজা লাগছে। মেয়েটা টকটকে লাল একটা শিফনের শাড়ী পড়েছে, স্লিভলেস ব্লাউজ, কমপক্ষে চার ইঞ্চি উঁচু হিল পড়েছে। মুখটা গোলমতন, চড়া মেকআপ, ব্লন্ড চুল। এসছে ব্যাংক থেকে আমাদের অফিসে ধর্ণা দিতে।

স্যারের সংগে দেখা করতে চান। রিসিপশন তার রূপ দেখেই অজ্ঞান। ডেস্কে ডেস্কে গুঞ্জন উঠেছে, কেউ একজন এসেছে স্যারের সংগে দেখা করতে! আমি খুব ব্যস্ত প্রপোজাল লেটার তৈরী করতে। সেদিকে ধ্যান দিলাম না। এখন বাধ্য হলাম দেখতে। কারণ আমার ডেস্ক থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। চোখ এমনিতেই ঘুরে সেখানে আটকাচ্ছে। মেয়েটা শুধু ব্লাউজ আর ছায়াটা পড়েই চলে আসতে পারত। কি দরকার ছিল শাড়ীটার! পেটের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট, স্পষ্ট পতিটি বলিরেখা। আমি একবার চোখ নামিয়ে ফের তাকালাম।

: স্যার এখানে আপনার সাইন লাগবে।

উপুর হয়ে গা ঘেঁষটে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রিফাতকে। আমি তাকিয়ে আছি। রিফাত কেন যেন নাক কুঁচকে আছে। এমন ললনা দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকানোরতো মানে হয়না! হঠাৎ রিফাত আমার ডেস্কের দিকে তাকাল। খুব অসহায় ভঙ্গিতে মেয়েটার দিকে আবার তাকাল। ললনা হঠাৎ করেই চেয়ার টেনে রিফাতের পাশটাতে বসে পড়ল। এক হাতে চিরুনির মতন চুলটাকে ব্রাশ করল যেন।

: স্যার সবার ডেস্কে ফর্ম গুলো পাঠিয়ে দেন, সবাই সাইন করে দিক। রিফাত আমতা আমতা করছে।
: মানে…
: স্যার কোন সমস্যা নেই। সাইন করার জায়গা ইনডিকেট করা আছে। শুধু সাইন করলেই চলবে।

আমি মুচকি হেসে আমার ডেস্ক থেকে উঠলাম। তাহলে আমাদের সেলারি একাউন্ট হচ্ছে। আমি ভাবছি একবার রিফাতকে আরও অপ্রস্তুত করতে ওর ডেস্কে হানা দিব কিনা। থাক, দরকার নেই, বেচারা! পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার আমাদের হ্যান্ডসাম এমনিতেই নার্ভাস হয়ে ঘামছে! ওর নীল শার্টের পুরোটাই এসির মধ্যে থেকেও নোনাজলে ভিজে উঠেছে। চার ইঞ্চ হিল পড়েও ব্যাংকার সুন্দরীকে তারপাশে লিলিপুটই মনে হচ্ছে। ভাবলাম মেয়েটার উচ্চতা কত হবে? চার আটের বেশী হবে না। ওদের ব্যাংক এমন টকটকে লাল এলাও করে! হঠাৎ আমার এককালের গায়িকা রুক্সির কথা মনে পড়ল। এমনই লাল সাজ ছিল সে গায়িকার। আমি আমাদের রিসেপশনিস্ট লিজার ডেস্কে গিয়ে থামলাম। লিজা আমাকে দেখে খুব একটা অবাক হল না। প্রতিদিনই আমি এ সময় চা খাই লিজার সামনের টুলটায় বসেবসে, গল্প করি, হাজার গল্প। তবে নির্ঘাত আজকের টপিক লিলিপুট সুন্দরী। আমাকে গল্প শুরু করতে হল না, লিজাই শুরু করল। ফিসফিসে গলা! যেন কেউ শুনলে বিপদ।

: দিপু আপা আমি চা নাড়তে নাড়তে জবাব দিলাম।
: হু।

আমাদের এখানে সেল্ফ সার্ভিস। লিজার পাশেই সে ব্যবস্থা। একটা গোল ছোট টেবিল ফিট করা পাশেই। বসে খাওয়ার সাথে আড্ডাও চলে মাঝেমাঝে। তবে লিমিটেড। ওয়ার্নিংয়ের দায়িত্বটা লিজাই পালন করে।

: দেখছেন?
: কি দেখব?
: মডেল একখান আইছে! চিটকি! রিফাত ভাইরে পাইছে!
: তাতে আমার কি?

বলার পর বুঝলাম আমার গলা অভিমানের। রিফাতের গায়েই ঢলে পড়ুক, আর ওর বাসায়ই চলে যাক, আমার কেন লাগছে! ও আমার কে! তারমানে রিফাতের মতন আমিও কি অজান্তেই ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছি? না এ হতে পারে না। এখনও পর্যন্ত রিফাতের ভালবাসাটা একতরফা। অফিসের সবাই এ ঘটনা জানে। তবে আমি নিশ্চুপ থাকায় কেউ এ বিষয়ে আমাকে ঘাটায় না। লিজা একটা গোলাপ বের করে আমাকে দিল। প্রতিদিন দেয়। আমি জানি রিফাত নিয়ে এসে লিজার কাছে দেয়। ওর এতটা সাহস হয়নি সরাসরি আমাকে কোন এপ্রোচ করে। আমিও সে সাহস তাকে দেইনি। তবে কথা হয় নিয়মিত। অফিস পারপাস। হাসি খুনসুটি। ভালবাসার কথা হয়না। কারণ ভালবাসা আমার জীবনে আর আমি আসতে দেব না। ন্যাড়া দ্বিতীয়বার কখনো বেল তলায় যায় না। আমার জীবনে একবার ভয়ংকর ভালবাসা এসেছিল। আমাকে নিঃশেষ করে গেছে। আর একথা রিফাত ভাল করেই জানে। আমার সে ভালবাসার মানুষ রিফাতেরই ক্লাসমেট বন্ধু ছিল। রিফাত আমাকে অনেকবার সাবধান করেছিল। একবার আমার বাসায় পর্যন্ত গিয়েছিল। এক বৃষ্টির বিকেলে যখন আমাকে ফলো করে আমার বাসায় এল আমি অবাক হয়েছিলাম। ঝির ঝির বৃষ্টি। আমি মাত্রই রেডি হচ্ছি নিশানের সাথে দেখা করব। নীল শাড়ী পড়েছিলাম। মাত্রই চুড়ি পরব বলে হাতে নিয়েছি। মা ঘরে ঢুকলেন।

: দিপু, তোর অফিস থেকে কোন লোক এসছে।
: কে?
: নাম বলল রিফাত।

আমি থমকে গেলাম। ওর এত বড় সাহস, ও আমার বাসায় এসে গেছে! আমি আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে পেলাম। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। তিরতিরে ঘাম ছুটল কপালে। ভাগ্যিস আমি মুখে মেকআপ দেইনা। দিলে আজ আর বাইরে যেতে পারতামনা। টিস্যু দিয়ে মুছলাম। ঘর থেকে বের হয়ে নিচে আসলাম। বেচারা বসেনি পর্যন্ত। দাঁড়িয়ে আছে। হ্যান্ডসাম মুখখানাতে তিমির অন্ধকার ভর করেছে।

: রিফাত?
: জি¦।
: কেন এসেছ!
: দিপু প্লিজ। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন…
: কি কথা?
: তুমি আজ যেওনা নিশানের সাথে দেখা করতে প্রচন্ড রাগে আমার গা কাঁপছিল। আমি সদর দরজার দিকে আঙুল তুলে বললাম,
: এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।

রিফাত কিছু বলতে চাইছিল। আমার এমন মূর্তি দেখে থমকে গেল। লক্ষী ছেলের মতন বেরিয়ে গেল। আমি মাকে চিল্লিয়ে বললাম,

: মা, আমি বেরুচ্ছি। রানুকে বল গেইট আটকে দিতে।

আমি রাগে ভুলে গেলাম চুড়ি পড়া হয়নি। একটা হালকা কালারের লিপস্টিক লাগাতে চেয়েছিলাম, তাও ভুলে গেছি। বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম। মোহাম্মদপুর । নিশানের বোনের বাড়ি। আজ ওর বোনের সংগে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার কথা। দেখিনি কেউ আমাকে অনুসরন করছে। নামতেই দেখলাম শুনশান নিরবতা। নিশান বাসার বাইরে দাঁড়ানো। আমাকে বেশ কর্ডিয়ালি ওয়েলকাম করল।

: চলো, উপরে চল। আমিটা কতই গাধা ছিলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকে বুঝলাম কিসের মধ্যে চলে আসলাম। আরও কতগুলো ছেলে আগে থেকেই মজুদ ছিল। আমি ভয় পেলাম।

: নিশান, আপু কই? ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। আমি পিছিয়ে এলাম। হঠাৎ বেল বেজে উঠল। সবাই একটু থমকে গেল।
: কে!!কে!!
: আমি দাড়োয়ান চাচা। দরজা খোলেন। পুলিশ আইছে।
: পুলিশ!!

ওরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। আমি দৌঁড়ে দরজা খুলে দিলাম। পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে রিফাত। আমি রিফাতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সে রাতে সারারাত রিফাত আমার সাথে হসপিটালে ছিল। আমি নাকি অপ্রকৃতস্থ ছিলাম। দুদিন পর নাকি স্বাভাবিক হয়েছি। রিফাত নিজেই বলেছে সে সেদিন আমাকে অনুসরন করে গিয়েছিল। এরপর রিফাতের সাথে শত্রুতার নয় তবে শীতল একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, বন্ধুত্বের কাছটা ঘেসে। আমি কোনদিনই জানতে চাইনি ও কেন আমাকে অনুসরন করেছিল! আমি জানি রিফাতের একতরফা ভালবাসার কথা। কিন্তু আমি যা জানি তা প্রকাশ করি না। রিফাতও কখনও প্রকাশ করে না। আমি জানি প্রতিদিনের গোলাপ রিফাতের দেয়া। কোনদিন বলিনি, কেন দেয়? রিফাত জানে আমি জানি এটা লিজা দেয়। আমি আয়েশ করে চা খেতে বসেছি। রাগে গা জ্বলছে। ঘর্মাক্ত রিফাতও চলে এসেছে। আমি মুখ বাঁকালাম।

: তোমার নতুন প্রেয়সী চলে গেছে?
: না, আমার ডেস্কেই বসা।
: মানে? সে তোমার প্রেয়সী! ওই লালী উলঙ্গ মেয়েটা তোমার প্রেয়সী! রিফাত থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকাল। ও বুঝতে পারল ও ভুল উত্তর দিয়েছে।
: মানে! কোন এঙ্গেল থেকে আমার প্রেয়সী!
: গা ঘেসটে মজা নিচ্ছিল, আর তুমি মজা পাচ্ছিলে! আমি মুখ ঝাঁমটে উত্তর করলাম। চোখ আমার ঝাঁপসা। এখুনি হয়ত পানি এসে যাবে।
: একটু আগেই স্বীকার করলে! সে তোমার প্রেয়সী!
: আমি কখন বললাম! ওই বেটির পারফিউমে এখনও আমার গা গুলাচ্ছে। রিফাত এবার ভাল করে আমার দিকে তাকাল। বেশ হাসি টানল মুখে। চোক টিপল।
: পোড়ার গন্ধ ঠিক পাচ্ছি।

আমি হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম, আমি কি করেছি। আমি কি তাহলে রিফাতের পাশে অন্য মেয়েকে ঠিক সহ্য করতে পারছিনা! আমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়ালাম যাবার জন্য। রিফাত অলক্ষ্যে আমার বাম হাতখানা ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

: ঠিক এইদিনটা জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম দিপু। উইল ইউ মেরী মি?

আমার চোখ বেয়ে কখন জল গড়িয়ে এল। আমি হাসলাম। লজ্জাবতী লতার মতন চোখ বন্ধ করে নিলাম। ও একটা আংটি আমার অনামিকায় গলিয়ে দিল। সামনে ক্লিক শব্দ পেলাম। লিজা ছবি তুলে যাচ্ছে। আর আমার শুভান্যুধায়ী কলিগেরা অনেক শুভকামনা নিয়ে হাত তালি দিল। ওরা যে কখন দৃশ্যপটে চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত