দুরন্ত নামক এক মুড়ির টিন মার্কা বাসে উঠে বসেছি আমি। উদ্দেশ্য গুদারাঘাটে অপেক্ষমান গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করা। শরীর প্রচন্ড খারাপ থাকা স্বত্তেও আমাকে এখন যেতে হচ্ছে। কারণ গার্লফ্রেন্ড খুবই জরুরী কিছু কথা বলতে চাচ্ছে আমাকে। কথাগুলো নাকি ফোনে বলা যাবে না।
গার্লফ্রেন্ডের বাসায় নাকি কয়েকদিন ধরেই ওর বিয়ে নিয়ে কথা চলছে। হয়তো আজকে ব্রেকআপ করে কালকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসার পায়তারা করছে সে। তাই এত জরুরী তলব। আমার চেয়েও ভাল কাউকে পাবে তুমি টাইপের কথা শোনার প্রস্তুতি নিয়েই আমি ঘর থেকে বের হয়েছি।
বাসে উঠে ভাগ্যক্রমে একটা সীট পেয়ে বসে পড়লাম। মাথার ভেতর নাগরদোলা চলছে। মনে হচ্ছে আমাকে কেন্দ্র করে পুরো পৃথীবি ঘুরছে। সীটে হেলান দিতে গিয়ে টের পেলাম যে নীচের নরম অংশ ছাড়া সীটের আর কোথাও নরম কিছু নেই। হেলান দিলে উল্টো ঝাঁকুনির ফলে সীটের লোহার কাঠামোর সাথে লেগে ব্যাথা পেতে পারি। মনে মনে বাসের মালিককে গালি দিয়ে কোনরকমে বসে রইলাম।
কিছুক্ষন পরেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক উঠলেন বাসে। তার পেছন পেছন উঠলো একটা অল্প বয়সী মেয়ে। গায়ে স্কুল ড্রেস। মেয়েটা বাসে উঠে হকচকিয়ে গেছে। কারণ কোন সীট খালি নেই। মহিলা সীট আগেই দখল হয়ে গেছে। উপায় না পেয়ে মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইলো।মেয়েটার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আমার ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে মেয়েটাকে বসতে দেই। কিন্তু আমি ঠিকমত বসে থাকতে পারছি না, উঠে দাঁড়ালে নির্ঘাত উল্টে পড়বো কারো গায়ে। তাই অনিচ্ছা স্বত্তেও বসে রইলাম।
সফুরা খাতুন স্কুলের সামনে থেকে আরো একজন উঠলো। দেখতে নিপাট ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে হবে। মাথায় চকচকে টাক। বাম গালে বড়সড় একটা তিল। লোকটা বাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আগে দেখলো সীট খালি আছে কিনা। তারপর তাকালো দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। একটু পরেই লোকটা এসে দাঁড়ালো মেয়েটার কাছে এসে। জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে ফোনের পর ফোন দিচ্ছে। আমি কতদূর এসে পৌছেছি, এত দেরী হচ্ছে কেন এইসব হাবিজাবি জিজ্ঞেস করছে। আমি ছাড়াছাড়া উত্তর দিয়ে ফোন কেটে দেই।
দুই নম্বরের আগে আরো দুইজন যাত্রী উঠার পর দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে একটু চাপাচাপি করে দাঁড়াতে হলো। এর ফলে মেয়েটা আরেকটু বিপদে পড়ে গেল। গালে তিলওয়ালা লোকটা মেয়েটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেয়েটা যতটুকু পারছে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তিলওয়ালা লোকটা আরো বেশী মেয়েটার গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লোকটা ইচ্ছে করেই মেয়েটার গায়ের উপর গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। আর বারবার তার ঝুলে থাকা হাতটা মেয়েটার স্পর্শকাতর জায়গায় ছোঁয়াচ্ছে। কিন্তু লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে লোকটা এসব ইচ্ছে করে করছে না। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখছি লোকটা আরেকটু মেয়েটার পাশে সরে আসলো। যদিও পেছনে ভালই জায়গা রয়েছে।
এবার আমার মেজাজ চড়ে গেল। আমি সীট থেকে উঠে মেয়েটাকে বললাম,
— আপু তুমি এখানে বসো। তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি।
মেয়েটাকে বলতে দেরী, মেয়েটা সাথে সাথে আমার সীটে বসে পড়লো। মেয়েটা বসে পড়ায় লোকটা বোধহয় একটু হতাশ হলো। কারণ তার চোখে মুখে হতাশার ছাঁপ স্পষ্ট।
আমি মোবাইল বের করে আমার এক বন্ধুকে ফোন দিলাম।
— হ্যালো রাজু কই তুই?
— এইতো নীট কনসার্নের সামনে আছি।
— আমি দুরন্তে আছি। এক শুয়োরের বাচ্চা বাসে একটা মেয়ের সাথে বদমায়েশি করতাছে। চৌধুরি বাড়ি আসার আগে বাসটা থামাবি। তারপর দেখবি আমি বাসে আছি কিনা। যদি বাসে থাকি তাহলে আমার ইশারা পাইলেই শুয়োরটারে ইচ্ছামত পিটাবি।
এতটাই জোরে জোরে কথাগুলো বললাম যে বাসের সব যাত্রী আমার দিকে তাকালো। বাসের হেলপার ছুটে এলো আমার দিকে।
— ভাই কি হইছে? কোন সমস্যা নাকি?
হেলপার এসে আমাকে কথাটা বললো। আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হেলপারের দিকে তাকাতেই হেলপার সুড়সুড় করে পিছিয়ে গেল। গালে তিলওয়ালা লোকটা ঘাবড়ে গেল খুব। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো,
— হেলপার বাস থামাও। আমি এখানেই নামবো।
বাস থামার আগেই লোকটা হন্তদন্ত হয়ে বাস থেকে নেমে গেল। আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম একবার। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমিও বিনিময়ে মুচকি হাসি উপহার দিলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বললো,
— ভাই আপনার ফাঁপর ভালই কাজে দিসে। শালারপুতে নাইমা গেছে।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম। বিনিময়ে লোকটাও হাসলো। এই বাসের সবাই হয়তো দেখেছে লোকটা মেয়েটার সাথে বদমায়েশি করছে, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। হয়তো আমিও কিছু বলতাম না। কিন্তু আমার ঘরে মেয়েটার বয়সী একটা বোন আছে। বাসের আর কারো ঘরে হয়তো মেয়েটার বয়সী মেয়ে বা বোন নেই।
চৌধুরি বাড়ির কাছাকাছি বাস আসার সাথে সাথে বাস থেমে গেল। আমার বন্ধুরা সবগুলো বাসে উঠলো। আমি ওদের বললাম যে লোকটা চলে গেছে। বন্ধুরা সব আফসোস করতে করতে আবার নেমে গেল।
আমি অবশেষে পৌছালাম গুদারাঘাটে। তিশা মানে আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে দেখেই বললো,
— তোমার শরীর খারাপ তাইনা? আমাকে ফোনে একবার তো বলতে পারতা নাকি?
একথা বলেই তিশা আমার কপালে হাত রাখলো। তারপর আৎকে উঠে বললো,
— তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর। তুমি এই অবস্থায় কেন আসছো? আমি তো তোমাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেখা করতে বলিনি।
— আরে এটা কিছু না। তোমার জরুরি কথা বলো।
— আমি বাসায় তোমার কথা বলে দিয়েছি।
— কি বলেছো?
— আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।
— তোমাকে মারে নাই এসব বলার কারণে?
— মারবে কেন? আব্বু আম্মু জানে আমি কখনো ভুল কিছু বেছে নিব না। তাই আব্বু তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
— কখন?
— আজকেই। আব্বু বাসে আছে। আসতেছে তোমার সাথে দেখা করতে।
তিশার কথায় আমি চমকে গেলাম। আমার গায়ে একটা সস্তা টিশার্ট আর ট্রাউজার। এসব পরে কিভাবে আমি তিশার বাবার সামনে দাঁড়াবো বুঝতে পারলাম না। মেয়েটা আসলে একটা গাধী। এসব ব্যাপারে আমাকে আগে জানানো তো দরকার ছিল।
ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম তিশার আব্বুর জন্য। এদিকে তিশা বলছে,
— আব্বু কিন্তু উল্টাপাল্টা স্বভাবের লোক পছন্দ করে না। ভদ্রভাবে থাকবা আব্বুর সামনে। আর মাস্তানদের মত কথা বলবা না। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবা।
তিশার কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে তার বাবা কসাই টাইপের গম্ভীর কেউ হবেন। তাই ভয়ে আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। তিশা আমাকে হঠাৎ কনুই দিয়ে গুতো মেরে বললো,
— ওই যে আব্বু চলে এসেছে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবা কিন্তু।
তিশার বাবাকে দেখলাম। উনার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে হবে, মাথায় চকচকে টাক এবং বাম গালের উপর বড়সড় একটা তিল।