দুইদিন পরপর রহমান সাহেব, স্ত্রী জুলেখা বেগমকে বলেন,
“তুমি আমার কাছে দেন মোহরের দুইলাখ টাকা পাও। যেদিন বলবে, সেদিনই দিয়ে দিবো, বইলো, কেমন?”
জুলেখা মনে মনে হাসে। পেলে, দিয়েই না দিবে, চাইতে হবে কেনো! সে কি রহমান সাহেবকে চেনেনা? ভালোভাবেই চিনে। কুড়ি বছরের সংসার!
এখন তিনি চাইতে বলছেন, যখন চাইবে, মনে মনে খুশি হবেনা। তাকে লোভী ভাববে, পঁচা বউ ভাববে, তা কি সে জানেনা!?
কিন্তু জবাবে জুলেখা বলে,
“আমি কোনো টাকা পাইনা আপনার কাছে৷ কবেই মাফ করে দিয়েছি। লাগবেনা ঐ টাকা আমার। টাকা দিয়ে আমি করবোটা কি?
“তুমি মাফ করলেও মাফ হবেনা বউ। কবরে মাইর দিবে আমাকে, ঐ টাকা তোমার প্রাপ্য।”
প্রাপ্য হলে দিয়ে দাও, এতো কথার দরকার কি! তাকে যে দশভরি স্বর্ণ দিয়েছিলো, তাতেও তো সব খাঁদ দিয়ে ভরে দিয়েছিলো। মনের সাথেই এসব কথা বলে জুলেখা।
একবার কি দরকারে যেন, দোকানে মাপতে গিয়ে দেখে ছয় ভরি! সে রহমান এর কাছে এসে জানতে চায়:
“সব সোনা তো ঠিকই আছে, ওজন কমলো কিভাবে!”
“ওহ, বলা হয়নি, ওখানে ছয় ভরিই ছিলো৷ তোমার বাবা দশভরি থেকে নামছিলই না, তা আমরা কি করবো, বলো? অতো সোনা কেনার টাকা ছিলোনা।”
“তাই বলে জুচ্চুরি!” মনের ক্ষোভ প্রকাশ হয়ে যেতে চায় জুলেখা’র।
“আহা, জুচ্চুরি বলছো কেনো? আমি তোমাকে বাকি চার ভরি বানিয়ে দেবো।” কিছুটা লজ্জিত হয়েই জবাব দেন রহমান।
“দিতে হবেনা। আমার সোনার লোভ নাই, যা আছে তাই পরিনা…”
“এখন লাগবেনা বলছো, সম্পর্ক একটু ঢিলেঢালা হোক তো, তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই আমার কাছ থেকে কড়াই গন্ডায় উসুল করবে..”
“হুম, বলেছে!”
“বলেছে না, এটাই সত্যি।”
হয়তো সত্যি। তবে, সেই চার ভরি সোনাও কুড়ি বছরে পাওয়া হয়নি। জুলেখা এসবনিয়ে ভাবেনা। তার সোনা দানা, টাকা পয়সা এসবের প্রতি কোনো লোভ, মোহ নাই। ভালোভাবে পরছে, খাচ্ছে। দুই ছেলে, স্বামী নিয়ে সুন্দরভাবে দিন যাপন করছে, এতেই সে খুশি। তার চাওয়া পাওয়া এতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ।
তবে একটা মেয়ের জন্য খুব মন জ্বলে। শ্বাশুড়ি সবসময় বলতেন,
“বুড়াকালে সুখ দুঃখের সাথী হচ্ছে বউ, নিজের মেয়ে। তোর ছেলে বউরা যদি তোর মতো ভালো না হয়, তবে দু:খের কথা বুঝাতে কোন দুয়ারে যাবি? আল্লাহ্’র কাছে একটা মেয়ে চা…”
জুলেখা আল্লাহ্’র কাছে অনেক করে একটা মেয়ে চেয়েছে, কিন্তু আল্লাহতাআলা তার পেটে আর কোনো সন্তান দেয়নি মনে হয়। কাউকে মেয়ের আকাঙ্ক্ষার কথা বলেও শান্তি পায়নি।
সবাই বলেছে,
“মেয়ে দিয়ে কি করবে গো? তোমার পেট সোনায় মুড়ানো, দুই দুই ছেলের মা। ঐ দুইটা ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে, ছেলের চিন্তা যুক্তিযুক্ত ছিলো। এখন আর কি চাই তোমার?”
“মেয়ে হয় নাই, শোকর করো। টেনশন নাই।”
“মেয়ে মানে পরের জিনিস, তারে মায়া করে লাভ নাই। হয় নাই ভালোই হয়েছে।”
জুলেখা অবাক হয়, যারা এসব কথা বলেছেন, তারা সবাই কিন্তু মেয়েই!
সতেরো বছর হয়ে গেছে ছোট ছেলের বয়স৷ জুলেখার বয়সও কি কম হলো! উনচল্লিশ, কম নাকি! যদিও রহমান সাহেব, দুইদিন পরপর বলেন,
“হায় আল্লাহ, বিয়ের কুড়ি বছর হয়ে গেলো! মনে হয়, এইতো চার পাঁচবছর আগেই না বিয়ে করলাম। তা জুলেখা তুমি তো বুড়ি হচ্ছোনা…!”
“আপনি বুড়া হয়েছেন নাকি? আপনি তো পুরা জোয়ান, ছেলেদের বড় ভাই মনে হয়।”
“হাহাহা…তাই নাকি! তোমাকেও কেউ এত্তো বড় দুই ছেলের মা বলবে না।”
“হুম, বলছে আপনাকে!”
লজ্জা পায় জুলেখা।
রহমান মানুষ খারাপ না, হাসিখুশি। মাঝেমধ্যে ঠাট্টা মশকরাও করে, এসব খুব ভালোলাগে জুলেখার।
একদিন গভীর রাতে, জুলেখা’র মাথার সামনে পেছনে খুব ব্যথা করতে থাকে। হঠাৎ করে ঘামে সারা গা ভিজে গোসল হয়ে যায় সে।
জুলেখা কোন মতে রহমানকে ধাক্কা দিতে দিতে রহমানের গায়েই হরহর করে বমি করে দেয়৷ রহমান ধড়ফড় করেই উঠে বাতি জ্বালায়৷
“কি হয়েছে জুলেখা, কি হয়েছে বউ?”
জুলেখা জবাব দিতে পারেনা, তার শুধু বমি পায়। সাথে যোগ হয়েছে বুকের বাঁ পাশে ব্যথা।
রহমান জামা পাল্টে, দুই ছেলেকে ডেকে ডাক্তার ডাকতে ডাকতেই জুলেখা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ডাঃ এসে বলেন, ওর খারাপ ধরনের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে, তাই প্রথমবারেই ধাক্কা সামলাতে পারেনি, মারা গেলেন।
রহমান সাহেবের যেন বিশ্বাসই হয়না, জুলেখা তার সামনে হঠাৎ করেই মারা গেলো! ছেলেরাও সুস্থ মায়ের আকষ্মিত মৃত্যুতে হতবাক! হুশ আসতেই রহমান চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকেন।
“আমাকে তো দোজখের আগুনে জ্বালাবে বউ, তোমার হকটাও তো আদায়ের সুযোগ দিলে না বউ, আমি তো দেন মোহরের টাকাটাও দিলামনা…”
আশেপাশের সবাই এসে সান্ত্বনা দেন।
“কেঁদো না ভাই, আত্মার কষ্ট হবে।”
কেউ বলেন, ” তোমার দুই ছেলেই এখন তার ঐ প্রাপ্যের হকদার। তাদের দিলেই তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।”
“গরীব দু:খী নয়তো এতিমখানায় দিয়ে দাও ভাই, তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।”
কেউ কেউ বলেন:
“জুলেখা সরাসরি বেহেশত পাবে, স্বামীর আগে মরলো।”
“আহা, স্বামীর চোখের পানি পড়েছে যে বউয়ের জন্য, সে তো বেহেশতবাসী।”
বিভিন্নজনের কথায় পরিবেশ সরগরম। ছেলে দুইজন বড় হয়েছে, কাঁদতেও লজ্জা লাগে। মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসে আর পারেনা, শূণ্য ঘর দেখে ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে যায়। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চিল্লিয়ে কাঁদে।
“মা কই পাবো ভাই, কই পাবো?”
সপ্তাহ তিন পার হয়। বাপ ছেলেদের কাছে ডেকে বসান,
“শোন ছেলেরা..”
“জ্বি বাবা, বলেন।”
“এভাবে তো নারী ছাড়া সংসার চলেনা। কাজের লোকের রান্না তো মুখে রুচেনা।”
“কি করবো বাবা?”
“তোমরা আর কি করবে! তোমার বড় ফুফু খুব করে ধরেছে বিয়ে করাতে।”
“এতো তাড়াতাড়ি কে বিয়ে করবে বাবা, আমার মাত্র উনিশ বছর।”
বড় ছেলে বলে।
“তোমাকে কে বিয়ে করাচ্ছে, তুমি তো ছোট ছেলে।”
“তাহলে?”
“বিয়ে আমি করবো। তোমার ফুফু মেয়ে ঠিক করেছেন। চল্লিশ দিনের ভেতর বিয়ে না হলে, আবার একবছর পার না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে সম্ভব না। নিয়ম নেই।”
“কি বলেন বাবা! মা মরেছে দুইদিনও হয়নি।”
“তিন সপ্তাহ হয়ে গেলো, কি বলো তুমি!”
“আপনি মাকে ভালোবাসতেন না? এতো কাঁদলেন…এখন বিয়ে করতে চান, আপনার লজ্জা করছেনা? ”
ছোট ছেলে বলে।
“বিয়ে করবো লজ্জা কি! আর বিয়ে কি শখে করছি? কে তোমাদের রেঁধে খাওয়াবে? বুড়া কালে আমাকে দেখবে কে শুনি!”
ছেলেরা ওখান থেকে সরে যায়, রাত গভীর হলে, আবার মায়ের জন্য কাঁদতে বসে। মায়ের আত্মা নিশ্চয় তাদের দেখছে, চল্লিশদিন পর্যন্ত নাকি ঘুরে বেড়ায়! তার কি কষ্ট হচ্ছেনা, বাবার এমন সিদ্ধান্তে!? একটা বছরও কি বাবা অপেক্ষা করতে পারেনি!? ঘরের সবখানে যে মা আছে, কোনদিকে ফিরে মায়ের চোখাচোখি না হয়ে চোখ লুকাবে? মাও তো নিশ্চয় তাদের সাথে সাথে কাঁদছে।
ছোট ছেলের মনে এসব কথা ঘুরছে। সে কাঁদে,
“মা ফিরে আসো তুমি, প্লিজ প্লিজ…!”
জুলেখা’র মৃত্যুর আটত্রিশ দিনে, সাবিহা বউ হয়ে আসে। সেইদিন জুলেখা’র চল্লিশার নাম করে, খুব খানাপিনা তৈরি হয়। আবার সবার মন্তব্যে মুখর হয় পরিবেশ।
“বিয়ে করেছে, ভালোই করেছে, নারী ছাড়া সংসার অচল, অকেজো।”
“বিয়ে করেছে, এরপরও বড়বউ এর জন্য কতো খানার আয়োজন, অনেক ভালোবাসতো বড় বউকে, দেখলেন!”
কেউ বলেন,
“ব্যাটা এতো কাঁদলো সেদিন, কবরের মাটিও তো শুকাতে দিলো না। অল্পবয়সী বউ আনলো ঘরে।”
“আচ্ছা, বড় বউয়ের দেনমোহর কি সে আদায় করছিলো?”
“তা যাই বলো, খাবার কিন্তু জব্বর হয়েছে আজ।”
“আচ্ছা এটা বিয়ের খাবার নাকি চল্লিশা?”
“ধুর, মুরগীর আইটেম যে করলো, ওটা কি খেয়েছেন, লবণ ছোঁয়ায় নি মনে হয়।”
“শেষের দিকে তো খানা শর্ট পড়লো মনে হয়, কয়জন ফকির দেখলাম, বদ দোয়া দিতে দিতে চলে গেলো।”
যার যেমন ইচ্ছে মন্তব্য করছে, কেউ শুনছে, কেউ শুনছেনা। দুইছেলে মায়ের কবরের পাশে বসে দীর্ঘ মোনাজাত করে।
সাবিহা গরীব ঘরের অল্পবয়সী মেয়ে। রঙ একটু কালো বলে, যৌতুক ছাড়া তার জন্য কোনো প্রস্তাবই আসেনি। রহমান সাহেব উল্টো তার বাপকে দুইলাখ টাকা দিয়ে তাকে বিয়ে করে আনলেন। সাবিহা’র কোনো মতামতের দাম নেই, বাপ বলেছে, এখানে বিয়ে, তো এখানেই। তাও কতো ভালো ভাগ্য তার, কালো হয়েও যৌতুক ছাড়া বিয়ে! পরবর্তীতে যৌতুকের জন্য মার খাবার সম্ভাবনাও নেই।
আর রহমান সাহেব, জুলেখার দেন মোহর এর টাকা কোনোভাবে পরিশোধ করলেন কিনা তা জানিনা। তবে বিয়ের দিন, সাবিহা’র হাতে গলায় জুলেখার ছয়ভরি সোনা শোভা পাচ্ছিলো।