আমার ভাইয়া গতকাল থেকে নিখোঁজ। বাবা তাকে নিজে থেকেই বের করে দিয়েছেন। বের না করে উপায় ছিল না। বাবার জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম। মুহিব ভাইয়া বয়সে আমার থেকে ঠিক এক বছরের বড়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মার্জিত সে। ভাইয়া যখন হাসে তখন মেয়েরা গলে পড়তে বাধ্য হয়। তবে ভাইয়া কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয় না। ভাইয়ার অনেক অহংকার। সে ভীষণ ছেলেমানুষ। তাই বলে সে যে এমন কান্ড করবে ভাবা যায় না। লজ্জায় আমি আর বাবা নিস্তার পাচ্ছি না। ২৪ ঘন্টা পার হওয়ায় বাবা সন্ধ্যাবেলা থানায় জিডি করে ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আমাকে তার ঘরে ডেকে বললেন, “এ বাসাটা ছাড়তে হবে। তাহেরা আপা এক মাস সময় দিয়েছেন।” তাহেরা আন্টি আমাদের বাড়িওয়ালি। তিনি যে এটা করবেন সেটা জানা ছিল, তাই ব্যাপারটির অপেক্ষায় ছিলাম। তবু বাবার মুখে কথাটি শুনে অপ্রস্তুত হলাম। আরও একবার লজ্জায় কান ঝা ঝা করতে লাগলো। ভাইয়াকে মনে মনে ক্রোধান্বিত হয়ে দোষারোপ করতে থাকি।
ঘটনাটি তাহলে খুলেই বলি। ছ’মাস হল আমরা গ্রাম থেকে শহরে এসে উঠেছি। এ বাসার মালিকের একমাত্র মেয়ে দিশা। আমার ভাইয়ার থেকে যিনি পাঁচ বছরের বড় তাকে ভাইয়া আপাদমস্তক না জেনেই প্রপোজ করে বসলো। ভাইয়া এবার নিউ টেনে পড়ছে। সায়েন্স গ্রুপ। দিশা আপুও সায়েন্সের ছাত্রী ছিলেন। ভাইয়া নিজ থেকেই গরজ নিয়ে প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা বই নিয়ে দোতলায় যেত দিশা আপুর কাছে পড়া বুঝতে। এটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে একদিন বিকালে দিশা আপু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “পিন্টু, এদিকে শুনে যা।” দিশা আপু ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি কাছে গেলাম। তিনি তখন বললেন, “তোর ভাইয়া যেন আর আমার কাছে না আসে। বলে দিস।” আমি তখনই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কী সেটা? ভাইয়া কি ছেলেমানুষি কোনো ইয়ার্কি করেছে? হয়তো দুষ্টুমি করে টিকটিকির বাচ্চা মেঝেতে ফেলে ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে তার থেকেও বড় সেটা আমার অকর্ষিত কল্পনাতেও ছিল না।
ভাইয়াকে আমি সেদিন সন্ধ্যায় বই নিয়ে হাসিমুখে যেতে দেখে বাধা দিই। বলি, “ভাইয়া, দিশা আপু তোমায় যেতে বারণ করেছে।” ভাইয়া কিছু বলল না। সে আড়াল হতেই আচমকা তার ডায়রীটা তার পড়ার টেবিলে দেখতে পাই। এটা খুব সম্ভব লুকানো থাকে, ভাইয়ার অতি পার্সোনাল। তবু দিশা আপুর ব্যাপারটি জানতে আমি ডায়রী খুলে বসি। তারিখ দিয়ে প্রথম দিনের ঘটনা লেখা “আজ ওর হাতে হাত রেখে অপ্রস্তুত হবার ভান করেছি। সেও কিছু বোঝেনি। কিন্তু যখন একটু হেয়ালী করে নাম ধরে ডাকলাম তখন ও আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো। না বাবা, আর ওকে ক্ষ্যাপানো যাবে না আমি পুরোটা না পড়ে একদম মাঝের পাতায় চলে গেলাম “ও আজ ওর রুমে ছিল না। স্বভাবতই তাই ছাদে গেলাম ওকে খুঁজতে। পেছন থেকে ডেকে বললাম, “তোমার কি মন খারাপ?” “হ্যা। আজ আর মন ভাল নেই। একা থাকতে চাই। যাও।” “আমি তো বিরক্ত করতে আসিনি। একটা বিশেষ কথা বলার ছিল।” ও তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, “তোমার আবার বিশেষ কথা কী?” আমি অধৈর্য্যের মত বলি, “আমি আর পারছি না।” “তারমানে?” “আমি তোমাকে পছন্দ করি, সেটা বুঝো না?” “আমি কিন্তু চলে যাব!” ও রেগে আগুন হল। আমি তবুও সাহস নিয়ে ওর দিকে এগুলাম। বললাম, “প্লীজ আমায় ফিরিয়ে দিও না।”
সে সত্যিই আমায় ছেড়ে প্রস্থান নিলো আমি ডায়রি বন্ধ করলাম। রাগে দুঃখে আর অপমানে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে। ভাইয়া অবশ্য মন পরিবর্তন করে, দিশা আপুর কাছে তাকে আর যেতে দেখি না । দিশা আপু তবুও একদিন তার মাকে সব কথা খুলে বললেন। আন্টি খুবই ঠান্ডা মাথার মহিলা। তিনি আমাদের বাসায় একদিন সকালে এসে হাজির হলেন। আমার বাবাকে হাসিমুখে বললেন, “আপনি তো আর আমাদের বাসায় আসেন না তাই আমিই এলাম।” বাবা সাধারণ প্রস্তাবনা ভেবে বললেন, “এসে ভালোই করেছেন আপা।” এদিকে আমি দরজার আড়াল থেকে সব শুনছি। ভাইয়া বাসায় নেই তখন। আন্টিই খোঁজ করলেন ভাইয়ার, “মুহিব কোথায়?” বাবা বললেন, “ও তো কোচিংয়ে।” “ওর পরীক্ষা তো চলেই এলো। কোথায় ভর্তি করাবেন সে সম্পর্কে একটু আলাপ করব। এলে পাঠিয়ে দেবেন।””কেন, কিছু হয়েছে?” আন্টি এবার সবিস্তারে সব বললেন। বাবা যখন সব জানতে পারলেন ভাইয়াকে আচ্ছামত পেটালেন। পরদিন সকালেই তারপর ভাইয়া নিখোঁজ।
এভাবে এক সপ্তাহ পার হল। আজ একটি বিশেষ দিন। ভাইয়ার জন্মদিন। এটা মনে হতেই ভাইয়ার ওপর থেকে কেন জানি রাগ মুছে যেতে থাকে। ভাইয়াও ফিরে এলো কিছুদিন পর। তাকে কেমন আচ্ছন্নের মত দেখাচ্ছিল। আমি করুণ চোখে তাকাতেই সে বলে, “কীরে, কেমন আছিস?” এটা বলেই ভাইয়া ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায়। শব্দ শুনে বাবা ছুটে আসেন। আমি আর বাবা ধরাধরি করে ভাইয়াকে হাসপাতালে নিই। সেখানে ডাক্তার বললেন সুইসাইড অ্যাটেম্পট। বহুকষ্টে বাবা আর আমি নিজেদের শোক সামলালাম। ইতিমধ্যে হুট করে দিশা আপুকে হাসপাতালে আসতে দেখি। আমি না দেখার ভান করে করিডোরের একপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। দিশা আপু ডেকে ওঠেন, “পিন্টু!” তিনি কাছে এসে আমার হাতে হাত রাখেন। বলেন, “আমায় ক্ষমা করে দে পিন্টু।”
আমি অবাক হয়ে তাকাই। তিনি নিজ থেকেই বলেন, “মুহিব কিছুই করেনি। বরং আমিই ওকে ভালবাসতাম। ও আমার ভালবাসাতে রাজি হচ্ছিলো না বলেই আমি এসব করেছি।” আমি বললাম, “কী বলছেন এসব। তাহলে ভাইয়ার ডায়রীতে যা লেখা”ওটা ওর ডায়রী নয়, আমার।”আচমকা আমার মনে হল পায়ের নীচ থেকে কেউ মাটি সরিয়ে নিচ্ছে। আমি নিজেকে কোনোমতে সামলে বলি, “ভাইয়ার কিছু হলে আপনাকে আমি ছাড়ব না।” এটা বলেই আমি চলে আসি বাবার কাছে। বাবা বললেন, “আমার বড় ছেলের জন্য আমার কোনোই দুঃখ নেই।”
“বাবা, ভাইয়া কিছু করেনি।”
আমি সাথে করে নিয়ে আসা দিশা আপুর ডায়রীটা বাবার হাতে দিলাম। বাবা সব পড়ে এই প্রথম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার কান্নায় হাসপাতালের সবাই অভিভূত হয়ে গেল। দিশা আপুও কান্না শুনে অদূরে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলো। আর আমি পড়ে নিলাম বাবার কান্নার ভাষা, যেন বাবার চোখের পানি বলছে, “মানুষ কেন এমন হয়?”