আমাকে নিয়ে লোকে এত ভাবে তা বিগত মাস চারেক আগেও বুঝিনি। আমার মাথা নিয়ে এক এক জনের ভিন্ন ভিন্ন কৌতুহল। এই তো সেদিন এক পরিচিত ভদ্র মহিলার সাথে দেখা হবার পর বুঝলাম আমার বিবাহ নিয়ে সে বড়ই চিন্তিত। যদিও বিবাহ নিয়ে আমার পরিবারের কোনো মাথা ব্যাথা নেই তবে এক শ্রেনীর মানুষের খুউব করে তা আছে। সে শ্রেনীর একজন ঘরে এসে বলতে লাগল, “মেয়েকে এই বয়সে ইয়ে করিয়েছেন, বিয়েটা হবে তো? ইয়ে অবস্থায় কোন ছেলে বিয়ে করতে রাজি হবে বলুন?
মাথায় ইয়ে গজাতে তো বছর দুয়েক লাগবেই।” তার কথার মাঝে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সামনে এসে দাড়ালাম। আমাকে দেখে আন্টির চোখের পানি ছলছল করছে। ভাব এমন নিচ্ছে যেন আমি দুরারোগ্য রোগে ভুগছি আর অল্প কিছু দিনের মধ্যে পটল তুলব। ন্যাড়া হবার পর থেকে প্রতিবেশি আন্টিদের প্রতিভা ঠিক এইভাবেই বিকশিত করছি আমি। ওহ! বলে রাখি, আন্টি যে ইয়ে ইয়ে করছে এই ইয়ে মানে “ন্যাড়া”। আমার জন্য সে আন্টির কপালে সেদিন খাতির যত্ন জুটেনি।
আন্টির চিন্তার অবসান ঘটলো এর কিছুদিন পরেই। বিয়ে তো আমার হবেই! এতে কোনো সন্দেহ নেয়। এই যে হিজাব পড়ার কিছু দিনের মধ্যেই কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব পেয়েগেছি। এবার বলুন? পাত্রের কি আর অভাব আছে? না জেনে হলেও তো বিয়ের আগ্রহ দেখিয়েছে। হিজাবের ভিতর কদবেলের খবর তাদের না জানলেও চলে।
বিয়ে টিয়ে অনেক হল। এবার আসি অন্য ঘটনায়।একবার এক রিকশা চালকের সাথে ঝগড়ার উপক্রম হল। সময়টা ছিল সরস্বতী পুজোর। অঞ্জলি দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি এমন সময় এক রিকশা চালক পিছন থেকে কপালে হাত দেখিয়ে রাগান্বিত চোখে কি সব বলছে। সামনে গিয়ে তার সমস্যা কি জানতে চাইলেই সে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল। তার কারণ ছিল এইরূপ – “মুসলিম হয়ে কপালে চন্দনের তিলক দিয়েছি “। এই তিলক নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে তা ভাবিনি। তারে কি আর বলতে পারছি, ভাই আমার মাথা কদবেল। সেদিন খুব করে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিল তার সাথে। এতো গেল মন্দিরের বাইরের কথা,,ভিতরের কান্ড তো আরো ভয়ানক। মন্দিরে ভক্তরা আমাকে চোখে চোখে রাখে। অনেকে তো পাশেই বসতে চাই না। হিজাব পড়া মেয়ে মন্দিরে এসে ঠাকুর প্রণাম করছে একি চারটে খানি কথা? সন্দেহের বিষয় তো বটেই। আসলে বিষয় তো এটা না। আমি হিন্দু ঠিকই তবে ন্যাড়া মাথার জন্য হিজাব করা। মানুষ কি আর ভিতরের কাহিনী জানে? আমার কিন্তু বেশ লাগে এসব। এইসব হচ্ছে অপরিচিতদের কথা। পরিচিতরা তো তাদের থেকেও ভয়ানক।
আমাকে রীতি মত সমাজচ্যুত করবেন তারা। খোঁজ নিচ্ছে কাছের মানুষ থেকে, মেয়ে মুসলিম হয়ে গেল কেন! তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আমার একটা ব্যবস্থা তাদের করতেই হবে। অভিভাবকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাস্তায় কেমনে চলাফেরা করছি তা তো আমি জানি। কি যে খারাপ অবস্থা। কটূ কথা বলতে ছাড়ছে না এলাকার বেকার ছেলেরা আর সমাজের সিসি ক্যামেরা। আমার জন্য না জানি কত জনের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিষয়টা আরো খারাপে যেত। কিন্তু তার আগেই অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে আমার চুল কয়েক ইঞ্চি গজালো। হিজাব ছেড়ে এখন চুলে জেল দেয়ার সময় হয়েছে। চিন্তিত ও প্রতিবাদী লোকেদের অবস্থা হল এই – “তাহারা তাহাদিগের ভুল বুঝিতে পারিয়া মোরে দেখিয়া লজ্জিত চাহনিতে মুখ ঘোরায়। ”
স্যোসাল মিডিয়াতে এখন অনেক নাম ডাক। ফ্রেন্ড গুলোও আজকাল আমার সাথে পিক তোলার জন্য উঠে পরে লাগে। আমি কি বুঝি না? আলবাত বুঝি।আমাকে দিয়ে যদি নিজেদের একটু হাইলাইট করা যায়। তাতে মন্দ কি? এতে দ্বিগুন লাভ আমারই।কেবল ছবি তুলে তারা ক্ষান্ত হয়না, তা তারা আপলোড দিবে সাথে আমারে ট্যাগাবে। এরপর পোস্ট আপলোড হবার সাথে সাথে ম্যাসেঞ্জার টুং টাং শব্দ করতে শুরু করে। টেক্সট গুলো নানান ভংগীতে হলেও, সারমর্ম ওই একটাই। বাল! বাল! বাল! ( পজিটিভ ভাবুন। আমি হিন্দিতে বলেছি।)
জানেন তো! এখন আমি ছোট খাটো সেলিব্রেটি। বিশ্বাস করুন, আমি ফেবুতে ভিডিও ভাইরাল,কোনো রিয়েলিটি শো কিংবা নাটক-চলচিত্রের মত সময়বহুল কর্ম করিনি। আমি কেবল সদ্য ইঞ্চি কয়েক চুল নিয়ে ঘুরছি। লোকে আমাকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে। কেউ কেউ তো আমাকে দেখার চক্করে রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হতে হতে বেঁচে ফিরছে। এখন তো মেয়েরাও আমাকে খুব করে দেখে। এই দেখাতে সীমাবদ্ধ থাকলেই হতো। কিন্তু না তারা আমাকে আরো বড় রকমের সেলিব্রিটি করে তুলল। আমাকে নিয়ে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে গবেষণা চলে। এই আমি আজ লোকাল বাসটাকেও গবেষনা কেন্দ্র করে তুলেছি। এর জন্য আমাকে ছোট খাটো একটা নোবেল দিলেও চলবে। আমি ভ্রুক্ষেপ করব না।
আপনারা ভাবতে পারেন এই ছোট চুল আর এমন কি ! ভাইদের ক্ষেত্রে না হলেও বোনদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর। তাই বলি কি বোন, ন্যাড়া মাথায় সদ্য চুল গজানো মাথা নিয়ে ঘুরে দেখো তাহলেই বুঝতে পারবে। বলে রাখা ভাল,,ইহা ইনভেস্ট ছাড়া আইকন হবার কার্যকরী উপায়। আমি ফল পেয়েছি, আপনিও পাবেন। একবারেই যথেষ্ট। কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।