আমার ছেলে আমাকে নিয়ে প্রায়ই হাসিতামাশা করত৷ এখনও করে৷ মিহিন যখন আমাকে কোনো ব্যাপারে বকাঝকা করে তখন সে মিটিমিটি হাসে। আমার রাগ হয়৷ একে তো স্ত্রীর বকা খাওয়া, তার উপর ছেলের হাসি; গা জ্বলে যেত৷ রেগে গিয়ে আবার চিল্লাচিল্লিও করতে পারতাম না৷ মিহিন চোখ গরম করে এমন ভাবে তাকাতো যেন আমায় আস্ত খেয়ে ফেলবে৷ এই বৃদ্ধ বয়সে তার এমন রূপ সত্যিই অভাবনীয়। আমার তো মনে হয় আমি সেই যৌবনের মিহিনকে দেখছি৷ রেগে লাল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অনেকটা অসহায় হয়ে বারান্দায় চলে আসি। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দেই৷ ঠিক সেই সময়েই আমার ছেলে এসে হাজির হয়। ছেলের নাম হিমেল৷ আপাতদৃষ্টিতে সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে জব করছে। সে এসেই আমার পাশের চেয়ারটাতে বসে। যেটা একান্তই মিহিনের জন্যে রাখা। এ ব্যাপারে আমি হিমেলকে বহুবার নিষেধ করেছি। কিন্তু সে কখনই আমার কথা শুনে না৷ সে এসে তার মায়ের চেয়ারটিতেই বসবে এবং আমার রাগের ব্যাপারটা নিয়ে মজা করবে। এমনটা প্রায়শই ঘটে৷ ছেলের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুত্বসুলভ। তাই সকল ব্যাপারে আমরা দ্বিধাহীনভাবেই কথা বলি৷ বারান্দায় এলে তার প্রথম কথা যেটা হয়,
-শুনেছি বিয়ের পর সকল স্বামীই পোষা বেড়ালের মতো হয়ে যায়৷ কাপুরুষতা এসে ভর করে। স্ত্রীর গোলামি শুরু করে। যে কালে ছেলেটি হুংকার দিয়ে কথা বলতো আজ সে মিউ মিউ করে কথা বলে৷ তার গলার স্বর দরজার এপাশে আসে না৷ কথাটার যথার্থ প্রমাণ তোমাকে দেখলেই পাওয়া যায় বাবা! হাহাহা!
এই বলে সে হাসতেই থাকে। মনে হয় যেন ভীষণ মজা পাচ্ছে। ভীষণ। আমি কেবল দম খিঁচে পড়ে থাকে। ছেলেটাকে কিছু বললেই তার মা আবার দানবীয়রূপ ধারণা করবে৷ এই মা ছেলে হয়েছে একদম এক রকম। দুজনেই আমার মজা নেয়৷ হিমেল হাসি হাসি গলায় বলে,
-এমন কেন বাবা? আম্মুকে এত ভয় পাও কেন? বিশ্বাস করো, আম্মু যখন তোমাকে বকা দেয় না, তোমার মুখটা তখন এমন হয় যে না হেসে পারা যায় না৷ এত বড় মুখটা তখন শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে যায়৷
আমি এবারেও কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। সে আবার বলল,
-থাক! বেশি মন খারাপ করো না। কী করবে? তুমি তো ভীতু৷ বউয়ের মুখের উপর কথা বলতে পারো না। সমস্যা নেই। বি নরমাল। তোমার মতো ভীতু এটারই প্রাপ্য।
এই বলে সে আবারও হাসিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি খানিকটা নিচু স্বরে বললাম,
-বিয়েটা কর! তখনই প্রমাণ পাবি আমি আসলে এমন কেন করি৷
-হেহ! আমি কি তোমার মতো হবো নাকি? হ্যাঁ? তুমি তো মিউ মিউ করো৷ আমি এমন মিউ মিউ করব না। আর আমার দ্বারা ওসব গোলামী টোলামী হবেও না৷ আমি কারো কথা শুনবোও না, মানবোও না। আমার লাইফ আমার রুলস। কারো যদি আমার সঙ্গে থাকতে হয় তাহলে তাকে আমার রুলস গুলো মেনে চলতে হবে৷ আমি তোমার মতো স্ত্রীর রুলস মেনে চলাদের মতো না! বুঝলে?
আমি হঠাৎই আমার বাঁ’চোখের ভ্রু টা উঁচিয়ে ছেলের দিকে তাকালাম৷ মুচকি হাসলাম খানিক। এরপর মাথার পেছনে দু’হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে হাসতে থাকলাম। শব্দহীন হাসি৷ হিমেল বলে উঠল,
-কী ব্যাপার? তুমি হাসছো কেন?
আমি কিছু বললাম না। এবার সশব্দে হাসলাম। আমি ভারী মজা পাচ্ছিলাম। বুকের ভেতর হঠাৎই এক প্রকার পৈশাচিক আনন্দ আমায় আন্দোলিত করতে থাকল। আমি পাঁ দুলিয়ে দুলিয়ে হাসির মজাটা নিলাম। বেশ প্রশান্তি নিয়ে ছেলেকে বললাম,
-ঈশিতা কে জানি? চিনিস এ নামের কাউকে?
হিমেলের মুখ তখন দেখার মতো ছিল৷ এমন হতবিহ্বল হতে তাকে আর কখনই দেখা যায়নি। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল,
-তু-তু-তুমি ওকে চিনো কী করে?
-আরে বাঃ নাম শুনতেই তোতলানো শুরু হয়ে গেল? বিয়ে হলে কী হবে?
হিমেল কিছু বলল না। চুপচাপ বসে থাকল। আমি তার চোখে খানিকটা লজ্জা এবং ভয় দেখতে পেলাম। তবে এতে খুশির পরিমাণটাই বেশি বলে মনে হলো আমার। আমি চোখ বন্ধ করে ছেলের ভবিষ্যৎ দেখে নিলাম। আমার তখন অসম্ভব আনন্দ লাগছিল। ভাবলাম ছেলেকে এবার একটা ভালো শিক্ষা দেয়া যাবে৷ বললাম,
-হিমেল! বাবা প্রস্তুত হও। তোমার জীবনে অপরিসীম পরিবর্তন আসতে চলেছে।
এই বলে উচ্চ স্বরে হাসতে থাকলাম। ওপাশের রুম থেকে মিহিন গলার আওয়াজ ভেসে এল। আমি হঠাৎই চুপ হয়ে গেলাম। এবং পরক্ষণেই আবার হাসতে থাকলাম। হিমেল তখনও ভ্রু কুচকে আমায় দেখছিল।
এর প্রায় বেশ কিছু মাস পরের কথা৷ এই কদিনে ছেলেকে বেশ সুখিই দেখালো। আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে সে বউকে এটা করো ওটা করো করতে বলতো। বউমা করতো। আমি কিছু বলতাম না। কারণ সময় তখনও আসেনি। কিন্তু যখনই বাসার দায়িত্ব অনেকাংশে ঈশিতার উপর চলে গেল তখনই হিমেলের দুঃসময় শুরু হলো। ছোটখাটো ব্যাপারে সে আস্তে আস্তে বকা খেতে থাকল। সেদিন দেখলাম বাজার থেকে ফিরেই ঈশিতার ঝাড়ি খেল। আমি তখন সোফায় বসে ছিলাম। ও বেশ ক্লান্ত হয়ে সোফায় এসে বসল। বউমা এগিয়ে এসে বাজারের ব্যাগ নিয়ে কিচেনে চলে গেল। অল্প কিছু বাদেই হঠাৎই বউমার হুংকার শুনতে পেলাম।
-হিমেল? এই হিমেল? এটা কী এনেছো? পটল তোমাকে আনতে বলেছে কে? তুমি জানো না আমি পটল খাই না?
হিমেল স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
-সেটা যাওয়ার আগে বলে দিলেই তো পারতে?
-তোমাকে বলিনি আমি?
-ও? বলেছো নাকি? সরি আমার খেয়াল ছিল না৷
ঈশিতা চোখ মুখ লাল করে রান্না ঘরে চলে চলে গেল৷ যাক! প্রথমবারের মতো হিমেল বেঁচে গেল৷ আমি তার চেহারায় বিজয়ের হাসি দেখতে পেলাম৷ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-দেখেছো? এভাবে বউকে কন্ট্রোল করতে হয়৷ স্মুদলি৷ তুমি জানো না তাইই তুমি বকা খাও। অজ্ঞরা প্রতি ক্ষেত্রেই ঠকে। বুঝলে?
ঠিক তখনই ঈশিতা আবার ফিরে এল। কিন্তু হিমেল তাকে দেখতে পেল না৷ সে আমার দিকে তাকিয়েই হাসি মাখা কণ্ঠে বলল,
-আমার থেকে শিখো বাবা! তাহলে অন্তত বাকি জীবনটা মায়ের কাছে বকা খেয়ে পার করতে হবে না। আর কতকাল এভাবে মায়ের বকা খাবে তুমি? আর তুমি ভুল প্রমাণিত হলে তো? দেখলে আমি কীভাবে ঈশিতাকে কন্ট্রোল করলাম। ভবিষ্যতেও এভাবে টাইট দিয়ে যাবো তাকে। তাহলে আর তোমার মতো এমন মিউ মিউ করতে হবে না৷
আমি হাসলাম খানিকটা। চোখ দিয়ে ইশারা করলাম ঈশিতার দিকে। সে ঈশিতাকে দেখেই থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে ঠিক ভেবে পেল না৷ ঈশিতা আর দাঁড়িয়ে থাকল না৷ সে সোজা হন হন করে চলে গেল নিজের রুমে। রুমে গিয়ে বেশ জোরেই ডাকল,
-হিমেল?
হিমেল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো৷ সোজা হাঁটা ধরল রুমের দিকে। আমি খানিক শব্দ করে হাসলাম। ও একবার ফিরে তাকালো আমার দিকে। আমি আরেকটু শব্দ করে হাসলাম এবাদ। হিমেল রুমে যেতেই ওদের রুমের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এল। আমি টিভি ছেড়ে দিলাম। ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে খবর শুনতে থাকলাম। অনেকটা সময় পর হিমেল বেরিয়ে এল। চোখমুখ মলিন হয়ে আছে। গা ঘেমে গিয়েছে। সোফায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আমি বললাম,
-সবে তো শুরু। এই যে আমার সাদা চুল গুলো দেখিস নি? এগুলো এমনি এমনি পাকেনি৷ হাহাহা৷
হিমেল কোনো কথা বলল না৷ চুপ করেই থাকল। আমি ওর পাশ্ব গিয়ে বসলাম। ওর কাধে হাত রেখে বললাম,
-বি নরমাল মাই বয়!
হিমেল আর নরমাল হলো না৷ কেমন জানি হয়ে থাকল৷ কিছু নিয়ে যেন টেনশনে আছে। সন্ধ্যায়ও তার চেহারায় পরিবর্তন এলো না৷ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় দেখলাম ঈশিতা চলে গেল; হিমেল গেল না। সে সোফায় বসে থাকল। আমি বললাম,
-কী রে? ঘুমাবি না?
-এইতো বাবা যাবো। তুমি যাও৷ শুয়ে পড়ো৷
আমার কাছে মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই যেন৷ ওকে কিছু বললাম না আর৷ আমি রুমে চলে এলাম। এর প্রায় আধঘন্টা পর উঠে আমি ওকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সে নিজেদের রুমের দরজায় ঠকঠক করছে৷ কিন্তু দরজা খুলছে না। আমি ডাক দিলাম,
-হিমেল?
হিমেল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কোনো মতে বলল,
-জ্বী জ্বী বাবা!
-এদিকে আয়।
আমি সোফায় গিয়ে বসলাম। ও এসে দাঁড়াল। আমি বললাম,
-বস।
ও বসল। খানিকটা নীরাবতায় কাটল৷ তারপর হঠাৎই আমি হাসা শুরু করে দিলাম৷ আমি কী যে আনন্দ লাগছিল! বেটা বুঝো ঠ্যালা! আমাকে নিয়ে তখন কেমন মজাটাই না করতি। বললাম,
-কী শের সাহেব? বীর বলব? বীর উত্তম? হুংকারী হিমেল? হাহাহা।
ও মন মরা হয়ে বলল,
-মজা নিচ্ছো না?
-তুই নিস নি?
ও কিছু বলল না আর। আমি বললাম,
-এখন বুঝছো আমি কেন চুপ থাকি? কিছু বলতে পারি না কেন? বুঝছো?
ও মাথা নিচু করে রাখল। আমি বললাম,
-আমার বেশ হাসি পাচ্ছে। তোর ওই কথা গুলো মনে পড়ে গেল৷ নিয়ম টিয়ম নিয়ে যে কী না কি বললি! হাহাহা!
-আরে তখন কি জানতাম এমন হয়ে যাবে? দেখো না নিজের রুমেও শুতে পারছি না।
-হাহাহাহা। আমার এখন বলতে ইচ্ছে, বি নরমাল বাবা! যেমনটা তুই আমায় বলতি। হাহাহা।
হিমেল অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালো৷ আমার খানিক মায়া হলো যেন। বললাম,
-চিন্তা করিস না৷ তুই আমার ছেলে! তোর এই অবস্থা মানা যায় না। শোন, একটা কথা বলি! আমিও আসলে এমন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি৷ এর সমাধান এজ আমাকেই বের করতে হয়েছে।
-সমাধাণ আছে?
-তোর বাবার কাছে সব কিছুর সমাধান আছে। বুঝলি! শোন, মেয়ে জাতিটাই আসলে বিচিত্র প্রকৃতির হয়। তাই এদের টাইট দেয়ার জন্যে তেমনই বিচিত্র বুদ্ধির প্রয়োজন হয়৷ আমার বুদ্ধিটাও একটু বিচিত্র টাইপের।
-তাহলে বলো কী করতে হবে এখন?
-এখন তোকে এখানে চুপচাপ বসে থাক। ওই সময়ে কতক্ষণ দরজায় টোকাটোকি করছিলি?
ও নিচু স্বরে বলল
-বিশ মিনিটের মতো হবে।
-ক্ষমা টমা চাইছিলি?
-হু
-গুড। এটাই এনাফ। এখন এখানে চুপচাপ মন মরা হয়ে শুয়ে থাক। মুখটা এমন রাখবি যেন তোর খুব মন খারাপ৷ আপাতত মন খারাপ করার ট্রাই কর৷ তোকে আজ সকালে যা যা বকেছে সেগুলো মনে করে মন খারাপ করতে থাক কেমন?
ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল। আমি বললাম,
-ও যেন এটা বুঝতে পারে যে তোর ভীষণ মন খারাপ। জাস্ট এটা হলেই হবে৷ পারবি করতে?
-চেষ্টা কর।
-হু।
ঠিক তখনই মিহিনের স্বর ভেসে এল৷
-তাসফি?
আমি হিমেলের হাত ধরে বললাম,
-যেদিন ঝগড়া হবে সে রাত দেখবি বেশ ভালোই কাটবে। চিন্তা করিস না৷ এখন কেবল মন খারাপের অভিনয় কর৷
-অভিনয় করা লাগবে না৷ আমার মন এমনিই খারাপ৷
-তাহলে তো কথাই নেই৷ তোর রাতটা আরো বেশি ভালো কাটবে। আমি গেলাম৷ তোর মা ডাকছে।
এই কথা বলে পেছন ফিরতেই খট করে শব্দ হলো৷ আমি আবার হিমেলের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বললাম,
-আসছে আসছে৷ দরজা খোলার শব্দ হলো। অল দ্য বেস্ট মাই বয়।
আমি চলে এলাম ওখান থেকে। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ফ্যান ফুল স্পীডে দিয়ে বিছানায় গেলাম। মিহিন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
-কী মশাই? ছেলেকে বুদ্ধি শিখিয়ে এলে নাকি?
আমি খানিকটা অবাক হলাম। বললাম,
-তুমি জানতে ওই ব্যাপারটা?
-তোমার কোনো কিছু কি আমার অজানা? তোমার চোখ দেখলেই আমি বলে দিতে পারি তোমার ভেতর কী চলছে।
-তাহলে ব্যাপারটা জেনেও না জানার ভান করতে কেন?
-বেশি কথা বলো না৷ ঘুমিয়ে পড়ো। আর এভাবে বিছানা থেকে উঠে যেও না৷ তুমি উঠলেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়৷
-কেন ভাঙ্গে?
এই কথার জবাব ও সাথে সাথেই দিল না। কিছু সময় পর বলল,
-ঘুমাও। এত কিছু জানতে হবে না।
-আমি জানি সেটা।
-জানলেও চুপ থাকো। কথা বলো না৷ আমার ঘুম আসছে খুব।
এরপর আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। এখন আপনারা গিয়ে ঘুমান৷ ঘুমানো সময় হয়েছে। শুভ রাত্রি।