বোধোদয়

বোধোদয়

আজ আমার মেয়ের বিয়ে। আমার মেয়ে বললাম যাকে। সে ঠিক আমার মেয়ে না। আমার স্ত্রী রাবেয়ার মেয়ে। আমি যখন রাবেয়াকে বিয়ে করি। তখন রাবেয়ার আগের ঘরের এই মেয়ের বয়স মাত্র দু’বছর বয়স ছিলো। রাবেয়ার প্রথম স্বামী মারা যায় হঠাৎ করে। দুইদিনের জ্বরে। তখন রাবেয়ার মেয়ে মানে তানিয়ার বয়স মাত্র এক বছর। রাবেয়া বিধবা হওয়ার পরে ও কিছু দিন শ্বশুর বাড়িতে ছিলো। তখন শশুর বাড়ির লোকেরা রাবেয়ার সাথে খারাপ আচরণ করতো। তারা সারাক্ষণ রাবেয়া কে অপয়া বলে গালি দিতো। এবং ছোট বাচ্চা টাকে অপয়া বলতো। বলতো জন্ম নিয়েই বাপ কে খেয়েছে। অথচ রাবেয়ার শ্বশুর বাড়ির লোকরা অশিক্ষিত ছিলো না।

আসলে শ্বশুর বাড়িতে রাবেয়া কে রাখতে চাই ছিলো না। এবং রাবেয়ার শ্বশুর জীবিত থাকা কালিন ওর স্বামী মারা যাওয়ায়। ওরা রাবেয়ার বাচ্চা কেও সম্পত্তি দেয় নাই। রাবেয়ার চাচা রাবেয়াকে অনেক আদর করতো। উনি রাবেয়া কে ওনার কাছে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এবং ওনার অফিসে চাকুরী দেন।ওনার বাসায় থেকেই রাবেয়া চাকরি করতো। আমার সাথে রাবেয়ার পরিচয় একই অফিসে চাকুরীর সুবাদে। রাবেয়ার চাচা আমাদের অফিসের বস। বাবেয়া দেখতে বেশ সুন্দর ছিলো। টুকটাক কথা একটু সহমর্মিতা দেখাতে দেখাতে। রাবেয়ার সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। বসও এই বিষয় টা বুঝতে পারে এবং আমাকে তার বাসার বেশ কটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে। আমার বসের বউ রাবেয়ার চাচীর একটা ভুমিকা ছিলো। আমার আর রাবেয়ার বিয়ের ক্ষেত্রে। আমি রাবেয়ার প্রতি একটু দুর্বল ছিলাম এটাই উনি কাজে লাগান। উনি আমাকে অনেক বুঝিয়ে এবং আমার পরিবার কে রাজি করিয়ে রাবেয়ার সাথে আমার বিয়ে দেন।

বিয়ের পরে আমি একটা বেসরকারি ব্যাংক এ চাকরি পাই। আর রাবেয়া তার চাচার অফিসেই চাকরি করতো। রাবেয়ার সাথে আমার বিয়ের পরে। রাবেয়ার মেয়ে তানিয়া কিছু দিন মানে দিন পনেরো ওর চাচার বাসায় ছিলো। এর মধ্যে মা ছাড়া বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পরে। তখন রাবেয়ার চাচী খুব সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে বলে। দুধের একটা শিশু কে তার মার কোল ছাড়া করলে আল্লাহ্ও নাখোশ হবে। তানিয়া একটা ছোট বাচ্চা। তাকে তুমি তোমার সন্তান করে নাও বাবা। আল্লাহ্ একটা এতিম কে পালার জন্য তোমাকে অনেক বরকত দিবে।

তারপর থেকে তানিয়াকে আমি আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু আমার কেন জানি তানিয়াকে কখনোই ঠিক আপন মনে হতো না।মনে হতো আমি অন্যের বোঝা বহন করছি। বাচ্চাটা কিছু নিয়ে বায়না করলে বিরক্ত লাগতো। বাচ্চা কে রাবেয়া সব সময় নিজের হাতে খাওয়াতো এটাও আমার বিরক্ত লাগতো। আমি বলতাম বাচ্চা দের নিজের হাতে খেতে শেখাতে হয়। রাবেয়া আমার ছোট ছোট বিরক্তি গুলো বুঝতে পারতো। রাবেয়া সব সময়ই আমাকে অনেক খেয়াল রাখতো। বিশেষ যত্ন করতো। রাবেয়া আসলে আমার প্রতি সব সময়ই কৃতজ্ঞ ছিলো। এর দুটা কারন। এক আমি রাবেয়া কে আমার বাড়িতে বউ বৌয়ের মর্যাদায় প্রতিষঠিত করেছি। রাবেয়ার আগে বিয়ে হয়েছিল। এটা নিয়ে কেউ ওকে কখনো কিছু বলতে পারে নাই। আমার কারনে। আর রাবেয়ার মেয়ে তানিয়া আমাদের সাথে থাকে। আসলে বিয়ের আগে রাবেয়ার চাচী একবার বলেছিলো। বাচ্চা নিয়ে তোমার পরিবারে সমস্যা হলে বাচ্চা আমাদের কাছে থাকবে।

তবে এটা ঠিক আমি কখনোই তানিয়ার ব্যাপারে। কোন খরচের বিষয়ে রাবেয়াকে কিছু বলতাম না। আমি বরং ঈদের সময় বাচ্চাটার জন্য অনেক দামী জামা- জামা-কাপড় কিনে দিতাম। যখন আমাদের মানে আমার ছেলে তমাল হলো। তখনও আমি কোন কিছু কিনলে দুই বাচ্চার জন্যই কিনতাম। তবে আমি কিন্তু আমার ছেলে তমাল কে অনেক বেশি ভালোবাসতাম। আমি অফিস থেকে এসেই তমালকে কোলে নিয়ে হাটতাম। হাতে করে খায়িয়ে দিতাম। বুকের ওপরে নিয়ে শুয়ে থাকতাম। এখন মনে হয় তানিয়াকে নিয়ে এই আদর গুলো করার কেউ ছিলো না। আমি একজন বুঝদার মানুষ হয়েও একটা বাচ্চা কে এই আদর গুলো দিতে পারি নাই। শুধু এই কারনে যে,বাচ্চাটা আমার নিজের না।

আমি যখন তমালকে গল্প শুনাতাম খাটে শুয়ে শুয়ে। তখন তানিয়া আস্তে আস্তে খাটে উঠে। আমার কাছে বসে গল্প শুনতো। আর কখনো কখনো বলতো। আব্বু তুমি সব চাইতে সুন্দর করে গল্প বলো। এই কথাটা বলার পরে কি আমি কখনো মেয়েটা কে জড়িয়ে ধরে আদর করেছি? না আমার মনে পড়ছে না।মেয়েটা পড়ালেখায় অনেক ভালো ছিলো। কি সুন্দর ভালো ইস্কুলে চান্স পেয়ে গেলো একবারে। আবার প্রতিটি ক্লাসে এক থেকে পাঁচের ভেতরে রোল ছিলো। আহা যারা জানতো না যে তানিয়া আমার নিজের মেয়ে না। তারা আমাকে বলতো ভাই আপনার ভাগ্য ভালো। আপনার মেয়ে কত ভালো ছাত্রী । আপনার মেয়ের মতো এত ভালো মাথা তো আমাদের বাচ্চা দের না।তানিয়া একবারে বুয়েটে চান্স পেলো। মেয়েটা পাশ করে বের হলো। ওর বিয়ে হচ্ছে যার সাথে সেই ছেলে বুয়েটে ওর দু’ বছরের সিনিয়র ছিলো।

বিয়ের কথা যখন বলতে আসবে। তখন ওরা জানে না তানিয়া আমার নিজের মেয়ে না।এখন কথা হলো এই কথা কি আমরা ছেলের বাসায় বলবো? না বলবো না।

তানিয়ার দাদা বাড়ির কারো সাথে। আমার বিয়ের আগে থেকে এবং বিয়ের পরে কোন দিনও রাবেয়ার বা তানিয়ার কোন যোগাযোগ হয় নাই। তানিয়ার দাদা বাড়ির কেউ কখনো তানিয়া বেচেঁ আছে না মরে গেছে তাও কখনো জানতে চায় নাই। আমাকে রাবেয়া যখন বলল তানিয়ার শ্বশুর বাড়িতে কি বলবো? তানিয়ার বাবা মারা গেছে। আমার তখন কি জানি হলো আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম। রাবেয়া এটা কি বললা। তানিয়ার বাবা যদি মরে গিয়ে থাকে। তবে আমি কে?

রাবেয়া কিছুক্ষন আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে। হঠাৎ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানতে লাগলো। আর বলতে লাগলো তানিয়ার বাবা। তুমি তানিয়ার বাবা। রাবেয়ার অনেক বছরের ইচ্ছা আজ আমার মনের অজান্তেই আমি পূরণ করতে পেরেছি। আমি তানিয়ার বাবা হতে পেরেছি। আমারও দুই চোখ বেয়ে পানি পরছে। আর শুধু মনে হচ্ছে আমি আমার একমাত্র কন্যাকে বিদায় দিবো। তার পরে শুরু হলো কন্যা বিদায়ের সব আয়োজন। যা করি তাতেই মনে হয় আর একটু ভালো হলে ভালো হতো। মেয়েটা আমার এত অল্পতে খুশি হয়। বলার মতো না।

গতকাল ছিলো তানিয়ার হলুদ। গায়ে হলুূদে এখন নাকি মেয়েদের গায়ে হলুদ দিতে হয় না। আমিতো জানি না। আমি মেয়ের সামনে রাখা একটু হলুদ নিয়ে মেয়ের কপালে ছোঁয়াতেই সবাই হইচই করে ওঠলো। হলুদ দিলে মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। তানিয়া আমার হাতটা ওর গালে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর একটা কথাই বলতে লাগলো আব্বু তুমি হলুদ দাও আমার মেকাপ নষ্ট হবে না।

কান্না ছোঁয়াচে রোগ উপস্থিত সবাই চোখে পানি। তার পর এখনকার নিয়ম ভেঙে চললো হলুদ দেওয়া। সবাই সেন্টার থেকে বাসায় আসলাম। অনেক রাতে মেয়ের বন্ধুরা বাসায় চলে গেছে।আমি বারান্দায় বসে বসে চিন্তা করছিলাম। আমার অতিত। এমন সময় আমার মেয়ে দু’ কাপ কফি আর দুটা মিষ্টি এনে আমার সামনে রাখলো।আর আমার পাশের চেয়ার টায় বসলো। আমি বললাম তানিয়া ঘুমাতে যাও। সারাদিন বসে ছিলে তুমি তোমার রেস্ট দরকার। মেয়েটা আস্তে করে বলল। আব্বু তোমার পাশে একটু বসি। আমি একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। কি মনে হলো তানিয়ার মুখেও একটা মিষ্টি তুলে দিলাম।আমার কি হয়েছে? কোথা থেকে এত মায়া কান্না হয়ে বের হচ্ছে। তানিয়ার দিকে তাকাতে পারছি না চোখ ভিজে যাচ্ছে। এমন সময় তমাল আর রাবেয়া বারান্দায় চলে আসলো। তমাল এসেই আমাদের ছবি তোলা শুরু করেছে।পরিবেশ টা হালকা হয়ে গেলো।তমাল বার বার তানিয়াকে ক্ষেপাতে লাগলো এই বলে যে, তানিয়া তার হবু বরের চিন্তায় ঘুমাতে পারছে না।হঠাৎ করে ঠিকই তানিয়ার বর রাকিবের কল চলে আসে। আরতো তানিয়া লজ্জায় শেষ। আর তমাল আমাকে বলল বাবা দেখেছো আমি ঠিক বলেছিনা।তানিয়া কল রিসিভ করেই বলল রাকিব এখন কথা বলতে পাবো না। আমরা সবাই একটু একসাথে বসেছি।আমি বললাম রাকিবকে ভিডিও কলে আমাদের গল্পে যোগ দিতে বলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই যখন নাস্তার টেবিলে বসলাম। তখন তানিয়া কে নিজের হাতে নাস্তা খেতে দেখে। আজ এত বছর পর আমার ভালো লাগছিল না।বার বার মনে হচ্ছিল রাবেয়া কেন মেয়েকে নিজের হাতে খায়িয়ে দিচ্ছে না।মেয়েটার বিয়ের দিনে কেন নিজের হাতে খাবে? একসময় আমি বিরক্ত হতাম। তানিয়াকে খাওয়াতে বসে রাবেয়া দেরি করলে।আজ আমি বুঝতে পারছি আমি তানিয়ার বাবা। আর আমার মেয়ে চলে যাওয়ার পরে শুধু এই ভেবে কাঁদব। আমার মেয়ে কখন কি পায় নাই। আমার কাছ থেকে।এটাই আমার শাস্তি। মেয়ে কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলাম।আব্বু তুমি খাচ্ছো না কেন?নারে মা খাচ্ছি।

আমি তানিয়া কে বললাম। আমার চা নিয়ে আমার রুমে একটু আয়তো মা। তানিয়া আমার রুমে এসে চা দিলো। আমি বললাম আমার পাশে বস।তানিয়ার মাথায় একটা হাত দিয়ে বললাম। তানিয়া বাবা কে ক্ষমা করে দিস।তোকে কখনো কিছু দিতে পারি নাই মা।তবে আমি বেঁচে থাকতে। তোকে কেউ কখনো কোন কষ্ট দিতে পারবে না।এই কথা তোকে আমি দিলাম মা।তানিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে। বাবা এসব তুমি কেন বলছো।তুমি আমার বাবা।হঠাৎ মনে হলে দরজার আড়াল থেকে একটা ছায়া সরে গেলো।

আজ অনেক বছর পর আমার সংসারটা পূর্ণ হলো। আজ আমি পরিপূর্ণ সুখী মানুষ। রাবেয়া এই চোখ মুছে এই হাসে। আর বলে বাপ মেয়েতো মনে হয় আমাদের মা আর ছেলেকে পর করে দিয়েছো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত