দুপুর থেকেই মাথাটা ধরেছিল। সন্ধার পর তা মাইগ্রেনে রুপ নিল। মাইগ্রেন সম্বন্ধে যাদের ধারণা নেই তারা ভাবতেই পারবেন না ব্যাপারটা কি ! আমার সব সময় এরকম হয় না। কিন্ত্ত যখন হয় , তখন ইচ্ছে করে একটা কুড়াল এনে মাথাটা দুই ফাঁক করে দেই।
আজকের দিনিটা কিন্ত্ত শুরু হয়েছিল সুন্দর একটা উৎসবের আমেজ মেখে। এম্নিতেই শীতের সকালগুলোতে এক ধরণের উৎসব উৎসব ভাব থাকে। তার মাঝে আজ সত্যি সত্যি একটা উৎসবের ব্যাপার ছিল। আজ আমার সব চাইতে ছোট বোনটার বিয়ে হয়ে গেল। দীপা আমার ৯ বছরের ছোট। ৯ বছরের ছোট বোনের বিয়েতে একটা অবিবাহিত মেয়ের উপস্হিত থাকবার মধ্যে এক ধরণের গ্লানি থাকে, তার সঙ্গে উপরি ঝামেলা হিসেবে মিশে ছিল নিখুঁত অভিনয়ের টেনশন। আমাকে এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে রাখতে হবে যেন আমাকে দেখতে আসা একটা ছেলের আমার ছোট বোনকে পছন্দ করে ফেলা কোন ব্যাপারই না।এর মধ্যে অপমানিত হবার কিছু নেই। কিছু কিছু মেয়ে থাকে অভিনয়ের এক সাবলীল ক্ষমতা নিয়ে তারা এই পৃথইবীতে আসে। সুবর্ণা মুস্তফার কথাই ধরা যাক। শঙ্খ নীল কারাগারে এই ধরণের অপমানিত একটা মেয়ের ছবি উনি আমাদের দেখিয়েছেন। আমি সুবর্ণা মুস্তফা নই। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমার বারবার মনে পড়ছিল সারাটা সন্ধ্যা আমার সাথে গল্প করে ,আমার গান শুনেও এই ছেলে কি করে আমাকে পছন্দ করতে পারল না ,অথছ দীপা হাত ধুবার পানি এগিয়ে দেবার সময় এক মুহূর্তের দেখায় ওকে পছন্দ করে ফেল্ল।
ছোটবেলায় আমি একবার আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছি কুকুরের ছানা আনব বলে। বিলাতে বিলাতে ওর কাছে আছে মাত্র দু’টো। তার মধ্যে সাদা কুকুর ছানাটা অবশ্য ও রেখে দিবে। আমাকে নিয়ে যেতে হবে কালটা। এদিকে আমি সাদা কুকুর ছানাটার থেকে আর চোখ ফেরাতে পারছি না। কি যে সুন্দর দেখতে। তখনও ঠিকমত চোখ ফুটে নি। কানগুলো ঝোলা ঝোলা। খুবই ইচ্ছা করল বলি, “দেখ রত্না,কিছু মনে করিস না ভাই,আমার কাল কুকুরটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না । আমি বরঞ্চ সাদাটাকে নিয়ে যাই ।” কিন্ত্ত লজ্জায় বলতে পারলাম না । যে ব্যবহারটা আমি সামান্য একটা কুকুরের সঙ্গে করতে পারলাম না , সেই ব্যবহারটাই ছেলেটা আমার সঙ্গে করল এবং তা করল বেশ আগ্রহের সাথেই । মানুষের মধ্যে থেকে মানবিকতার ব্যাপারগুলো কি একেবারে উঠেই যাচ্ছে ,এই কথাগুলো যখন ভাবছি তখন আমার সেই রঙ্গমঞ্চে ছোটমামীর আবির্ভাব ।আমি তখন বরপক্ষের মেয়েদের খাওয়া দাওয়ার তদারক করছি। মামী বরের মার কাঁধে হাত রেখে বলতে শুরু করলেন ,” বেয়াইন, আমার এই মেয়েটার জন্য একটা ছেলে দেখবেন।
ত্রিশ বছর হয়ে গেল, এখনও বিয়ে দিতে পারলাম না ।” আর ঠিক তখনই মাথাটা ঠাস করে ধরল ।
আমি খুবই অভিমানী হয়ে জন্মেছি। অভিমান একটু কম থাকলে জীবন হয়ত অন্য রকম হত । বছর দশেক আগে এরকম এক বিয়ের কথা হল। ছেলে আমেরিকার নাগরিক । বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে । তবে ছেলের একটাই শর্ত । মেয়ের সঙ্গে একেলা বেড়াতে যাবে । তখনও বয়স ছিল কম । সুন্দর চেহারার একটা ছেলে চাইনিজ খেতে নিয়ে যেতে চাইলে না বলতে ইচ্ছা করত না । গেলাম তার সঙ্গে এক দুপুরে । সেই ছেলে বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দিল । আমেরিকা নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে এমন করে কথা বলতে শুরু করল, যেন সে কলম্বাস। আমেরিকা সেই আবিষ্কার করেছে । এ টি এম মেশিনের গল্প এমন ভাবে করতে লাগল যেন রাত বিরাতে মানুষের টাকা তুলতে পারার পুরোটা কৃতিত্ব তাকেই দিতে হবে। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে এই ছেলে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে। কিন্ত্ত আমার ধারণায় ভুল ছিল। পরদিন ভর দুপুরে আবার তার ফোন। তার নাকি খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে।
আমি কি তার সঙ্গে বিকেলে শিশু পার্কের সামনে দেখা করতে পারব। আমি বল্লাম “না”। কবিগুরু বলেছেন ,“ আশ মিটালে ফিরে না কেউ,আশ না মিটালে ফিরে।” কথাটা ঠিক নাা ।কারণ আমিও ছেলেটার আশা পুরাই নি। সেও আর কোনদিন আমায় ফোন দেয় নি। ওর সঙ্গে সেই শেষ বিকেলে শাহবাগের মোড়ে ফুচকা খেলে জীবন কি অন্য রকম হয়ে যেত ? না কি এ রকম ফুচকা সে অনেকের সাথেই খেয়েছে। কোনদিন আর জানা হবে না। আজকাল আমি এই সব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবি । কারণ এগুলো আমার কাছে আর ছোট ব্যাপার নেই । বিয়ের জন্য কোন ছেলের আমাকে পছন্দ করাটা আমার জন্য বিশাল একটা ব্যাপার । দেখতে যে আমি খুব একটা কুৎসিৎ , তা কিন্ত্ত না । যখনই সেজেগুজে রাস্তায় বের হই,দেখি সুদর্শন যুবকেরা তাকিয়ে রয়েছে আমরই দিকে । আকাশে তখন হয়ত গ্রীস্মের কড়া রোদ। দরদর করে ঘামতে ঘামতে যে সব ছেলেরা আমাকে পছন্দ করে ফেলে , তারাই আমাদের বাসায় এসে,ফ্যানের বাতাসের নিচে বসে এক গাদা নাস্তা খেতে খেতে কেন যে আমাকে পছন্দ করে না সে রহস্য কোন দিনও আমার জানা হবে না।
সাগরের দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল । আমি পড়লাম ভয়ানক অস্বস্তিতে।দরজা যে ভেজানো ছিল সেটা আমি বুঝতে পারি নি । প্রতিদিন সকালে ঠিক এই সময়টাতেই আমি সাগর আর রীনার চা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দেই । ওরা সাধারণত দরজা বন্ধ করে ঘুমায় । আজ কেন করে নি কে জানে ? আমায় দরজায় দেখে রীনা উঠে এল বিছানা ছেড়ে । বিবাহিত ছোটভায়ের দরজায় সাতসকালে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কোন আইবুড়ো মেয়েরই ভাল লাগবে না, আমারও লাগে না । আমি এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমাদের বাসাটা কামরুন্নেসা স্কুলের পাশে । একগাদা ছোট ছোট মেয়ে কমলা রঙ্গের ইউনিফর্ম পড়ে কিচিরমিচির করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে। দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যাবার কথা ।কিন্ত্ত আমার ভাল লাগল না। কি ভয়ানক এক ভবিষ্যত যে অপেক্ষা করে রয়েছে এদের কারও কারও জন্য ! এরা কি এই সুন্দর মিস্টি রোদে ভরা শীতের ছুটির সকালে একবারও অদেখা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা ভাবতে পারছেে ? ছুটির সকালে ওদের এত স্কুলই বা কিসের ? আজ কি ওদের স্পোর্টস বা পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ? ছুটির সকালের মন খারাপ ভাব নাকি দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয় না !কিন্ত্ত আমারটা হোল । আজ দীপা এসেছিল নাসিরকে নিয়ে। দুপুরের খাবার পর আমি ,রীনা আর দীপা শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম । দীপা প্রতিটা বাক্য শুরু করছিল নাসির এই, নাসির সেই। বিয়ে হয়েছে বলেই বার বছরের বড় একজনকে নাম ধরে ডাকতে হবে আমার তা মনে হয় না ।
আমি বিরক্তি চেপে ছাদে গেলাম লেপ গুলো নামিয়ে নিয়ে আসব বলে । সকালে রোদে দিয়েছিলাম । মেয়েদের পিছন দিকে একটা বিশেষ ধরণের রাডার থাকে ।কোন রকম কার্যকারণ ছাড়াই কমলা রঙ্গের রোদে ভরা এই শেষ বিকেলে আমার সেই বিশেষ রাডারটি চালু হয়ে গেল । কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাকে দেখছে । আমাদের ছাদটা তিনতলা । গায়ে লাগান রয়েছে আরেকটা তিনতলা । একমাত্র এই তিনতলা ছাড়া অন্য কোন বাসা থেকে আমাকে দেখতে পাবার কথা নয় । আশে পাশে আর কোন উঁচু বাড়ি নেই । আর ঐ তিন তলায় এক বৃদ্ধ দম্পতি থাকেন । ওদের বাসায় কোন ছেলে নেই । ওদের যে ছেলে নেই তা নয়, তবে সে দূরে কোথাও থাকে। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে সে দিকে তাকাতেই শীতল একটা শ্রোত আমার মেরুদন্ড বেয়ে নেমে এল। এত সুন্দর করে কোন ছেলেকে আমি কখনও হাসতে দেখি নি । তবে আমি নিশ্চিত এই ছেলে আমাদের বাসায় আমায় দেখতে এলে এমন মুগ্ধ ভাবে তাকাত না ।
পাঠক, আমি আমার গল্পের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এই রকম একটা জায়গায় এসে কবি গুরু বলেছেন পাঠকদের অতৃপ্তি দিতে । যদিও তিনি তার অসংখ্য গল্পের শেষে পাঠকের কৌতূহল মিটিয়েছেন । তাঁর বেলায় এক নিয়ম হবে আর আমার বেলায় ভিন্ন নিয়ম হবে ,তা কি করে হয় ? আমিও ঠিক করেছি পাঠকের কৌতূহল মিটাব ।আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে পাশের বাসার এই ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কিনা ? দেখা হলে তখনও কি সে তেমনি মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিল ? হ্যাঁ, সুজনের সাথে আমার দেখা হয় এই ঘটনার ৬ দিন পর । আমাদের বাসর রাতে । না , সুজন আমাকে নিয়ে অলস দুপুরে চাইনিজ খেতে যায় নি । আমরা প্রথম চাইনিজ খাই আমাদের বিয়ের তিন দিন পর। গেট ধরার টাকা দিয়ে। অনেকটা মাছের তেল দিয়ে মাছ ভাজার মতন।
আমি এই একটু আগে প্লেনে উঠলাম । চলেছি আমার স্বপ্নের দেশে । যেখানে আমার সব চাইতে প্রিয় মানুষটি থাকে । আমি কবিগুরুর মত প্রতিভাবান হলে আমার এই প্রবাসী স্বামীটাকে নিয়ে একটা গান লিখতাম ,যেমন তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিদেশীনি বান্ধবীকে নিয়ে। যার গান তিনি শুনতে পেতেন আকাশে কান পাতলেই। কিন্ত্ত সকলেই তো আর কবি নয়, সুতরাং আমি যা করতে পারি তা হল ভাবনা। আমার সেই ভাবনায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লেপটা ভাঁজ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নামলাম। রাতের ভাত চাপাতে হবে । কনডেন্স মিল্কের খালি হয়ে যাওয়া কৌটা দিয়ে যখন চাল মাপছি তখনই বেজে উঠল আমাদের কলিংবেল । দরজা খুলে দেখি পাশের বাসার খালাম্মা এসেছেন। কি গভীর আদরে উনি আমার থুতনি ধরে বল্লেন , “ মারে , তুই যে আমার কত বড় উপকার করলি !কবে থেকে চেষ্টা করছি সুজনকে বিয়ে দেবার। ছেলে কিছুতেই রাজী হয় না । বলে পি এইচ ডি শেষ না করে কিছুতেই বিয়ে করবে না । কত মেয়ের যে ছবি পাঠালাম।
দেশেই আনতে পারছিলাম না, তারপরে তো বিয়ে । তোর খালুর হার্ট এটাক হওয়াতে উনাকে দেখতে এল পাঁচ বছর পর ।” হার্ট এটাক রোগটাকে আমার হঠাৎ করেই খুব ভাল লেগে গেল ।মনে হল এই পৃথিবীতে আর্টারি ব্লকেজেরও দরকার রয়েছে । পাঠক আমি জানি আপনারা আমাকে খুবই স্বার্থপর একটা মেয়ে ভাবছেন, কিন্ত্ত ওর বাবার হার্ট এটাক না হলে ওকে আমি কোথায় পেতাম বলুন তো আপনারা!শীত গিয়ে আবারও শীত আসত। আমি আমার লাল লেপটা নিয়ে আবারও এই শীতে ছাদে যেতাম রোদে দিতে । তার বদলে এখন আমি চলেছি নিরুদ্দেশের পানে । এমন একটা দেশে চলেছি যেখানে কাল হয়ে জন্মানোকে এক সময় অপরাধ বলে গন্য করা হত । তারা তো আইন করে তা বন্ধ করেছে , তবে আমরা কেন পারব না ।
আমাদের দেশেও সেই দিন নিশ্চয় আসবে যে দিন ছেলেরা কাল মেয়েদের সাথে ফুচকা খেয়ে ফর্সা মেয়েগুলোকেই শুধু বিয়ে করবে না । আমরা এটা বদলাতে পারি নি, আমাদের মেয়েরা অবশ্যই পারবে । রানওয়ের লাইটগুলো মিটিমিটি করতে করতে একসময় দৃষ্টির সীমা পেরিয়ে গেল ।আমার দু’চোখ ভরে উঠল জলে । পেছনে ফেলে যাচ্ছি আমার এই ছোট্ট সুন্দর শহরটাকে । তিলোত্তমা এই নগরী তার অন্যান্য সব গোপন কথারই মত লুকিয়ে রাখবে ত্রিশোর্ধ একটি কাল মেয়ের গ্লানির।