পকেটে চল্লিশ টাকা, এতে গাড়ি ভাড়া হবে নাকি সন্দেহ। এদিকে খুদার জ্বালা তাড়া করছে পেটে। অতোকিছু না ভেবে রাস্তার পাশে বিরানির দোকানে ঢুকে গেলাম। ইস্ত্রি করা শার্ট, প্যান্ট, টাই; অফিসার অফিসার একটা ভাব আছে। বসার সাথে সাথে হোটেলবয় দু’গ্লাস পানি নিয়ে দৌড়ে চলে আসলো। পানির গ্লাস টেবিলে রাখার সাথে সাথেই ঢগঢগ করে গিলে নিলাম। আগে থেকে পানি দিয়ে পেট ভরে নিচ্ছি, যাতে করে অল্প খাবারেই তৃপ্তি আসে। হোটেলবয়: কি খাইবেন স্যার? মোরগপোলাও, কাচ্চি, তেহারি।
-তোহারি কত করে?
-১৩০টাকা, হাফ ৭০।
পকেটের যা অবস্থা তাতে করে কপালে হাফও জুটবে না। এদিকে কিছু না খেয়েও থাকা মুশকিল। ভাবতেছি এখান থেকে উঠে যাবো কিনা! বাহিরে টংঘর থেকে একটা কলা একটা রুটি খেয়ে নেই। কিন্তু এতো ভাবসাব নিয়ে বসলাম, লাস্ট একটা চেষ্টা করে দেখি।
-কোয়াটার দেয়া যায়না?
-নাহ্, প্রথমেই কোয়াটার দেইনা। আগে হাফ খান, এরপর কোয়াটার।
শেষ বারের মতো হোটেলবয়কে রিকোয়েস্ট করতে যাবো তখনি সামনে এক তরুনী এসে উপস্থিত। আমি মুখ সামলে নিলাম। হোটেলবয়ও কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সদ্য আগত তরুনীর দিকে মনোনিবেশ করলো। তরুনীর সাথে এক বৃদ্ধ রিক্সা চালক। বৃদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে তরুনী হোটেল বয়কে বললো।
-চাচা যা খেতে চাইবে চাচাকে তাই দেবে। টাকার জন্য চিন্তা করবে না।
-ঠিক আছে আফা।
-চাচা, আপনি মনমতো খেতে থাকেন। আমি বাহিরে বন্ধুদের সাথে আছি। খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন।
-আইচ্ছা আম্মা।
বৃদ্ধ চাচার কথামতো হোটেলবয় তাকে একপ্লেট তেহারি দিয়ে গেলো। চাচা আমার সামনে আয়েশ করে তেহারী খাচ্ছে। নিজের জ্বিবে লালা অনুভব করে নিজে নিজে লজ্জিত হলাম। আমি লুলুপ দৃষ্টিতে বৃদ্ধ চাচার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছি এটা চাচা লক্ষ্য করেছে। সে আমাকে বললো,
-বাজানের কি খাওয়া শেষ? আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম চাচার কথায়, এতোক্ষন তেহারীর ভীতরে মিশে ছিলাম। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নাগ দিয়ে গিলতে ছিলাম। আমতা আমতা করে বললাম,
-না, চাচা। টাকার জন্য খেতে পারছি না।
-হাহাহাহা, মশকরা করলেন বাজান? আপনাগো আবার টেকা না থাকে? আপনারা হইলেন অফিসার মানুষ। আপনাগো মেলা টেকা।
-না চাচা, মশকরা করতেছিনা। সত্যিই আমার সাথে টাকা নাই। আচ্ছা আপনি খান, আমি উঠে যাচ্ছি। বৃদ্ধ চাচা খাওয়া ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি হোটেল থেকে বেড় হতে যাবো তখনি ডাক দিলো। আমি বৃদ্ধ চাচার কাছে যেয়ে বললাম,
-কিছু বলবেন চাচা?
-বহেন বাজান, সত্যই আপনের চেহারাতে দেহা যাইতাছে আপনে না খাওয়া। বহেন আপনে। ঐ ছেড়া!! এহানে আরেকটা তেহারি দে। হোটেলবয় তেহারি দিয়ে যেতেই আমি দিকপাল ভুলে খাওয়া শুরু করে দিলাম। চিন্তাও করলাম না তেহারির টাকা কে দিবে। যতটা সম্ভব তারাতারি খেতে চেষ্টা করলাম। সেই তরুনী ফিরে আসার আগেই যেনো শেষ করতে পারি। কিন্তু প্লেটে দুমুঠো থাকতেই তরুনী এসে উপস্থিত। চাচার খাওয়া অলরেডি শেষ। আমি মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি।
তরুনী হোটেলবয়কে প্রশ্ন করলো,
-কত বিল হয়েছে? বৃদ্ধ চাচা আগ বাড়িয়ে বলে দিলো,
-দুই প্লেট তেহারী আম্মাজান, ২৬০ টেকা।
বৃদ্ধ চাচা দুপ্লেট তেহারী এটুকু সময়ের মধ্যে খেয়ে ফেলছে সেটা বোধহয় তরুনীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হলোনা। তবুও সে কোন কথা না বলে বিল দিয়ে দিলো। হোটেলবয়কে কি যেনো প্রশ্ন করলো। বয়টা আমাকে ইঙ্গিত করে কি যেনো বললো। তরুনী আড়চোখে আমার দিকে তাকালো শুধু। সুন্দরীদের আবেদনময়ী চাহনি দেখেছি, এমন ভয়ার্ত চাহনি এই প্রথম দেখলাম। মনে হচ্ছিলো আমাকে গরুর মাংসের মতো চিবিয়ে খাবে। খেয়ে দেয়ে হোটেল থেকে বেড় হলাম, এখন একটা ঘুম দিতে পারলে দারুন হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব না, দুপুর ১টায় আমার ভাইভা এক্সাম। আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি। বৃদ্ধ চাচা তার রিক্সা নিয়ে আমার সামনে আসলো।
-কই জাইবেন বাজান? লন দিয়ে আহি।
-না চাচা, আপনার কষ্ট করা লাগবেনা। আমি যেতে পারবো।
-শরমাইয়েন না বাজান, বুঝতে পারছি আপনে বিপদে পরছেন। উঠে বসেন। কই যাইবেন কন।
-মতিঝিল যাবো চাচা, ওখানে আমার ভাইভা পরীক্ষা।
-সেটা আবার কি জিনিস?
-চাকরির পরীক্ষা চাচা, পরীক্ষায় পাশ করলে চাকরি হবে।
-ওহ, আপনে পাশ করবেন বাজান। আমি কইলাম আপনে পাশ করবেন। অফিসার হইবেন।
বৃদ্ধ চাচার রিক্সায় করে মতিঝিল গেলাম। পথে মধ্যে চাচার সাথে নানাবিধ কথা হলো। চাচার গ্রামের ঠিকানা এবং ঢাকায় যে বস্তিতে থাকে সেটার ঠিকানা নিলাম। চাচার কোন ছেলেপুলে নাই, এজন্যই বৃদ্ধ বয়সে রিক্সা চালাতে হচ্ছে।
ভাইভা এক্সামের পরে আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছিলো। একবেলা কলা রুটি খেয়ে দিনপাত করতে হলো। পরীক্ষার রেজাল্টের আশায় দিনগুনছিলাম। যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি ছাড়া সেটা পূর্ন করে তবেই বাড়ি ফিরবো।
হয়তো ভাবছেন আমি খুব দরিদ্র ঘরের সন্তান। কিন্তু না, বলা গেলে সোনার চামচ মুখে দিয়েই জন্ম। আহার, বস্ত্র, বাসস্থান কোন কিছুরই অভাব ছিলোনা। অনেকক্ষেত্রে বিলাসিতাও ভর করতো। এমবিএ শেষ করেছি দুবছর হলো। এই দুবছর বেকার ঘুরেছি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি। চাকরির কোন চেষ্টাই করিনি। দুবছর শেষে যখন দেখলাম একে একে সব বন্ধুই কর্মক্ষেত্রে জয়েন করেছে তখন হুশ ফিরলো। এদিকে পরিবারের লোকদের থেকে শুনেছি নানান কথা। অকর্মা, ভাদাইম্মা সহ নানান কথা শুনতে শুনতে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পরেছিলাম। একদিন জিদ করে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসলাম।
দুমাস ধরে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেছি। এপর্যন্ত চাকরির জন্য ২০টা পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নাই। লাস্ট পরীক্ষা দিলাম বাংলাদেশ ব্যাংকে, এ্যাকাউন্টেড পদে। এটাই শেষ ভরসা। এই চাকরিটা হলে উদ্দেশ্য সফল হবে, লক্ষ্য অর্জন হবে। তানাহলে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবো। বেশী অনাহারে থাকলে ঘুম হয় ভালো, শরীর তখন দুর্বল থাকে। মেসে পরে পরে ঘুমানো ছাড়া এখন আর আমার কোন কাজ নেই। দুপুর বারোটা নাগাদ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম। উঠতে ইচ্ছে করছিলো না, আরো ঘন্টা দুই ঘুমালে ভালো হয়। কিন্তু যিনি দরজায় দাড়িয়ে সেও নাছোড়বান্দা, সমান তালে কড়া নাড়িয়ে চলেছে। আমাকে উঠিয়ে ছাড়বে। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খোললাম।
-রাতুল সাহেবকে একটু ডেকে দিবেন?
-আমিই রাতুল।
-আপনার একটা চিঠি আছে। এখানে স্বাক্ষর করুন।
চিঠির খামের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম সহ লগো। এপয়েন্টম্যান্ট লেটার। ওরা আমাকে জয়েন করতে বলেছে।
অবশেষে আমার লক্ষ্য অর্জিত হলো। কিন্তু মনে কোন খুশির ছোয়া পাচ্ছিনা। ইচ্ছে করতেছে সেদিনের বিরানির দোকানে যেয়ে ফ্রি বিরানি খেতে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ, চিঠিটা পকেটে গুজে হাটতে হাটতে চলে গেলাম সেই হোটেলে। আজ পকেটে এক টাকাও নেই। হোটেলের ম্যানেজারকে রিকোয়েস্ট করলাম বাকিতে এক প্লেট বিরানি দিতে। সে রাজি হলোনা। আমি আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখালাম, বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমি একজন বড় অফিসার। তাতেও ওদের মন গললো না। আমার কান্ডকারখানা দেখে হোটেলবয়গুলো মিটমিটিয়ে হাসতেছিলো। অগ্যতা কোন কাজ হচ্ছিলোনা দেখে হোটেলের পাশে রাস্তার ফুটপাতে বসে রইলাম।
ঘন্টাখানি ফুটপাতে বসে আছি আর ভাবছি কিভাবে বিরানি খাওয়া যায়। সামনেই জ্যামে আটকে থাকা একটা গাড়ির দিকে দৃষ্টি আটকে গেলো। গাড়ির ভিতর সেই তরুনি বসা, যার টাকায় ভাইভার দিন বিরানি খেয়েছিলাম। কোন কিছু না ভেবেই দৌড়ে গেলাম গাড়ির কাছে। যেয়ে গাড়ির গ্লাসে টোকা দিলাম। গ্লাসটা অর্ধেক নামিয়ে আমার দিকে একশ টাকার একটা নোট ছুড়ে দিলো মেয়েটা। আমি পরক্ষনেই অধিকারের সুরে বলে উঠলাম,
-আরে একশ টাকায় কি ফুল প্লেট বিরানি পাওয়া যায় নাকি?
মেয়েটা কোন কথা না বলে আরো একশো টাকা দিয়ে গ্লাস উঠিয়ে নিলো। জ্যাম শেষ হওয়াতে তাদের গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আমি আয়েশ করে বিরানি খেলাম। সেদিনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমি এতোদিন ধরে নিখোঁজ থাকাতে বাড়িতে শোকের মাতম বয়ে চলেছে। বিশেষ করে আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে বেশী। আমাকে ফিরে পেয়ে সবার যেনো প্রান ফিরে এলো। আমিও গর্বের সহিত আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখিয়ে দিলাম সবাইকে। বাড়িতে আমার মর্যাদা পূর্নপ্রতিষ্ঠিত হলো।
৬ মাস পর আম্মু ফোন করে বললো আজ যেনো অফিস থেকে দ্রুত বাসায় ফিরি। কি আর করার! আম্মুর কথা মতো বিকেল চারটের সময় বাসায় পৌছলাম। পৌছে দেখি সবাই সেজেগুজে রেডি হয়ে বসে আছে। আমাকে আর ফ্রেশ হতে দিলোনা। সাথে সাথেই তাদের সাথে করে রওনা দিতে হলো। ছোটমামাকে আস্তে করে প্রশ্ন করলাম,
– কি ব্যাপার মামা? আমরা যাচ্ছি কোথায়?
– তোমার খবর আছে ভাগনে। তোমার নামে মামলা আছে।
– মামলা মানে? মশকরা বাদ দিয়ে একটু ব্যাখ্যা করে বলো।
– গেলেই বুঝতে পারবা ভাগনে, তোমাকে জেলহাজতে বন্দি করার প্লান করেছি আমরা।
এই বলে ছোট মামা মিটমিট করে হাসতে লাগলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা। আমি আম্মুকে বললাম,
-আমাকেতো তোমরা আগে বলতে পারতে।
-আগে বললে তুই আসতি কিনা সন্দেহ আছে।
কি আর করার! গাড়িতে চুপচাপ বসে রইলাম। খানিকবাদে রাস্তা থেকে হুজুর টাইপ একজনকে উঠিয়ে নিলো। হয়তো ঘটক হবে।
মেয়েদের বাসায় ঢুকে আমরা ড্রয়িং রুমে বসলাম। মেয়ের বাবা আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। জানতে পারলাম মেয়ের বাবা আর আমার বাবা পুরোনো বন্ধু। তারা একসাথেই নেভীতে ছিলেন। মেয়েকে অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সামনে আনা হলো। আমিতো ভুত দোখার মতো চমকে উঠলাম! আরে!!! এতো সেই তরুনী। যার কাছ থেকে দু’বার বিরানী খেয়েছি। মেয়েও আমার দিকে বাঘিনীর মতো তাকিয়ে আছে। আশে পাশে মানুষ না থাকলে হয়তো ঘাড় মটকে রক্ত খেতো। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম। মামা আমাদেরকে আলাদা একটা রুমে দিয়ে আসলো কথা বলার জন্য। আমি কোন কথা বলছিনা দেখে মেয়েটাই কথা বলা শুরু করলো,
-তো, আপনি কি রাস্তায় রাস্তায় ফ্রি বিরানি খেয়ে বেড়ান? একদম জায়গামতো প্রশ্ন করে হার্টবিট আরো বাড়িয়ে দিলো সে। কোন রকমে আমতা আমতা করে বললাম,
-বিষয়টা মোটেও সেরকম না। আমি সারাজীবনে মাত্র দুবারই ফ্রি বিরানি খেয়েছি। তাও আপনার কাছ থেকেই।
-সত্যিতো? আর কোন মেয়ের কাছ থেকে খাননি তো? মেয়ের কথা রোমান্টিকতায় মোড় নেয়াতে কেমন যেনো সস্থি ফিরে পাচ্ছি। একদম দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলাম
-তিন সত্যি, আমি শুধু আপনার কাছ থেকেই বিরানি খেয়েছি। অন্য কারো কাছ থেকে না।
-ইচ্ছে আছে নাকি অন্য কারো কাছ থেকে বিরানি খাওয়ার?
-মোটেও না।
-মনে থাকে যেনো।
এই বলে আমাদের প্রাক-প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ হলো। সেদিনই আমাদের বিয়ে হলো, সে রাতেই বাসর। দু’পক্ষের কেউই দেরি করতে চাচ্ছিলো না। হোটেল থেকে প্যাকেটে প্যাকেটে তেহারি আনা হলো। বস্তি থেকে সেই বৃদ্ধ চাচাকে আনা হলো উৎসবে সামিল করার জন্য। বাসর রাতে আমার বউ নিজ হাতে ৭ প্যাকেট বিরানি গিলালো আমাকে। ফ্রি খাওয়ার মজা বুঝো এবার।