আমি আবির। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা নেই। শুধু মা আছেন। আর একটা বোন আছে। তাকে বিয়ে দিয়েছি অনেক বছর হলো। আমি এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় আছি। সেই সকাল ৮ ঘটিকায় বের হই আর আসি সন্ধ্যা ৭ টায়। সারাদিন আমার মা’টা বাসায় একা থাকে। সারাদিন এটা ওটা করে। যেমন, সকালের নাস্তা, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা, আবার দুপুরের রান্না, বিকেলে আমার জন্য কিছু বানিয়ে রাখা যাতে আমি এসে সন্ধ্যায় খাই। আবার রাতে ভাত রান্না করা সাথে থালাবাসন পরিষ্কার করা। মোট কথা আমার মা সেই সকাল ৬ টা কাজে নামে আর রাত ১০ টা পর্যন্ত কাজই করে। কোনো কাজের লোক এখন আর পাইনা। কেউ বাসায় কাজ করতে চায় না। আর যদি কেউ চায়ও তাহলে মোটা অংকের অর্থ চায়। যা এখন আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
উপরে বর্নিত কথাগুলো আমি জানতাম সবই। কিন্তু ফিল করতে পারতাম নাহ। কিন্তু কিছুদিন যাবত মায়ের ক্লান্তিমাখা মুখটা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। কিভাবে?? চালুন জেনে আসি। শনিবার, সকাল ৭ টা রান্না ঘরে, আমি গোসলটা সেড়ে মায়ের কাছে গিয়েছি দেখতে কি করছে মা। আমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখি চুলোর গরমে মা ঘেমে একাকার অবস্থা। তাও কষ্ট করে আমার জন্য ওই গরমের মধ্যে নাস্তা বানাচ্ছে। বিন্দুমাত্র কষ্টের কথা মা আমাকে বলছে না। আমি আর মাকে এভাবে দেখতে পারছি না। তাই আমার রুম থেকে দৌড়ে টেবিল ফ্যানটা এনে সেট করে দিলাম মায়ের দিকে।
– খোকা তুইও না। এটার আবার কি দরকার ছিলো??
– মা, তুমি চুপ থাকো। এই চুলোর গরমের ভিতরে কি অবস্থা তোমার। তাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছো।
– কি করবো তোকে বললাম একটা বিয়ে করতে তাতো তুই করছিস না। বউমা’টা সাথে থাকলে একটু সাহায্য হতো। গল্প করতে করতে কাজ করতাম।
– মা বললাম না আমার চাকরিটা এখনো পার্মানেন্ট হয়নি। তবে আর কিছু দিন পর হবে। তখন সবার আগেই আমি বিয়ে করবো।
– আচ্ছা বাবা বুঝলাম। এখন টেবিলে গিয়ে বস আমি নাস্তা দিচ্ছি।
– আচ্ছা আমি রেডি হয়ে আসি। টেবিলে,
– মা তুমিও বসো একসাথে নাস্তা খাই।
– খোকা আমার রুটি এখনো হয়নি। তুই খেয়ে যা আমি পরে বানিয়ে খাবো। আমার পক্ষে আর কিছু হয়তো বলা সম্ভব ছিলো না। তাও মাকে বললাম।
– নেও মা আমার হাত থেকে একটু খাও তাহলে আমি খেয়ে হয়তো শান্তি পাবো।
এরপর অনেক কষ্টে মাকে কিছুটা খাওয়ালাম সাথে নিজেও খেলাম। এরপর বুক ভরা কষ্ট নিয়ে অফিসে চলে গেলাম। সন্ধ্যা ৭.১৮ মিনিট বাসায়, মা দরজা খুলে দিলে বাসায় ঢুকে দেখি কি যেন রান্না হচ্ছে।
– মা আবার কি রান্না করছো??
– আরে তোর না পাটিসাপটা পিঠা পছন্দ তাই বানাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আস আমি দিচ্ছি। এভাবে মাকে আমি রাত ১০ টা অব্দিই রান্না ঘরে ওই গরমের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম। রাতে খাওয়া শেষে মা আমার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরলো আবার কাল সকালে উঠে একই কাজ করার জন্য।
এভাবে ঠিক রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহঃবার এমনকি শুক্রবারও একই ভাবে মা তার কাজ করে যাচ্ছে। কোনো পরিবর্তন নেই, কোনো ছুটি নেই, কোনো বিশ্রাম নেই এই অগ্নিসিক্ত রান্নাঘর থেকে। আমি যেন আর পারছিলামই না মায়ে এই অক্লান্ত পরিশ্রম দেখতে। এমনিই বয়ষ্ক মানুষ। তার উপর এভাবে টানা প্রতিদিন একইকাজ কিভাবে মানুষ করে!! হয়তো সে আমার মা। আমাকে ভালোবাসে বলেই এই কঠোর ধারাবাহিকতা সে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমিও এবার জেদ ধরেছি এই কঠোর ধারাবাহিকতা ভাঙ্গন আমি ধরাবোই। তাই একদিন শুক্রবার খুব সকালে মায়ের আগে উঠে বসে আছি। অপেক্ষায় আছি মায়ের ঘুম থেকে উঠার। হঠাৎই মা ঘুম ঘুম চোখে রান্না ঘরে যাচ্ছে। এতোটা ঘুম চোখে যে আমাকেই দেখেনি। তাও ছেলের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য অমূল্য ঘুম বিসর্জন দিয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছে।
– মা আমার ডাকে মা বেশ চমকে উঠে।
– তুই এত্তো সকালে এখানে বসে আছিস কেনো খোকা??
– তোমার কষ্টের এই ধারাবাহিকতা ভাঙ্গতে।
– মানে??
– এখানে এসে বসো বলছি। মা আমার সামনে বসলো। আমি মায়ে হাতদুটো ধরে বললাম,
– মা, এই মা শব্দটা শুনলেই বুকে শান্তি লাগে। সেই মা তুমি। নিজের সন্তানকে খুশি আর ভালো রাখার জন্য প্রতিটা দিন একই কাজ রোবটের মতো করে যাচ্ছো। কোনো বিশ্রাম নেই। কোনো পরিবর্তনও নেই। তাও বিন্দুমাত্র নালিশ করো না তুমি। তোমরা মা’রা কি সত্যিই এত্তো ভালো??
– বোকা ছেলে। নালিশ কেনো করবো। এটা আমাদের দায়িত্ব। বিয়ের সময় যখন বাবা বাড়ি ছেড়ে এসেছি তখনই স্বামী আর সন্তানের সব দায়িত্ব পালনের প্রতিজ্ঞা করে এসেছি বোকা। এ আমার দায়িত্ব। তা আমি পালন করবো না। আবার কিসের নালিশ করবো!!!
– না মা, অনেক হয়েছে এই দায়িত্ব পালন। আজ থেকে বাকি যত শুক্রবার আছে তোমার মানে আমার মায়ের ছুটি। সপ্তাহের এই একটা দিন তুমি কোনো কাজ করবে না। তোমার যতক্ষণ ঘুমাতে ইচ্ছে করবে তুমি ততক্ষণ ঘুমাবে। সকালের নাস্তা আমি বাইরে থেকে এনেছি। দুপুরে আমরা দুই মা ছেলে বাইরে থেকে খেয়ে আসবো প্লাস রাতের জন্য খাবার নিয়ে আসবো। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো এই শুক্রবার। তোমাকে শপিং করে দিবো। আর এই নিয়ম আজ থেকে চলতেই থাকবে। এমনকি আমার বিয়ের পরও। আজ থেকে প্রতি শুক্রবার বাসার সব মা কিংবা মহিলাদের ছুটি। এদিন আমরা সবাই একসাথে বাইরে ঘুরবো খাবো মজা করবো।
– সত্যিই খোকা তোর মতো ছেলে যদি সব মায়ের ঘরে হতো তাহলে তাদের আর কোনো কষ্টই হতোনা।
– হুম হবে হবে। তবে আমার পরিবারে আজ থেকে প্রতি শুক্রবার আমি মায়ের ছুটির দিন ঘোষণা করলাম।