দুপুরে হঠাৎ অফিস থেকে এসে দেখি মা রান্না করছে। এই গরমের ভিতর মা রান্না করে মার শরীরের অবস্থা খারাপ। গরমে ঘেমে সারা শরীর ভিজে গেছে। আমি মাকে বললাম,
— মা, তুমি এমনিতেই হাই প্রেসারের রোগী। তুমি কেন রান্না ঘরে আগুনের পাশে রান্না করছো? শ্রাবণী (আমার স্ত্রী) কোথায়? মা আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
~ বউমা তো তুই অফিসের যাওয়ার পর পর বাহিরে বের হলো। এখনো তো আসলো না…
প্রায়সময় এমন হয় আমি আফিস থেকে এসে দেখি শ্রাবণী বাসায় নেই আর মা সংসারের কাজ করছে। একদিন শ্রাবণীকে বললাম,
–শ্রাবণী, তুমি এখন ভার্সিটিতে পড়া সেই মুক্ত তরুণী না। ইচ্ছে হলেই বাসা থেকে বের হয়ে যাবে আবার ইচ্ছে হলে বাসায় আসবে এটা তো ঠিক না। তোমার সংসার আছে, স্বামী আছে, শ্বাশুড়ি আছে। সংসারের নানা কাজ কর্ম আছে। এইসব কাজকর্ম ফেলে রেখে তুমি তো বাহিরে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকতে পারো না আমি শ্রাবণীকে যথেষ্ট ভদ্র আর শান্তভাবে কথা গুলো বলেছিলাম। কিন্তু শ্রাবণী আমার কথা শুনে রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো,
— পিয়াস, তুমি যদি ভেবে থাকো আমার বিয়ে হয়ে গেছে দেখে আমার সব স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেছে তাহলে সেটা তোমার ভুল ধারণা। আমি সারাক্ষণ ঘরে বসে তোমাদের রান্না করে খাওয়াতে পারবো না। আমার বন্ধু বান্ধব আছে, কাজিনরা আছে, আমি ওদের কাছে যাবো ওদের সাথে সময় কাটাবো এটাই তো স্বাভাবিক আমি আর শ্রাবণীর সাথে কথা বাড়ালাম না কারণ ওর সাথে এখন কথা বাড়ালে ঝগড়া হবে। আর আমি ওর সাথে ঝগড়া করতে চাই না। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ভেবেছিলাম হয়তো ও আমায় বুঝবে এখন দেখছি ও সব সময় আমায় উল্টো বুঝে সেদিন শ্রাবণী আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
– পিয়াস একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমার জব হয়ে গেছে। আমি শ্রাবণীর কথা শুনে খুশি হতে পারলাম না। বরং অবাক হয়ে বললাম,
— আমি যা ইনকাম করছি তাতে তো আমাদের খুব ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। তাহলে শুধু শুধু তোমার জব করার কি দরকার? শ্রাবণী আমার কথাশুনে রেগে গিয়ে বললো,
– আমি এত কষ্ট করে পড়াশুনো করেছি ঘরের এক কোণে বসে থাকার জন্য না কি? আমি আমার নিজের পরিচয় চাই। আমার ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস দিতে চাই। এইসব সংসারের দিকে আমি এখন নজর দিতে পারবো না। তাই মাকে দেখাশুনো আর রান্নার জন্য আমি একটা কাজের মেয়ে ঠিক করেছি। কাল থেকে সেই মেয়েটা আসবে আমি আর শ্রাবণীকে কিছু বললাম না কারণ ওকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। ও যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই করবে যেদিন বাসায় এসে দেখি ঘরের জিনিস এলোমেলো আর মা বসে কান্না করছে। আমি মার পাশে বসে মার হাতটা ধরে বললাম,
– মা কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? মা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
~ দুপুরে খাওয়ার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার আলমারির সব জিনিস পত্র এলোমেলো। আর ঘরে কাজের মেয়েটাও নেই। তোর বাবার দেওয়া শেষ স্মৃতি হাতের বালা গুলোও কাজের মেয়েটা চুরি করে নিয়ে গেছে। শ্রাবণী বাসায় এসে সব কিছু জানার পর বললো,
– কাজের মেয়েকে ঘরে রেখে এইভাবে ঘুমালে চুরি তো হবেই শ্রাবণী কথাশুনে ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় মারি। কিন্তু নারী জাতি দেখে সম্মানের সহিত গায়ে হাত তুললাম না । আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। একটু সংসারের দিকে মন দাও। আজ চুরি হয়েছে। কাল তো অন্য কিছু হতে পারে.. শ্রাবণী আমার কথা না বুঝে উল্টো আমায় বললো,
– আমি তোমার থেকে বেশি বেতনের চাকরি করি বলে তোমার হিংসে হয়? নতুন একটা কাজের মেয়ে আনবো আর আমরা অফিসে গেলে বাহির থেকে তালা মেরে যাবো তাহলেই হবে আসলে আর কিছুক্ষণ ওর কথা শুনলে ওর গায়ে হাত তুলে ফেলতাম। তাই চুপচাপ কিছু না বলে ওর সামনে থেকে চলে গেলাম…
এখন থেকে শ্রাবণী অফিসে যাওয়ার সময় বাসায় তালা দিয়ে যায়। আমি বহুবার বলেছি তালা দেওয়ার দরকার নেই মেয়েটা আমার পরিচিত যদি চুরি করে পালিয়ে যায় আমি ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবো। কিন্তু শ্রাবণী আমার কথা শুনে নি৷ আজ বাসায় এসে দেখি আমার বাসার সামনে অনেক লোক। এত লোক দেখে কেন জানি মনের ভিতর এক ধরণের ভয় লাগা শুরু হলো। আমাকে দেখে আমার প্রতিবেশী রফিক সাহেব বললো,
~ ভাই, আপনাকে তো ফোন দিচ্ছি কিন্তু আপনি ফোন ধরছেন না। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— ভাই ফোনটা ভুলে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। কেন কি হয়ছে?
আমি বাসার ভিতরে ঢুকে দেখি মা ফ্লোরে শুয়ে আছে আর কাজের মেয়েটা পাশে বসে কাঁদছে। আমাকে দেখে কাছের মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
~ ভাইজান, দুপুরের দিকে চাচীর বুকে ব্যথা উঠেছিলো। আমি আপনাকে ফোন দিলাম কিন্তু আপনার ফোন বাসায় রেখে গেছেন।ভাবীকে একটার পর একটা কল দিলাম উনি শুধু ফোন কেটে দেন। পরে ফোন বন্ধ করে ফেলে৷ আমি বাসার বাহিরে বের হতে পারছিলাম না কারণ বাহিরে তালা মারা ছিলো। শেষে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলাম। তারপর উনারা তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকলো। কিন্তা ততক্ষণে চাচীজান আর বেঁচে নাই আমি জানি না আমার তখন কি হলো শুধু মার সামনে বসে আমি মার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলাম। ভিতর থেকে পুরো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম তাই চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হচ্ছিলো না মা মারা গেছে আজ ৩ দিন হলো। আমি বসে আছি শ্রাবণী আমার হাতটা ধরে বললো,
-পিয়াস একটু শক্ত হও। সবাইকে তো একদিন মরতে হবে৷ আমি নিচের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণীকে বললাম,
— সেদিন কাজের মেয়েটা তোমায় কতবার ফোন দিয়েছিলো? শ্রাবণী আমতা আমতা করে বললো,
– পিয়াস আমি অফিসের মিটিংয়ে ছিলাম। তাই ফোনটা রিসিভ করতে পারি নি। আমি তখন শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
–জানো শ্রাবণী, আমি বউ চেয়েছিলাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী চাই নি। আমি বলছি না মেয়েরা ঘরের বাহিরে কাজ করতে পারবে না। মেয়েরা ঘরের বাহিরে কাজ করুক কিন্তু সেই কাজটা যেন সংসারের ক্ষতি বয়ে না আনে। আজ তুমি বাসায় থাকলে হয়তো আমার মা এইভাবে মরতো না। প্রতিটা মেয়ের কাছে সংসারের গুরুত্ব অপরিসীম। সংসারের জন্য মেয়েরা অনেক কিছু ত্যাগ করে। আমার মা কিন্তু এই সংসারের জন্য নিজের সরকারি জব ছেড়ে দেন। উনি শিক্ষিত হয়েও সারাটা জীবন এই সংসারটাকে আগলে রেখেছেন।
শ্রাবণী, সব মানুষ শুধু নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য পড়াশোনা করে না। কিছু কিছু মানুষ পড়াশোনা করে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হওয়ার জন্য। একদিন সবাইকে মরতে হয় কিন্তু কেন জানি আমার মার মৃত্যুর জন্য তোমাকে দায়ী করতে ইচ্ছে করছে। আমি এখন মার কবরের পাশে যাবো। সেদিন কাঁদতে পারি নি আজ মার কবরের পাশে বসে দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলবো। বাসায় এসে তোমার মুখটা যেন আর না দেখি শ্রাবণী কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি ওর গালে থাপ্পড় মেরে বললাম,
— মার এমন মৃত্যুর জন্য আমিও দায়ী। এই থাপ্পড়টা আগে দিতে পারলে আজ আমার মা হয়তো বেঁচে থাকতো…