আজ অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো সুজিতের। কাল ছুটি তাই বেশ খানিকটা চাপ ছিলো আজ। ও যদিও অফিস কোয়াটারে থাকে কিন্তু সপ্তাহে একবার বাড়ি যেতেই হয়। মা-বাবা,স্ত্রী আর এক মেয়ে পরিবারে। চাকরির সুবাদে পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন।কিন্তু সপ্তাহ তাকে একটা দিন দেয় পরিবারের সঙ্গে মিল হতে। অবশ্য ওর স্ত্রী হিয়া বলেছিল সঙ্গে থাকবে কিন্তু ওই নেয় নি। কারন হিয়া থাকলে একটু বাড়তি ঝামেলা সঙ্গে শহরের অচেনা যায়গা তাই সঙ্গে আনেনি।
সুজিত অফিসের বাইরে বেরিয়ে দেখে আকাশে প্রচন্ড মেঘ করেছে আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও পরছে। অফিসের রুমে থেকে কিছু বুঝতে পারেনি ও আর যা কাজের চাপ ছিলো তাতে বোঝবারো কথা না। কিন্তু এখন দ্রুতো কোয়াটারে যেতে হবে যা মেঘ করেছে তাতে মনেহয় গুড়িগুড়ি ছেড়ে যখন তখন মুষলধারে নামবে। কোয়াটার অফিস থেকে পায়ে হাটা পথ একদম পাশেই মাত্র তিন মিনিট লাগে তাই তারাতাড়ি পা চালিয়ে কোয়াটারের দিকে গেলো সুজিত। পোশাক পরিবর্তন করে ছাতাটা নিয়ে কিছু খেয়ে বেড়িয়ে পরতে হবে। আজ আর বাইক নিয়ে যাওয়া যাবে না তাই বাসে করে যেতে হবে।
কোয়াটার থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালো, তখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ছাতা মাথায় দাড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নাহ্ সময় মত আজ বাস আসছে না তাই মাষ্টারের কাছে গিয়ে শুনলো প্রচন্ড জ্যামে আটকে গিয়েছে বাস তাই ও ভাবলো নাহ্ আর বাসের জন্য থেকে লাভ নেই ট্রেনে করে গেলে ভালো হবে। ট্রেন স্টেশন ওখান থেকে এক কিলো দূরে তাই ও একটা রিকশা তে উঠল । বৃষ্টির প্রকোপ আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে ছাতা কুলোতে পারেনা, ওর দুপাশ একদম ভিজে গিয়েছে, তাই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা করছে কিন্তু কিছু করার নেই ভুল করে রেইনকোট টা তো কোয়াটারে ফেলে এসেছে তাই ভিজে গেলেও কিছু করতে পারবে না। মিনিট দশের মধ্যেই ও পৌছে গেল স্টেশনে, তারাতারি ভাড়াটা দিয়েই ও ভেতরে চলে গেলো। এখন সাতটা বাজে ট্রেন আসতে তখনো এক ঘন্টা বাকি। তাই ও একটা চায়ের দোকানে বসল। স্টেশনের ভিতরের স্টল।
প্রায় চল্লিশ মিনট হয়ে গেছে ও চা-স্টলে বসে আছে এর মাঝে সেখানে এক দম্পতিও এসে কিছুটা দূরে বসেছে, ভদ্র পরিবারের মনে হয়, দেখে মনে হয় বেশ ধনী হবে। হঠাৎ স্টেশনের মাইকে ভেসে আসল “সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ আর কিছুক্ষণের মধ্যে মহানগর এক্সপ্রেস তিন নম্বার প্লাটফর্মে আসবে। ” সুজিত তারাতারি করে ওর ব্যাগ নিয়ে তিন নম্বর প্লাটফর্মের দিকে পা বারালো। হঠাৎ একটা কিছুটা দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একটি দৃশ্য দেখে ওর মনে খুব আঘাত হানলো। ওর পা যেনো আপনা আপনি থেমে গেলো। ও যে দম্পতি দের ভদ্রলোক ভেবেছিলেন তাদের এমন কাজ। ও দেখলো ঐ দম্পতি একটি বছর সাতের ছেলেকে চড় ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। সুজিত ব্যাপার টা বুঝতে না পেরে কোন এক টানে সেদিকে পা বাড়ালো। কিছুটা দূরেই এটা হয়েছে। ও ঐ দম্পতিদের কাছে গিয়ে বলল “এই যে স্যার আপনারা এই বাচ্চাটিকে মারলেন কেনো? সে কি করেছে আপনাদের? ” ঐ দম্পতি তখনো বেশ রেগে আছে তাই সুজিতের কথার উল্টো ভাবে উত্তর করল ” তাতে আপনার কি হে মিঃ এই ইডিয়েটের বাচ্চা ফকিন্নি আপনার কে হয়, যে আপনার দরদ উতলে উঠছে?
এ কথা শুনে তো সুজিত বেশ হতবাক, ” আরে আপনি একটি বাচ্চাকে মারছেন কেনো সেটা বলবেন না? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার। ” ততক্ষনে প্রায় বেশ জন সমাগম হয়ে গিয়েছে। সুজিতের কথার উপর ভিত্তি করে প্রায় সকলেই একই প্রশ্ন করতে লাগলো। তখন ঐ দম্পতি বলল বাচ্চাটা নাকি ওদের গাড়ি নোংরা করেছে। সুজিত তো শুনে তাজ্জব, এই একটু সাধারণ ঘটনার জন্য এই ছোট বাচ্চাটাকে মারল, এরা কেমন মানুষ? সুজিত কিছু বলল না কারন ও বুঝতে পারল এরা বড়লোবড়লোকের সব বেয়াদব। ও পাশে তাকিয়ে দেখে বাচ্চাটা মাথা ধরে কান্না করছে। সুজিত বাচ্চাটার কাছে গিয়ে বলল ” বাবু তোমার নাম কি ? কোথায় থাকো? ”
ছেলেটি কান্না গলায় বলল ওর নাম মধু পাশের বস্তিতে থাকে। ও আবার বলল ” তোমার বাড়িতে কে কে থাকে? ও বলল মা এক বোন আর ও থাকে। “তুমি লেখাপড়া করো না?” ও চুপ হয়ে গেল আমি আবার বললাম কি মধু তুমি লেখাপড়া করো না? তখন এই বছর সাতের ছেলের কথা গুলো সুজিতের অন্তরের দরজাতে যেনো কড়া নেরে গেল। মধুর কথাগুলো ছিল এমন আমাদের আবার পড়ালেখা। ভাত খাইতেই পাইনা ঠিক করি এতে পড়ব লেখবো কি কাকু? মায়ের খুব জ্বর দুই দিন। বোন খুব ছোট্ট তাই মা কাজ করতে না যাওয়ায় আমি কাজ করছি। বোনকে আর মাকে খেতে দিবো তো কাকু। বলেই চুপ করে গেলো মধু। সুজিত বলল তবে ওই বড়লোক তোমাকে মারল কেন মধু। মধু বলল ” কাকু আমি ওদের গাড়ির কাছ দিয়ে যাবার সময় ওদের গাড়িতে কাঁদা ছিটে গিয়েছিলো।
সুজিত তো হতভম্ব হয়ে গেলো। মাত্র এই জন্য একটা বাচ্চাকে কেউ মারে। এরা তো এক একটা কুকুর। ও বলল মধু তুই খেয়েছিস?মধু বলল না কাকু, যে টাকা হয়েছে এটা দিয়ে মা আমি আর বোনের জন্য খাবার নিবো। সুজিত বলল কত টাকা হয়েছে রে? ও বলল মেলা টাকা, ও বলল তাই? তা কত টাকা? মধু বলল কুড়ি টাকা। সুজিত শুধু তাকিয়ে আছে ওর দিকে হঠাৎ মনে হলো ওর চোখ ভিজে উঠেছে। সুজিত ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চোক মুছলো। বলল মধু তুই আমার সঙ্গে চল। ও বলল কোথায় কাকু? সুজিত কিছু না বলে ওকে কোলে তুলে নিলো। সচরাচর ও কোন বাচ্চাকে কোলে নেয় নি তবে আজ ওর মেয়ের কথা খুব মনে হলো হয়ত তাই মধুকে পিতৃ স্নেহে কোলে তুলে নিলো। মধুকে নিয়ে ও স্টেশনের কাছে একটা রেস্টুরেন্ট গেলো।
সবাই তো তাকিয়ে। রাত নয়টা বাঁজবে, ট্রেন অনেক আগে চলে গিয়েছে। কিন্তু ওর আর সে কথা মনে হলো না। মধু পেট ভরে ভাত খেলো মাংস আর ডাল দিয়ে। মধু বুঝতে শিখেছে তাই ও জানে সুজিতের মত মানুষ ও সহজে পাবে না। সুজিত মধুর মা আর বোনের জন্যও খাবার কিনে দিলো। মধু বলল, কাকু তুমি খুব ভালো, বলে একটা ফুল দিলো সুজিত কে। সুজিত বলল তাহলে এখনি বাড়ি চলে যা মধু। এগুলো তো খাওয়াতে হবে। মধু এক ছুট দিলো। তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথার ছাতাটা নামিয়ে মধুর ছুটে চলা দেখছে সুজিত। এরা একমুট খাবারের জন্য শৈশব ত্যাগ করে রাত দিন কাজ করে চলেছে একটাই লক্ষ্য এদের পরিবারকে খাওয়াতে হবে। কিন্তু এমন সমাজে এদের মূল্য ঐ বস্তির টুকাই নাম আর ধনীর হাতে মার। এই ধনীরা কখনো মূল্য দেবে কি এদের।
প্রায় মরে যাওয়া ফুল টির দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘ নিশ্বাস দিলো সুজিত। হাতে ছাতা আর ব্যাগ। আজ আর বাড়ি যাওয়া হবে না ওর কিন্তু একটা আনন্দ ওর মনে। আবার কিছু কষ্ট ও পেয়েছে।ও স্টেশনের কাছ থেকে একটা রিকশাতে উঠল। রিকশা চলছে আর সুজিত চোখ বুজে ভাবছে হয়ত কাল আবার ওর জীবন সংগ্রাম শুরু হবে, আবার কেউ মারবে কিন্তু আবার কি কেউ এগিয়ে আসবে মধুর কাছে, মধুদের কাছে। কারন এমন মধুরা পুরো পৃথিবী জুড়ে রয়েছে। কিন্তু ধনীরা কখনো এদের ভালো চোখে দেখবে না কারন এই মধুরা তো এই পৃথিবীর ধনীদের কাছে নোংরা পাতার পোকা।