শেষ বিকেলের আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে। সারা দিন উত্তাপ ছড়িয়ে আলোটা এখন স্থিমিত গাঢ় কমলা বর্ন ধারন করেছে। রহিজ মিয়া চোখের পিঠে হাত রেখে বেলা পরখ করলেন। আরো আধঘন্টার মতো সময় আছে ইফতারের আগে। আর এখন সূর্যের উত্তাপ না থাকায় আর সাথে হালকা মৃদু মন্দ বাতাসে কাজের গতি যেন এমনিতেই বেড়ে যায়। তাই কাল ক্ষেপন না করে তিনি আবার ধান কাটায় মনোযোগ দিলেন। বলতে গেলে সরকার বাড়ির কাছ থেকে বর্গা নেয়া এই জমিটুকুই তার পরিবারের একবেলা ভাতের মূল যোগানদার।তাই শরীরের শেষবিন্দু টুকোও এ জমির পিছনে ব্যায় করতে দ্বিধা করেন না।
সূর্যের আলোটা কমতে কমতে একদম নিভু নিভু হয়ে এসেছে।এখন বাড়ি না ফিরলে ইফতারে দেরী হয়ে যাবে।এদিকে সারাদিনের পরিশ্রমে শরীরের ঘাম পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। তবুও অনেক কষ্টে শরীরটাকে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন রহিজ মিয়া। মেয়েদুটো হয়তো তার অপেক্ষায় বসে আছে। মা মরা মেয়ে দুটো তার দরিদ্র সংসার টাকে এমন ভাবে গুছিয়ে রেখেছে যাতে শত অভাব থাকলেও সুখের কোন ঘাটতি হয়না।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। রহিজ মিয়া ইফতার নিয়ে বসেছেন, দুটো পেয়ারা ফালি করে কাটা,গুরের শরবত আর বাটিতে খানিকটা গমের ছাতু।আহামরি কিছু না হলেও গরিবের ঘরে এর চেয়ে ভালো ইফতার বোধহয় চিন্তা করাও অন্যায়।তাই ইফতার সামনে নিয়ে রহিজ মিয়া মেয়েদের দিকে তৃপ্তি নিয়ে তাকালেন এবং প্রান ভরে তাদের জন্য দোয়া করলেন।
ইফতার শেষ হলে ছোট মেয়ে ফুলি উঠোনে বাবার জন্য গত বর্ষায় বোনা খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে দেয়। নামাজ শেষ হলে তিনি দুই মেয়েকে কাছে ডাকেন। বড় মেয়ে রহিমা তার জন্য পান সেজে নিয়ে আসে। দুপাশে দু মেয়েকে নিয়ে বাবা রহিজ মিয়া তাদের সারাদিনের ফিরিস্তি শুনেন। একসময় রাত ঘনিয়ে আসে ক্লান্ত অবসন্ন শরীর টাকে পাটিতেই এলিয়ে দেন। মেয়েরা ও যার যার মত ঘুমাতে চলে যায়।
ক্লান্ত শরীর দুচোখ বোজে ঘুম আসে কিন্তু কিসের যেন চিন্তা চোখ দুটো আর এক করতে দেয়না। বড় মেয়েটার বয়স খারাপ হয়নি মেয়ের মায়ের ইচ্ছে ছিল জীবিত থেকে মেয়েদের সৎ পাত্রস্থ করার। কিন্তু সংসারের যে আর্থিক অবস্থা তাতে ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’। তবুও গেটু ঘটক কে বলে রেখেছেন। ছেলে পাশের গায়ের, শহরে পড়ালেখা শেষ করেছে ভালো চাকুরী পাবে নিশ্চিত কিন্তু ছেলের মায়ের আবদার ঘরে নতুন বউ আসলে তাকে সোনার গয়নায় সাজিয়ে দিতে হবে। বলতে গেলে এত ভালো ছেলের জন্য এ আবদার কিছুই নয়। তবে গেটু ঘটকের এ কথা শুনে রহিজ মিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সোনার গহনা মানেই অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার এত টাকা রহিজ মিয়া পাবে কোথায়। তবুও ঘটকের কথাও ফেলতে পারেনা তাই সিদ্ধান্ত নেই বাপ-দাদার শেষ সম্বল ভিটা বাড়িটা বিক্রি করে দিবেন। তবুও যদি মেয়েটার গতি হয়। সকাল সকাল সরকার বাড়ির উঠোনে ধানের স্তুপে দাড়িয়ে ধান মাড়ায় করতে দেখা যায় রহিজ মিয়া কে! এবছর বৈশাখী ঝড়ে অনেক ধান ঝরে পড়ায় আশানুরূপ ফলন না হওয়ার রহিজ মিয়ার কন্ঠে যেন আহাজারি ঝরে পরে। কিন্তু তার চেয়ে বেশী অবাক হয় মালিকের কথা শুনে!!
-শুনো হে রহিজ মিয়া আগামী মৌসুম থেকে তুমার আর ধান চাষ করতে হবেনা। পুবের জমিটায় ইটের ভাটা গড়বো তাই এবারই তুমার শেষ ফলন বলে দিলাম।
মালিকের কথা শুনে রহিজ মিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে। এই জমিই তার সংসার চালানোর একমাত্র সম্বল। এখন জমিটা খোয়ালে সে মেয়েদের নিয়ে খাবে কি? এদিকে বড় মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ায় গ্রামের পাচু মাতবর এর কাছে ঘর বিকিকিনির কথাও পাকাপোক্ত হয়ে আছে। আজ রহিজ মিয়ার বড় মেয়ে রহিমার বিয়ে। ছেলে পক্ষের আবদার পুরো করতে গিয়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছে। তবুও একটা মেয়ে বিদায় করতে পারছে এই ঢের।
রাত নিঝুম বরপক্ষ কনে নিয়ে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। পাচু মাতবর কে দেয়া কথা অনুযায়ী মেয়ের বিয়ের পরেরদিন সকালেই তাকে বাড়ি ছাড়তে হবে।কিন্তু মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে জানতে পারলে মেয়ের সংসারে অসান্তি হবে ভেবে রাতেই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় রহিজ মিয়া।
আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে ! হয়তো আর কখনো ফেরা হবেনা ভেবে রহিজ মিয়া শেষ বাড়ের মত নিজের কুড়ে ঘরের দিকে তাকালেন। তারপর কি ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালেন অজানার উদ্দ্যেশ্য। চাঁদের আলো ঠিকরে পরছে ঠিক যেন শেষ বিকেলে আলো দেয়া সূর্যের আভা যার কোন উত্তাপ নেই।।