প্রতিশোধ

প্রতিশোধ

প্রায় ১২ বছর পর,,,,, অতি পরিচিত মুখগুলো শেষবারের মত দেখে নিল শুভ্র । পুরানো স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ছে।সুখে দুঃখে কাটানো সময়গুলো যাদের সাথে তারা আজ নীরব চোখে শুভ্রকে বিদায় জানাচ্ছে। চারিপাশটা আরও একটু ভালভাবে দেখে শুভ্র গেট থেকে বের হল। বাইরে সোনালী রোদ চিক চিক করছে।শুভ্রর গায়ে লাগতেই কেমন অসহ্য লাগছে। বহুদিন পর আলো বাতাসের মাঝে এসে সহ্য হচ্ছেনা শুভ্রর।কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করছে। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র কয়েকদিন সে এরকম আলোর মাঝে আসতে পেরেছে। বাকি সময়টা কেটেছে অন্ধকার গুমোট বাধা একটি খাঁচায়।

পিছন ফিরে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুভ্র সামনে পা বাড়াল শরীরের চামড়ায় কেমন উদ্ভট গন্ধ হয়েছে।হাত পায়ের নখগুলো বড় হয়ে গেছে। চুলদাড়ি মিশে মুখটাই দেখা যাচ্ছেনা।পাগলের মতই পথ চলছে। আধছেড়া জামার পকেটে রাখা নুপুরটি ঝুনঝুন শব্দ করছে। মাথাটা ভীষন ব্যাথা করছে।অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তার কোমল পায়ে সবসময় পরে থাকত নুপুরটি। নুপুর পরলে মেয়েটিকে দারুন লাগত। শুভ্র নুপুরটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছে। ১২ বছর আগে লেগে থাকা রক্তের ছাপ নুপুরের রঙটা কালচে করে তুলেছে। এলোমেলো পথ চলছে শুভ্র নাহ ওই নৃশংস অতীতে সে আর ফিরতে চায় না। কিন্তু নিয়তি বারবার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অসহায় মেয়েটির রক্তমাখা মুখখানি। না শুভ্র আর সইতে পারছেনা। হয়ত পৃথীবিটা ঘুরছে না হয় সে নিজেই ঘুরছে। আস্তে আস্তে রাস্তার পাশে জ্ঞান হারাল শুভ্র।নীরব নিস্তব্দ দেহটা পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ছোট করে নিশ্বাস ফেলছে।ডানহাতের মুঠোয় নুপুরটি তখনও ধরে রেখেছে।।

১২ বছর পূর্বে শুভ্র মাত্র এইচ এস সি উত্তীর্ন হয়ে একটা সাধারন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। লেখাপড়ায় মেধাবী হওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নিজেরা সামান্য কষ্ট করে হলেও ছেলেকে ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। শুভ্রর বাবা একজন সরকারী সাধারন কর্মচারী।মাসে যে বেতন পান তিনজনের পরিবারে কোনভাবে চলে যায়। তাই শুভ্র এস এসসি দেওয়ার পর থেকে টিউশনি করে।আর শুভ্রর মা ঘরেই থাকে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাদের অনেক আশা আকাঙ্খা। শুভ্রর ভার্সিটি জীবনে প্রথম ক্লাসে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়।মেয়েটি একটু মিশুক স্বাভাবের।  তা না হলে শুভ্রর মত একটা ছেলের সাথে কেউ নিজে থেকে কথা বলতে আসে।

অবশ্য শুভ্রর আর কিছু ভাল লাগুক বা না লাগুক মেয়েটির হাসি খুব ভাল লেগেছে। খুব সুন্দর করে হাসতে পারে মেয়েটি,হাসলে গালে টোল পড়ে,তাছাড়া মেয়েটির ঠোটের নিচে  একটা সুন্দর তিল আছে।প্রথমদিন সাধারন কিছু কথা বলে বিদায় নিল দুজন। এরপর প্রায়ই সময় দুজনকে একসাথে দেখা যেত।একটা বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছে। ক্লাসে,ক্যান্টিনে,মাঠে দুজনকেই কখনও মিষ্টি আলাপ আবার ঝগড়া করতে দেখা যেত। বন্ধুত্বটা যখন গাড়ো হয়ে এসেছে শুভ্র আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়েটির উপর। ও হ্যা মেয়েটির নামটাই তো বলা হল না,মেয়েটির নাম রাত্রি। শুভ্র যে অনেকটাই দুর্বল রাত্রির উপর সেটা বুঝতে পেরে একটা অজানা ভীতি কাজ করে তার মনে। যদি মনের কথা বললে তাকে না কর না করে দেয়।মাঝে মাঝে শুভ্রর এই উদাসীনতা দেখে  রাত্রি ঠাট্টা করে বলে কি হে বালক এত অন্যমনষ্ক কেন ছ্যাকা দিল নাকি কেউ। বলেই হি হি হি করে হেসে দেয়।শুভ্র ঐ হাসির দিকে তাকিয়ে যেন আরও উদাসীন হয়ে যায়। পরেরদিনই শুভ্র রাত্রিকে মাঠের এককোনে ডেকে নিয়ে যায়।স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে উঠে ভালবাসি তোমাকে। রাত্রি শুনেও না শোনার ভান করে।

-কিছু বললে?(রাত্রি)
-না মানে হ্যা।(শুভ্র)
-কথাটা আরেকবার বল তো?
-ভালবাসি।
-কাকে?
-তোমাকে।
-এত সহজে কিভাবে ভালবেসে ফেললে।
-জানিনা।ভালবাসা তো বলে কয়ে আসে না হয়ে যায়।

রাত্রি চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কিছু না বলেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেল। ধ্যাত কেন যে বলতে গেলাম আরও একটু সময় নিলে কি এমন ক্ষতি হত। আজকে বাসায় যাওয়ার সময়ও আমাকে ডাকল না।শুভ্রও ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে রওনা হল। পরেরদিন এক অবাক কান্ড হল।রাত্রিই অবশ্য বোমাটা ফাটাল মানে সে সম্মতি দিয়েছে। শুভ্র অনেকটাই খুশিতে।খুশিতে এত উত্তেজনা বেড়ে গেছে যে কখন রাত্রির হাত ধরে ফেলেছে নিজেই জানেনা। তারপর খেয়াল আসতেই হাতটি ছেড়ে দিয়ে ভীষন লজ্জা পায়।কিন্তু রাত্রি আবার তার হাতটি শুভ্রর হাতে রাখে। এভাবেই শুরু হল এক নতুন ভালবাসা।দুজন দুজনকে অনেকটাই মানিয়ে নেয়।

শুধু যে প্রেম করে বলে আগের খুনশুটির সম্পর্কটা চলে গেছে তা কিন্তু নয়,এখনও সুযোগ পেলে ঝগড়া করে।
শুভ্রর সবথেকে ভাললাগার জিনিস হচ্ছে রাত্রির মুখের হাসি আর ওর পায়ের নুপুর। শুভ্র মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেয় নুপুর পরা পা টি।রাত্রি শুধু আড়চোখে তাকায়।এভাবেই চলছে তাদের সুখের দিনগুলো ইদানিং রাত্রি শুভ্রকে বলছে কয়েকটা ছেলে নাকি তাকে রাস্তায় ডিষ্টার্ব করে। কিন্তু তাদের কাউকে সে ঠিকমত চিনেনা।অবশ্য এটা বোঝা যায় তারা অনেক প্রভাবশালী বাপের ছেলে। বাইক নিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়।শুভ্র দু একবার এসেছে রাত্রিকে বাসায় পৌছে দিতে। তখনও ছেলেগুলো দাড়িয়ে হাসাহাসি করে, শুভ্র কিছু বলতে যাবে রাত্রি হাতটা চেপে ধরে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে।কি দরকার ওদের সাথে ঝামেলা করার।কিন্তু শুভ্রকে থামিয়ে দেয় রাত্রি,ওরা খারাপ বলে তুমিও খারাপ হবে।

শুভ্র আর কিছু বলতে পারে না। কিছুদিন পর, রাত্রি দুইদিন নিখোঁজ।শুভ্র প্রথমে ভেবেছিল হয়ত শরীর খারাপ তাছাড়া ফোনটাও অফ বোধহয় একটু অসুস্থ হয়েছে এজন্য ক্লাসে আসে নি।কিন্তু পরেরদিন ও রাত্রি আসেনি  দেখে শুভ্র ওদের বাসার দিকে রও না হয়।আসতে আসতে ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরত্বে কিছু মানুষের ভিড় দেখে শুভ্র এগিয়ে যায়। ঝাপসা হয়ে আসা দুটি চোখে একটি লাশ দেখতে পায় শুভ্র।জামা কাপড় আধছেড়া,মাথাটায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে থেতলে দিয়েছে। সারা মুখে রক্ত মাখানো। হঠাৎ পায়ের দিকে তাকাতেই চিরচেনা একটি নুপুর দেখে আতকে উঠে শুভ্র। বুকের ভিতর চিন চিন করে ব্যাথা অনুভব করে।একটা নুপুর আছে অন্যটা নেই তাও রক্ত মাখানো। শুভ্র এবার চিৎকার করে রাত্রির কাছে এসে মাথাটা কোলে রেখে পাগলের মত প্রলাপ করতে থাকে। ইতোমধ্যে রাত্রির মা,বাবা ছোটবোনটা এসে কান্নাকাটি শুরু করেছে।

কিছুক্ষন পর পুলিশ এসে লাশটা নিয়ে যায়।শুভ্র নির্বাক চোখে লাশবাহী গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নুপুরটি রেখে দিয়েছে শুভ্র।দুচোখে পানি পড়ছে কিনা জানিনা তবে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। এই সময়ের বিষাদ বা দুঃখ একমাত্র সেই উপলব্ধি করতে পারে যার কাছের মানুষ হারায়। আরও একদিন পর লাশটি কাটা ছেড়া অবস্থায় পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রিপোর্টে ধর্ষন আসেনি এসেছে আত্মহত্যা।মধ্যবিত্ত বলেই হয়ত মেশিনটাও ভুল রিপোর্ট দিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে।লাশটা দাফন শেষ। প্রায় পনের দিন পর,,,, শুভ্র আজকাল অনেকটা নিশ্চুপ থাকে।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না ভার্সিটি আসে না।সারাক্ষণ একাকীত্বে থাকে। তবে আজ সকালে একটা ধারালো ছুরি কিনে এনেছে শুভ্র।যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিয়েছে। এখন রাত দশটা,,, শুভ্র কালো পোশাক পরে ছুরিটা পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সকালে কেউ একজন খবর দিয়েছে ঐ শয়তানগুলো একটা পুরানো বিল্ডিংএ রাত্রে নেশা করে। তাই দ্রুত পায়ে শুভ্র এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে।

ঐ তো সেই চারজন।মদ্যপান করছে।শুভ্র একটা লাঠি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। আস্তে আস্তে কাছে এসে পড়েছে ওরা এতটাই নেশাগ্রস্থ যে বুঝতেই পারেনি কেউ একজন এসে দাড়িয়েছে।ওদের ভিতর একজন শুভ্রকে দেখে চিৎকার করতে যাবে এমন সময় সজোরে মাথায় আঘাত করল শুভ্র। তারপর সবকিছু অন্ধকার।। সকালে সবাই বলাবলি করতে লাগল কে একজন চারটি যুবককে গলা কেটে হত্যা করেছে। শুভ্র একরাশ ঘৃনা নিয়ে থুথু ফেলে একটা রহস্যের হাসি দেয়। জীবনটা এখানে থেমে থাকেনি শুভ্র নিজে থেকেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে। বিচারে ১২ বছরের জেল হয়।জেলে থাকাকালীন অবস্থায় শুভ্রর বাবা মারা যান। এত বড় একটা আঘাত শুভ্রকে একেবারে পাগলের মত বানিয়ে দিয়েছে।।

বিকেল হয়ে এসেছে।শুভ্র হাতে পায়ে সাড়া এসেছে।আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে উঠে পড়ল । তারপর হাটতে লাগল।চেনা পথগুলো ভীষন অচেনা আজ।বাচ্চাগুলো পাগল পাগল বলে পিছু নিয়েছে। অবশেষে সেই মায়ের সামনে এসে দাড়াল শুভ্র।চোখের পানিতে মা তার ছেলেকে ঠিকই চিনে বুকে টেনে নিল। শুভ্র বাসায় এসেছে চারদিন।চুল দাড়ি ছাটিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে চিনতে অনেকটা কষ্ট হচ্ছে। তবু প্রিয় মানুষটির মুখটা এখনো রঙিন।তাই তো রোজ বিকেলে ছাদে উঠে নুপরটি হাতে নিয়ে সীমাহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।খুব জোরে বলতে ইচ্ছে করে আমি পেরেছি তোমার প্রতিশোধ নিতে।।।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত