ঘুম থেকে উঠেই লাবনী আয়নায় গালের দাগটা দেখো নিলো। কাল রাতের থেকে কিছুটা হলেও ফোলা কমেছে। কিন্তু গলায় নখের আঁচড়ের দাগ এখনো বোঝা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি সামনে থেকে পাউডারের বোতল নিয়ে গলায় মেখে নিলো। হ্যাঁ এখন কিছুটা হলেও বোঝা যাচ্ছে না। ফিরে আসবার সময় আবারো একবার দেখে নিলো নিজেকে। ভালো ভাবে লক্ষ্য না করলে কেউ বুঝতেই পারবে না।
ঘরের দরজা খুলেই রান্নাঘরে চলে গেলো শ্বশুর শাশুড়ির জন্য চা বানাতে। তাদের ঘরে চা দিয়ে এসে এবার গেলো নিজে দুই বাচ্চার ঘুম ভাঙ্গাতে। সকাল নয়টায় ওদের স্কুলবাস। তাড়াতাড়ি করে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করে দাঁড়িয়ে রইলো স্কুলবাসের অপেক্ষায়। বাচ্চাদের স্কুলবাস গেলে আবার এসে সংসারের কাজে মন দিবে।
রাতুলের অফিস দশটায়। রাতুল লাবনীর স্বামী। উচ্চশিক্ষিত ভদ্র ছেলে। ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরী করে। মাসে মোটা অংকের মাইনে পায়। প্রত্যেকদিন রাত করে অফিস থেলে বাড়ি ফিরে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যাস। স্বামীর জন্য টি টেবিলে কফি রেখে রান্নাঘরে গেলো রান্না করতে।
বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে হয়েছিল লাবনীর। স্বামীর স্বাংসারে এসে সব পেয়েছে লাবনী। গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা কোনো কিছুরই কমতি নেই রাতুলের। কিন্তু সুখ! সুখ পেয়েছে কি? গতকাল রাতেই তো রাতুল যখন বাথরুমে গেলো ফোনে একটা মেসেজ এসেছিল ওর। লাবনী চেক করে দেখল প্রিয়া নামে কেউ একজন মেসেজ দিয়েছে। লিখেছে ” আজ একটু থেকে গেলেই পারতে। বাসায় কি আছে এমন যার জন্য প্রত্যেকদিন সেখানে যেতে হয়?”।
লাবনী প্রশ্ন করেছিল রাতুলকে মেয়েটা কে। রাতুলের মোবাইল ধরেছিল বলেই রাতুল লাবনীর গায়ে হাত তোলে। দুহাত দিয়ে গলা টিপে ধরে বলে, ” আর যদি কখনো আমার ফোন ধরিস তাহলে গলা টিপে মেরে ফেলবো।” আর কিচ্ছু বলার সাহস হয়নি লাবনীর। চুপচাপ সয়ে গেছে। এমন ঘটনা এবারই নয়। এর আগেও অনেকবার হয়েছে।
লাবনী অনেকবার ভেবেছে বাবা মাকে সব খুলে বলবে। কিন্তু বাবার যে শরীর। কিছুদিন আগেও স্ট্রোক করেছিল। একমাত্র মেয়ের সর্বনাশ কি মেনে নিতে পারবে?
সারাদিন মানুষটা বাইরে গিয়ে থাকে।কার সাথে যায় কি করে এসব কি একজন স্ত্রীর খোঁজ নেওয়া উচিৎ নয়? স্ত্রী কি শুধু সংসার দেখার জন্য?
চারপাশে মানুষজন লাবনীকে অনেক সুখী মনে করে। ও প্রায় মানুষদের কাছে শুনে, “লাবনী তুমি তো অনেক সুখী ” ও এসব শুনে মুখে মুখে হাসে আর ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
রাতে লাবনী আর রাতুল পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। মাঝরাতে রাতুলের ফোনের শব্দে লাবনীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রাতুল ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। এদিকে লাবনীর চোখ ভিজে উঠলো। কি আছে ঐ মেয়েটার মাঝে যা আমার মাঝে নেই! আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে লাবনীর।
বিছানার উপর উঠে বসল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর রাতুল ফিরে এলো। এসেই লাবনীকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো।
বলল,” কি ব্যাপার? জেগে আছো কেন?”
কাঁপা কিন্তু শক্ত কণ্ঠে লাবনী বলে উঠলো,
“প্রশ্ন তো আমার করার কথা। এতো রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা কার সাথে এতো কথা তোমার? ”
রাতুল বলল, ” আমার যার সাথে ইচ্ছা যতক্ষণ ইচ্ছা আমি কথা বলবো। তাতে তোর কি?”
– “আমি তোমার স্ত্রী। আমার জানার অধিকার আছে। কে আমার সংসার ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে?”
কাছে এসে শক্ত হাতে লাবনীর গাল চেপে ধরলো রাতুল।
-” আমি কি করি না করি এসবের মাঝে নাক গলাতে আসলে এক্কেবারে খুন করে ফেলবো।”
-” করে ফেলো খুন। এভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো।” চিৎকার করে বলল লাবনী।
লাবনীর চিৎকার শুনে আরো রেগে গেলো রাতুল। এলোপাথাড়ি মারতেই থাকলো লাবনীকে।
প্রচন্ড আঘাতে ঠোঁট কেটে গেলো।
তবুও থামলো না রাতুল।
লাবনী প্রচণ্ড শক্ত একটা মেয়ে। এতো আঘাত পেয়েও একটা টুঁ শব্দও করে নি।
শুধু নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছে।
একসময় ক্লান্ত হয়ে রাতুল নিজেই ওকে ছেড়ে দিলো।
তারপর চুলের মুঠি ধরে বলল,
“শোন চুপচাপ থাক।
আমি তোকে আর তোর সন্তানদের
রাজার মতো রাখবো। কিন্তু আমার কোনো কাজে নাক গলাতে আসবি তো লাথি দিয়ে তোকে আর তোর বাচ্চাদের রাস্তায় ফেলে দেব।
তখন দেখবো কি করতে পারিস।
এতো যে বিলাসিতা করছিস? কার টাকাতে করিস একবার ভেবে দেখেছিস? ”
বলেই লাবনীকে এক ঝটকায় ফেলে দিলো, যেন লাবনী একটা ছেঁড়া আর বাতিল বস্তু।
তারপর বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
সারারাত নিঃশব্দে কেঁদে গেলো মেয়েটা। আওয়াজ করতেও যেন খুব ভয় তার।
ভেবে গেলো তার সন্তাদের কথা। রাতুল যদি তাকে সত্যিই বের করে দেয় তবে কোথায় যাবে সে?
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনো যোগ্যতাই যে তার নেই।
তার বাবা মা মেয়ে নামক বোঝাটাকে ঘাড় থেকে ফেলার চিন্তায় একবার এটা ভাবেন নি এই বোঝাটাকে একটা খুঁটিতে পরিণত করা যাক।
ভোর হলো। নতুন একটা সকাল এলো। লাবনী আবারো নিজের ক্ষতগুলো ঢাকলো ভারী প্রসাধনীর আড়ালে।
আর মনের ক্ষতগুলোগুলো নিয়ে চিন্তা নেই। ভাগ্যিস সেগুলো দেখা যায় না।
কাঁটা ঠোট দেখে শাশুড়ির প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো ছোট্ট একটা লজ্জার অভিনয় করে। শাশুড়িও আর জিজ্ঞাস করলেন না। মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসলেন তার পুত্র আর পুত্রবধূর সুখের সংসার এর কথা ভেবে।
দিনের পর দিন এভাবেই প্রসাধনীর আড়ালে ঢেকে রাখা নিজের আসল চেহারাটাই ভুলে থাকতে লাগলো লাবনী।
নিজের সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ যে দিতে হবে তাকে।
নিজের জন্ম দেয়া মেয়েটাকে যে একটা শক্ত খুঁটিতে পরিণত করতে হবে তাকে।
যেন ওর মেয়েটাকেও অন্যের ঘরে গিয়ে এমন নিখুঁত অভিনেত্রী না হতে হয়।
যেন সে নিজের উপর সকল অন্যায় অবিচার চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানান দিতে পারে।