লিখতে গিয়ে কলম থেমে যায়,ভাবতে গিয়ে ভাবনার ঘোরে হারিয়ে যাই। তুমি সে এক ছোট্ট শব্দ “মা।” বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।প্রকৃতির এ এক মায়াবী রূপ।সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসে গেলাম জানালার পাশে।গল্প আমাকে লিখতে হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ ভেবেও লেখার মতন কিছু পাচ্ছি না।
আম্মু প্রথম থেকে সেটা খেয়াল করে একপর্যায়ে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন “কি করো?” আমি কিছু একটা লেখার ভান করে জবাব দিলাম “গল্প লেখি।” আম্মু খাতার দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন “কই কিছু তো লেখো নাই।” জবাবে কি বলবো না বলবো ভেবে একটা মিথ্যা বলে দিলাম “দুই পৃষ্টা লেখা শেষ।এটা অন্য পৃষ্টা।” আম্মু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন “কই দেখি?দেও একটু পড়ি।” এবার উপায় না পেয়ে বললাম “লেখা শেষ হলে পুরোটা পইড়েন।” আম্মু কিছু বললেন না।চুপচাপ পাশে এসে বসলেন। এরপর কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন “লেখক হওয়ার স্বপ্ন?” জবাবে “হ্যা” সূচক মাথা নাড়লাম।
“অনেকের অনেক স্বপ্ন থাকে।তোমার স্বপ্ন একটু আলাদা।সমস্যা নেই।কিন্তু লেখক হতে গেলে অনেক কিছু জানতে হয়।এবং কখনো এমন কিছু লিখবা না,যার জন্য সমাজ তোমাকে নিচু চোখে দেখে।তাছাড়া আমিও লেখালেখি করতাম একসময়।” “আপনি?” “হুম।ডায়েরি ভরা কবিতা উপন্যাস থাকতো।পড়ার ফাঁকে যখন সময় পেতাম লিখতে বসে যেতাম।বিয়ের পরেও লিখেছি মাঝেমাঝে।কিন্তু তুমি হবার পর আর হয়ে উঠেনি।” “মানা যায়?আমি আপনার একটা বিশেষ গুণ পেয়েছি।” “হুম,এখন শুনো।বৃষ্টি থামলে সোজা নামাযে যাবা।নামায শেষে বাসায় ফিরবার সময় লাচ্ছি সেমাই আর কিসমিস নিয়ে ফিরবা।”
“ওয়াও!সেমাই রান্না করবেন”
“হুম।”
“তাহলে এখন যাই নামাযে?”
“না বৃষ্টি থামুক।”
“আমার যেতে ইচ্ছা করছে।”
“চুপচাপ বসে থাকো।”
আম্মুর কথা শুনে কিছু বলার সাহস পেলাম না।হাত-পা গুটিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে বাহির থেকে চিল্লাচিল্লি শব্দ শুনা গেলো।জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এক দল তরুণ ফুটবল খেলছে। তাদের আনন্দ দেখে নিজেকে আর থামিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। নিচু স্বরে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলাম “আমি ওদের সাথে খেলতে যাই?” আম্মু চোখ গরম করে তাকালেন।তাঁর তাকানো দেখে মনে যাও বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছা শক্তি ছিলো তাও মিটে গেছে। অপরদিকে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। নিম্নচাপ না হলে এরকম টানা বৃষ্টি সম্ভব নয়।
আম্মু বৃষ্টি থামার কোন সম্ভাবনা না দেখে বললেন “আজ গোসল করতে হবে না।ওজু করে নামায পড়ে নাও।”
আমি জবাব দিলাম না। সোজা গোসলখানায় চলে গেলাম। মন বড্ড খারাপ হয়ে আছে।সামান্য বৃষ্টিতে ভিজতে আম্মু সম্মতি দিলেন না। ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে ওজু করে নামায পড়ে নিলাম।মাথা থেকে তখনো বৃষ্টিতে ভিজার ইচ্ছা যায়নি। অবশেষে আম্মু মন খারাপ বুঝতে পেরে বললেন “তুমি বড্ড জেদি।” আমি হালকা মাথায় নাড়ালাম। আম্মু তখন হাসি মুখে বললেন “আচ্ছা যাও।কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবা।আর সাবধান,ফাঁকা কোথাও দাঁড়াবা না।আকাশের অবস্থা ভালো না।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।” উত্তর দেওয়ার সময় যেন আমার হাতে নেই।কিছু না বলে দৌড়ে বাহিরে চলে এলাম। তারপর অনেক সময় জুড়ে ফুটবল খেললাম। তবু মন ভরেনি।অবশেষে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ভিজলাম। ততক্ষণে সময় হয়তো দুঘণ্টা পাড় হয়ে গেছে।তবে খুব একটা ক্লান্তি আসেনি। বৃষ্টির এ এক দারুণ ক্ষমতা।মানুষ যত ক্লান্তিকর কাজ করুক না কেন।খুব সহজে ক্লান্ত হয় না।
শরীর দুর্বল লাগলে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।অথচ আজ কিছুতে ঘুম আসছে না।মাথা কেমন ভার ভার লাগছে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। অবশেষে অসহ্যরকমের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আম্মু বলে কয়েকবার ডাক দিলাম। আম্মু সাথে সাথে এসে জিজ্ঞাসা করলেন “কি হয়েছে?” আমি খুব কষ্টে জবাব দিলাম “মাথা ঘুরাচ্ছে।ঘুমাতে পারছি না।” মুহূর্তে আম্মুর মুখ শুকিয়ে গেলো। তাড়াহুড়া করে মাথায় হাত দিয়ে বললেন “জ্বর উঠতেছে।আমি জানতাম এরকম কিছু হবে।” এবার আর কিছু বলার থাকলো না।চুপচাপ শুয়ে রইলাম।ধীরেধীরে দুর্বলতা আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আম্মুর চিন্তাও যেন দুর্বলতার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু উপায়! রাত প্রায় দশটা বাজে। গ্রাম অঞ্চলে দশটা মানে গভীর রাত। এই সময় কোন ডাক্তার পাওয়া যায় বলে মনে হয় না।আম্মু সেটা খুব ভালো করে জানেন। অপরদিকে বৃষ্টির বেগ কমলেও পুরোপুরি থেমে যায়নি।টিপটিপ করে ঝরবার তালে আছে।
এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ বিচলিত হয়ে পড়বে।কিন্তু আম্মুর বেলায় তা ঘটেনি।তিনি মনস্থির করে মাথায় কাপড় ভিজিয়ে পানি পট্টি দিলেন।এরপর গামছা ভিজিয়ে শরীর হালকা মুছে দিলেন। এবার কিছুটা ভাললাগছে।কষ্ট কম হচ্ছে। তবে আম্মু থেমে নেই।আমার হালকা ভাললাগা দেখে আব্বুর নাম্বারে ফোন করলেন। আব্বুর ফোন রিসিভ করার পর আম্মু আমার পুরো ব্যাপার বললেন।ওপাশে আব্বু কি জবাব দিলো জানিনা।কিন্তু আম্মু ফোন কেটে আমাকে শুয়ে থাকতে বলে বের হয়ে গেলেন। বৃষ্টির মধ্যে অসময়ে আম্মুর বের হয়ে যাওয়া কেমন চিন্তায় ফেলে দিলো আমায়। তবে বয়সের স্বল্পতায় তখন তেমন কিছু বুঝতে পারিনি।
পনের মিনিট পর এক আন্টিকে সাথে করে আম্মু ফিরলেন। আন্টি এসে খুব মিষ্টি কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “এখন কেমন লাগছে বাবা?” আমি চোখ ওপর দিকে তুলে একনজর আন্টির দিকে তাকালাম।তারপর জবাব দিলাম “ভালো।” আন্টি আবার জিজ্ঞাসা করলেন “তুমি নাকি খুব দুষ্টু?” আন্টির কথা শুনে এত কষ্টের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেললাম।আমার হাসি দেখে আম্মুর মুখে কেমন উজ্জ্বলতার ছাপ ভেসে উঠলো।
আম্মু আন্টির উদ্দেশ্য করে বললেন “এখন জ্বর কত আছে?” আন্টি জবাবে বললেন “১০২ ডিগ্রি।তবে চিন্তার কোন কারণ নেই।আমি ওষধ দিয়ে দিচ্ছি।ইন-শা-আল্লাহ কালকের মধ্যে জ্বর সেরে যাবে।” “রাতে কি মাথায় পানি ঢালবো?” “এন্টিবায়টিক দিয়ে দিচ্ছি।মনে হয় না পানি ঢালার প্রয়োজন পড়বে।তবে পানি পট্টি দিতে পারেন।” “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” “যাইহোক,ছেলের নাম কি?” “রফি।” “বাহ্!খুব সুন্দর নাম।” “হুম,এবার চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।” “না থাক।আমি একা যেতে পারবো।” এরূপ আরো কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর আন্টি চলে গেলেন।
আম্মু আমায় উঠে বসতে বললো।তবে দুর্বলতার কারণে তাও পারলাম না।অবশেষে আম্মু মাথার নিচে হাত দিয়ে হালকা উঠিয়ে ওষধ খাইয়ে দিলেন। ওষধ খাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো।চোখে ঘুম ঘুম লাগছে। আম্মু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।একপর্যায়ে চোখ আর খোলা রাখতে না পেরে ঘুমিয়ে গেলাম। তবে ঘুমের মধ্যে কয়েকবার জেগে উঠেছি।প্রতিবার দেখেছি আম্মু পাশে।কখনো অশ্রু চোখে।কখনো বা চিন্তা মাখা মুখে।তবে কোনবার ক্লান্ত দেখিনি তখন থেকে একটা বিষয় খুব ভালভাবে বুঝতে পারেছি। মায়েরা কখনো ক্লান্ত হয় না।