ওদের প্রথম ঈদ

ওদের প্রথম ঈদ

এবারের ঈদ রাশেদের কাছে অন্য বারের তুলনায় একটু বেশিই আলাদা।তার দুটো কারণ আছে।এক হচ্ছে বিয়ের পর এবার রাশেদের প্রথম ঈদ আর দুই ওর স্ত্রী পোয়াতি।হঠাৎ করেই যেন রাশেদের জীবনটা বদলে গেল।বদলটা আসলে সুমাইয়াকে বিয়ে করার পরই ঘটেছে। সুমাইয়াকে বিয়ে করার পর খুব চিন্তায় ছিলো রাশেদ কিভাবে সংসার সামলাবে।ঢাকায় ছোট্ট একটা চাকুরী করে তার উপর গ্রামে মা-বাবা আর ছোট দুই বোন।একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে দারোয়ান রাশেদ।

কিন্তু বয়সটাও হয়েছিলো ভালই তাই এক প্রকার মায়ের জোরাজুরিতেই বিয়েটা করেছিল।কিন্তু সব সময় আর্থিক চিন্তাটা মাথায় ঘুরতো রাশেদের।কিন্তু সুমাইয়ার কথায় আর আচরণে রাশেদ খুবই সন্তুষ্ট।মেয়েরা যে শুধু টাকা টাকা করেনা তা সুমাইয়াকে বিয়ে করার পর বুঝেছিল রাশেদ।কিন্তু চাইলেও সুমাইয়াকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।সংসারের খরচ সামলিয়ে ঢাকায় বউ নিয়ে থাকা ওর কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুনা। অবশ্য সুমাইয়াও কোন অভিযোগ করেনি এ নিয়ে।গ্রামের মেয়ে তার নাকি গ্রামই ভাল লাগে।তবে একবার বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল।রাশেদ বলেছে বাচ্চা হোক একটু বড় হোক তারপর নিয়ে যাবে।

এদিকে রাশেদ বাড়তি কিছু টাকা যোগাড় করেছে।সামনে ওর একটা বোনের বিয়ে।ছেলে পক্ষ কিছু টাকা চেয়েছে।রাশেদ গ্রামের ছেলে হলেও কখনো যৌতুকের পক্ষে না।সে নিজেও বিয়ের সময় সুমাইয়ার বাড়ি থেকে এক টাকাও নেয়নি। কিন্তু ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলে পক্ষকে টাকা দিতে রাজি হয়েছে।মায়ের এক কথা ছেলেটা ভাল বংশের আর তোর বোনের গায়ের রংটাও কালো বাবা তাই আমাদের একটু মানিয়ে মতে হবে।রাশেদ সমাজের কিছু নিয়ম-কানুন আজও বুঝে উঠতে পারেনা।

মাঝে মাঝে ওর নিজেকে বড় অসহায় লাগে।দরিদ্রতার অভিশাপে দুমড়ে মুচড়ে যায় রাশেদ।এবার ঈদে সবার জন্যই কেনাকাটা করেছে রাশেদ।শুধু নিজের জন্যই কিছু কেনা হয়নি।কিভাবে কিনতো এত বাড়তি খরচ সামনে।সুমাইয়ার শরীরটাও নাকি আজকাল ভাল যাচ্ছেনা।সদর হাসপাতালে এক মহিলা ডাক্তার দেখিয়েছে।নানা রকম ওষুধ দিয়েছে।মাসে মাসে সেসব ওষুধ কিনতে হচ্ছে, বোনের বিয়ের টাকা জমাতে হচ্ছে। তার উপর এই রোজায় সব কিছুর আকাশছোঁয়া দাম।ঠিকমত না খেয়ে রোজা রাখতেও রাশেদকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে রাশেদ।

ঈদের আর মাত্র ছয়দিন বাকি।এখনো ছুটি পায়নি রাশেদ।আর পাবেই বা কি করে দারোয়ানের চাকরিতে কি ছুটি থাকে!বরং সবার ছুটি হলেও ওদের ছুটি হয়না। অনেক বলে কয়ে তিনদিনের ছুটি যোগাড় করেছে।পোয়াতি সুমাইয়ার কোনো সাধ-আহ্লাদ সে পূরণ করতে পারেনা।ক’দিন যাবত রাশেদের নিজের শরীরটাও ভাল নেই।গা কাপিয়ে জ্বর আসছে রাত করে।তবুও জ্বর নিয়েই কাজে যায়।অপেক্ষায় আছে ক’টা দিন পর শুধু বাড়ি ফেরার।ওদিকে সুমাইয়াও দিন গুনছে কবে রাশেদ ফিরবে। কত কথা জমিয়ে রেখেছে ওকে বলার জন্য।রোজ নিয়ম করে কেনা জিনিসগুলোর ওপর চোখ বুলায় রাশেদ।মনে মনে ভাবে এসব পেলে কতই না খুশি হবে ওর পরিবারের লোকজন।সবার হাসিমাখা মুখ কল্পনায় আঁকে রাশেদ।ওদিকে সুমাইয়া রোজ ফোনে জিজ্ঞেস করতে থাকে,সময় কেন ফুরায় না গো!রাশেদ যা যা পছন্দ করে সব কিছুরই আয়োজন করে রেখেছে সুমাইয়া।এভাবেই প্রতীক্ষায় দু’চোখে স্বপ্ন বুনে রোজ ঘুমাতে যায় ওরা।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিন আসে।খুব ভোরে জ্বর নিয়েই রাশেদ বেরিয়ে পড়ে।কিন্তু রাস্তা পার হবার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় আর তখনি ট্রাকটা ওর ওপর দিয়ে চলে যায়।ব্যাগভর্তি আনন্দগুলো বন্দী হয়েই রক্তে ভেসে যায়।ওদিকে সকাল থেকে তীব্র পেটেব্যাথ্যা নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি সুমাইয়া।ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা খুবই আশংকাজনক।এমনিতেই গর্ভের বাচ্চার মাস পুরো হয়নি তার উপর প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে হয়তো বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না।

সুমাইয়াও লড়ছে জীবন-মৃত্যুর সাথে।কিছু লোক রাশেদকে তুলে হসপিটালে নিয়ে গেছে তবে মাথায় গুরুতর প্রচন্ড রকমের গুরুতর আঘাতে ডাক্তার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।ওরা জানেনা কি আছে ওদের ভাগ্যে।ওদের বিয়ের পরের প্রথম ঈদটা ওরা একসাথে করতে চেয়েছিল।কিন্তু ওরা লড়ছে জীবনের সাথে।আদৌ প্রাণ ফিরে পাবে তো ওরা!ওদের প্রথম ঈদ আর এত এত স্বপ্ন নিয়ে সাজানো মুহূর্তগুলো যেন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।ওদের শেষ দেখা হবে কিনা তাও জানা নেই।ঈদটা বোধহয় আর এলোনা ওদের জীবনে খুশি নিয়ে।সব শুরুর আগেই হয়তো থেমে গেল চুপিসারে। প্রথম ঈদটা কি এভাবেই শেষ ঈদ হয়ে যাবে ওদের জীবনে..!!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত