এগারো বছরের জাহিদ দৌড়ে এসে মাকে বলতেছে, মা ও মা আমি জলিল্লারে মাইরা ফালাইছি। মা রোকসানা তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বাহির হয়ে ছেলের মুখে হাত দিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। চৌকিতে বসে রোকসানা আবার জিজ্ঞেস করে, কী কইলি তুই? আবার ক’তো? জাহিদ চিৎকার দিয়ে বলে, আমি জলিল্লারে একেবারে মাইরা ফালাইছি। রোকসানা ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের মাথায় হাত দিয়ে ধাপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। জাহিদও মায়ের পাশে বসে একনাগাড়ে বলতে থাকে, মা তুমি এমন চুপ হইয়া গেলা কেন? তুমি কও জলিল্লারে মাইরা ভালো করছি না? আমি তো এক পাপীরে মারছি মা। তুমি খুশি অওনাই? রোকসানার চোখ দিয়ে শুধু অনরবত পানি পড়ছে। কোনো পাপী খুন হয়েছে জন্য না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে জাহিদের জন্য।
জাহিদের যখন দুই বছর বয়স তখনই মারা যায় জাহিদের বাবা বোরহান মিয়া। বোরহান মিয়া ছিলেন একজন গরীব রিকশাচালক। রোকসানার জন্মের সময় মারা গিয়েছিল তার মা। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে তার কপালে আর সুখ জুটে নাই। একটু বুঝ হবার পর থেকেই দুঃখ কষ্ট সহ্য করে আসছে। তার উপরে বাবা অল্প বয়সে দিয়ে দেয় বিয়ে। মারাও যায় স্বামী। এইরকম অভাগীদের কপালেই হয় এমন। কোথাও একটু শান্তি পায় না।
বাবার সম্পত্তি আর দু’চারজন বাপভাই ছিল না জন্য বোরহান মিয়া সমাজে তেমন শক্তিশালী হয়ে বসবাস করতে পারেনি। নীরহ মানুষদের মতো বসবাস করে গিয়েছে। সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা নিরহ, সহজ-সরল হয়। কারো ভালো খারাপ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা থাকে না। তাদের চিন্তা থাকে কীভাবে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু সমাজে এমনকিছু মানুষ আছে যারা এই নিরহ মানুষগুলোকে দেখতে পারে না। তারা চায় এই মানুষগুলোকে তাদের পায়ের নিচে রাখতে। তার মধ্যে একজন হলো জলিল মুন্সি।
জলিল মুন্সি লক্ষ্মীন্দর গ্রামের প্রাক্তন মেম্বার। প্রাক্তন মেম্বার হলেও বর্তমান মেম্বার চলে তার কথায়। কারণ জলিল মুন্সির রয়েছে গ্রামে অদম্য শক্তি আর প্রচুর টাকা। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনোকিছু বলতে পারে না। সে সমাজে যা বলে বড় থেকে ছোট সবার তাই মেনে নিতে হয়। যেন এক স্বৈরাচারী শাসন।
জাহিদের বাবা বোরহান মিয়া মারা যাবার পর পরেই জলিল মুন্সির চোখ পড়ে রোকসানার দিকে। স্বামী মারা যাবার পর রোকসানার এখানে থাকতে খুব সমস্যা হচ্ছিল বিধায় ছোট জাহিদকে নিয়ে অনিচ্ছা শর্তে যেতে হয় সৎ মায়ের কাছে। কিন্তু রোকসানাকে সৎ মায়ের চোখের দুশমন হিসেবে পড়ে থাকতে হয় সেখানে। এইসব কিছুর মাঝেই ধীরেধীরে বড় হচ্ছিল জাহিদ। একটা সময় এসে রোকসানার সৎ মা রোকসানার প্রতি বড্ড খারাপ আচরণ শুরু করে। উঠতে বসতে এটা ওটা নিয়ে কথা বলে। জাহিদ কিছু করার আগেই তাকে শক্ত মার দেয়। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে পড়ে আছিস কেন বলাটা যেন নিত্যদিনের বাণী হয়ে দাঁড়ায়! অথচ রোকসানা এ বাড়িতে পড়ে থাকছে কাজের মেয়ের মতো। মনে মনে চিন্তা ছিল ছেলে একটু বড় হলেই চলে যাবে। কিন্তু তার সৎ মায়ের এমন অত্যাচারে সে নিজেও অহস্য হয়ে উঠে। শেষে ঠিক করে স্বামীর ভিটেটুকুতেই ফিরে যাবে।
একদিন হুট করে চলে যায়। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে ভাঙ্গা ঘরটুকুতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আবার থাকতে শুরু করে। জাহিদের বয়স তখন এগারো বৎসর। জাহিদ মায়ের কষ্ট বুঝতে শুরু করেছে। মাকে প্রতিশ্রুতি দেয়, মা আমি বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট দূর কইরা দিমু। তুমি চিন্তা কইরো না। রোকসানা সারাদিন অন্যর বাড়িতে কাজ করে। রাতে আসলে মা ছেলে মিলে দুমুঠো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর এভাবেই কোনোরকম দিন কাটছিল তাদের। এর মাঝে জলিল মুন্সি খবর পায় বোরহানের বিধবা বউ আবার গ্রামে ফিরেছে। খবর পাওয়ার পর প্রায় রাতে এসে রোকসানাকে বিরক্ত করে। ডাকে, দরজায় শব্দ করে। রোকসানা জেগে থাকলেও কোনো কথা বলে না। প্রতিবেশী অনেকের কাছে বলেছে এই ঘটনা। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। জলিল মুন্সির বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার সাহস নেই।
দূর থেকে বিরক্ত করতে করতে একটা সময় জোর করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ছেলে জাহিদ জেগে থাকে বলে কিছু করতে পারে না। একদিন, দু’দিন, তিনদিনের মাথায় ছেলের সামনেই রোকসানাকে নির্যাতন করে। এরপর প্রায় রাতেই জলিল মুন্সি জোরজবরদস্তি করে ঘরে ঢুকে। মা ছেলে তখন নিরুপায়। হাত পা বেঁধে ফেলে রাখে জাহিদকে। সকালে উঠে কাউকে এ কথা বলতে পারে না রোকসানা। সমাজের ভয়ে, কলঙ্ক লাগবে যে!
এই অত্যাচারের সীমা দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে এসে এগারো বৎসরের জাহিদ চিন্তা করে এভাবে আর সহ্য করা যায় না। আমরাও তো মানুষ। ছোট্ট এই ছেলেটি ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ পুষতে থাকে। এর একটা কিছু করবে সে। একদিন পাশের বাড়ির সুলেমানের বাড়ি থেকে তাদের ঘরের ফল কাটার ছুরিটা চুরি করে। সেইদিন রাতে আর জলিল মুন্সি আসে নাই। বাচ্চাদের মনে যদি কোনো জেদ চেপে বসে তাহলে তা সহজে ছাড়ে না। পরেরদিন সকাল বেলা জাহিদ মক্তব থেকে আসার পথে রাস্তায় জলিল মুন্সির দেখা পায়। দৌড়ে এসে ঘর থেকে ছুরিটা নিয়ে গিয়ে জলিল মুন্সির একদম পেট বরাবর ঢুকিয়ে দেয়। গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে মারা যায় জলিল মুন্সি।
জাহিদ জলিল্লারে মাইরালছি বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে যায় মায়ের কাছে। মা’ রোকসানা এই কথা শুনার পর সেই একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। কিন্তু জাহিদের মনে একটুকুও দুঃখ নেই। একটু পরেই বাড়ি ভর্তি হয়ে যায় পুলিশে।
হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাহিদকে। মা পিছন থেকে কান্না জড়িত চোখে তাকিয়ে আছে। জাহিদও চোখের জল ফেলে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি যেন বলছে, মাকে তোমাকে মুক্তি দিয়ে গেলাম নরপিশাচের হাত থেকে। আমার মৃত্য হলেও আমি শান্তি পাব।