নিলয়কে তার মা হঠাৎ একদিন ফোন করে বলে,
_বাবা, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি, তুই যদি আমার বিয়ে করার ব্যাপারে আপত্তি না করিস তবে লন্ডন থেকে চলে আয় ৷
_কি বলছো মা এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে?
_তোর বাবার মৃত্যুর পর নিজেকে খুব একলা লাগে বাবা, আমি একাকিত্বের কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা ৷
নিলয় তার মায়ের এমন কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল ৷ মনে হলো সে এতবড় অদ্ভুত কথা কখনো শোনেনি ৷ লজ্জায় আর রাগে তার মাকে মনে মনে গালি দিল ৷ সে তার বড় ভাই আসিফকে ফোন দিয়ে বললো
_ভাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
_কি সর্বনাশ হলো? কার হলো?
_মা তো বিয়ে করতে যাচ্ছে!
_কি যা তা বলছিস ?
_আমিও কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু বড় আপুকে ফোন দিলে আপু বলে- “মায়ের মাথা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে ৷ গতপরশু আমার বাসায় এসে বিয়ে করার জন্য কান্নাকাটি করেছে” ৷৷
_কি বলছিস এসব? আম্মার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেল?
_তুই তো ঢাকা আছিস আম্মুকে ভাল ডাক্তার দেখা ৷
এই বয়সে মা বিয়ে করলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবোনা ৷ ছোট আপু তো খবরটা শুনে শুধু কাঁদছে! আসিফ তার মাকে দেখাতে একজন ডাক্তার সাথে করে নিয়ে এলো ৷ডাক্তার তার মাকে চেকআপ করে বললো
_না, রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ্য ৷ তার কোন সমস্যা নেই ৷
_আমার ছেলেরা আমাকে নিয়ে খুব টেনশন করে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি এটা শুনে তারা খুব চিন্তায় আছে ৷ কি করি বলো তো ডাক্তার বাবা?
ডাক্তার নিলয়ের মায়ের এই কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ৷ ৫৪ বছর বয়সী মহিলার মুখে এমন কথা শুনে সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না ৷ আসিফকে ডাক্তার বললেন, “ভেবেছিলাম রোগী সুস্থ্য, কিন্তু না আমার ধারণা ভুল ৷৷তাকে কোনো সাইক্লিয়ার্টিস্টকে দেখান” ৷ আসিফ তার মাকে সাইক্লিয়ার্টস্ট-এর নিকট নিয়ে গেল ৷ তিনি রোগীকে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
_না রোগীর তো সমস্যা নাই ৷ নিলয়ের মা যখনই বললো,
_বাবা, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি তাই ছেলেরা ভাবছে আমি পাগল হয়ে গেছি ৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাহেবও ভরকে গেলেন মহিলার কথা শুনে ৷ জিব্বায় কামড় দিলেন আর বললেন
_এই বয়সে আপনি বিয়ে করবেন কেন?
_কি যে বলেন না ডাক্তার? আমার তো মাত্র ৫৪ হবে, এরচেয়ে বেশি বয়সে কত মহিলা বিয়ে করে ৷ আপনি শিক্ষিত লোক হয়ে এমন কথা বললেন শুনে অবাক হলাম ৷ বিশেষজ্ঞ সাহেব আসিফকে বললেন
_না তার কোন সমস্যা নেই ৷ তিনি একাকিত্বে ভুগছেন ৷ তিনি যা চাচ্ছেন সেটা করতে দিন ৷ নিলয়ের তিনটা বোন বাড়ি এসে হাজির ৷ তারা বলছে,
_আম্মা, যদি তুমি বিয়ে করো আমরা তোমার মেয়ের জামাইয়ের নিকট মুখ দেখাতে পারবোনা ৷ প্লিজ এমনটা করোনা ৷
_মুখ না দেখাতে পারলে বোরখা পড়বি, নিকাপ দিয়ে মুখ ঢাকবি, সমস্যা কি?
_মা, তোমার পাগলামী বন্ধ করো তো! এসব সহ্য হচ্ছেনা ৷
_তোরা আমার কষ্টের কি বুঝবি? তোদের বাবা ৩মাস হলো মারা গেছে ৷ কতটা কষ্টে আছি সেটা কি জানিস তোরা?
বলেই নিলয়ের মা হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো ৷ নিলয় যখন জানতে পারলো শুক্রবারে তার মায়ের বিয়ে ৷ সে তার বোন আর ভাইদের কথামত বিমান চ্যাটার্ট করে দেশে চলে আসলো ৷ এসেই মাকে বললো,
_আম্মা তোমার কি বিন্দুমাত্র লজ্জা নাই? এই বয়সে তুমি বিয়ে করবে ছিঃ মা ছি! সালেহা বেগম তার ছোট ছেলের গালে থাপ্পর দিয়ে বলে,
_মায়ের লজ্জা সম্মানের প্রতি এতো চিন্তা তাইনা?
এজন্য বিমান ভাড়া করে দেশে আসছো! তোমার বাবা মারা গেল, তখন তো আসলেনা, বললে একদিনের জন্য দেশে এসে কি হবে! এত বড় কঠিন কথা বলেছিলে! পুরো ৭বছরে তুমি ১০ বারও ফোন দাওনি, আমিই ফোন দিতাম তুমি সময় পেলে রিসিভ করে দু-তিনটা কথা বলেই বলতে- মা পরে কথা বলবো এখন ব্যস্ত ৷ কিন্তু যখন শুনলে আমি বিয়ে করছি তখন ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা, নিজেই বারবার ফোন দিতে লাগলে ৷ আবার ভাড়া করে বিমানে করে দেশে আসলে ৷ তোমার বাবা তোমার জন্য কত কষ্ট করে বিদেশে পাঠালো লেখাপড়ার জন্য আর সেখানে বিয়ে করে বাবা মা কে ভুলেই গেলে ৷ কখনোই আগ বাড়িয়ে ফোন করে বলোনি– মা কেমন আছো, তোমার বাবা বেঁচে থাকতে কখনো ফোন করেছিলে? আর আজ আমার জন্য তুমি লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছ ৷ তোমার জন্য তোমার বাবা প্রায় সময় কান্না করে বলতো ছেলেটাকে দেশে ফিরাতে পারলামনা ৷ তিনি প্রায় সময়ই তোমাকে ফোন করে বলতো,
_”বাবা, দেশে চলে আয়, এখানেই অনেক দামী উঁচু পদের চাকরী পাবি, আমাদের এত অর্থের দরকার নেই ৷ আর তুমি কি বলতে? বলতে,
_“তোমার টাকার দরকার না থাকলেও আমার দরকার আছে” ৷
তিনি এত বড় রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি করে গেছেন অথচ বাড়িতে সারাদিন আমাকে একা থাকতে হয় ৷ ভাগ্যিস বাড়িটা নির্মাণ করেই তিনি পরপারে গেছেন, নইলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হতো ৷ আল্লাহর কাছে এজন্য হাজার শুকরিয়া জানাই ৷ তোমার বাবার ভুল ছিল, বড় ভুল করেছিল তোমাকে বিদেশে পাঠিয়ে , যার প্রতিদান তিনি জীবিত থাকতে পেয়েছিলেন ৷ ছেলের জন্য তিনি কষ্টে হাহাকার করতেন ৷ সালেহা বেগম তার বড় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
_নিলয় তো বিদেশে থাকতো ৷ কিন্তু তুমি তো ঢাকাতে থাকতে ৷ নাকি বিলাসবহুল ভবনে বাস করে বউ ছেলে সন্তান নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে মাকে একটাবার ফোন দেবারও সময় হয়না? আর আজ তুমি কত ফোন দিচ্ছ! সালেহা বেগম তার বড় ছেলে ও তিন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তোমাদের বাবা মৃত্যুর পর দুটা দিনও এ বাড়িতে থাকলেনা তোমরা ৷ বাসায় গিয়ে বলতে- টেনশন করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ বাড়িতে এসে একটাবার খোঁজ নিতেনা যে মা কেমন আছে ? আমার তিনটা আদরের মেয়ে, মাকে কতনা ভালবাস তোমরা ৷৷ মায়ের লজ্জা শরম নিয়ে কত চিন্তা করো ৷ অথচ প্রভাবশালী জামাইকে পেয়ে তোমরা মাকে ভুলে গেলে ৷ এটার কথা মনে করে লজ্জা হয়না? মা একাকিত্বে যখন পুড়ে পুড়ে মরে, একজন সঙ্গীর যখন তার দরকার পড়ে তখন তোমাদের লজ্জায় খুব আঘাত লাগে তাইনা? এতবড় বাড়িতে একা কেমনে কাটায় সেটা কি ভাবো একটাবার? তোমরা কেমনে ভাবলে আমি বিয়ে করবো? আমি আমার কষ্টটা তোমাদের উপলদ্ধি করাতেই এই নাটকটা করেছি ৷ আমার বিয়ের দরকার নেই ৷ আমি চাই আমার দুটা ছেলে তার বাবার তৈরী করা বিশাল এই বাড়িটাতে হাসি খুশিতে থাকুক ৷ মেয়ে তিনটা আমার খোঁজ খবর নিক ৷
মায়ের কথা শুনে দুটা ছেলে ও তিনটা মেয়ে কান্নায় জারজার হয়ে গেছে ৷ মায়ের কথাগুলো তাদের হ্নদয়ে এমনভাবে আঘাত করেছে যে নিজেদের অপরাধ সহজেই অনুমেয় করতে পারলো ৷ সবাই তার মায়ের পায়ে লুটিয়ো পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং বললো, “আমাদের মাফ করো, আমরা তোমার কষ্টটা বুঝতে পারিনি, আমরা অন্ধ ছিলাম নিজেদের ভোগ বিলাসের মধ্যে মত্ত থেকে” ৷ মায়ের কান্নায় সন্তানরা সঠিক পথে শেষপর্যন্ত ফিরে এলো ৷
কিন্তু এটা তো গল্পে! বাস্তবে কি মায়ের বুক ফাঁটা কান্নায় ছেলেদের হুশ ফেরে ৷ মাকে থাকতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে যখন ছেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকে অট্টালিকায় ৷ কিংবা মা বাসায় থেকেও ছেলের সাথে দুটা মিনিট কথা বলতে পারেনা ভয়ে, মায়ের সাথে কথা বলার সময় হয়না ছেলের ৷ মা খাচায় বন্দি পাখির মত ছটফট করে ৷সে চাই কখন খাচা থেকে চিরদিনের জন্য ছাড়া পাবে ৷ বাস্তবের গল্পগুলো খুবই কঠিন ৷ মায়েদের কান্নার প্রতিটা বিন্দুজল পৃথিবীর মাটিকে কাঁপিয়ে তোলে, কিন্তু পাষন্ড সন্তানের বুকটা কাঁপেনা ৷ আমরা অপরাধী সন্তান ৷ মায়েরা সবসময় আমাদেরকে পরাজিত করে নিজেরা হেরে যায়