তরকারিতে নিজের স্বাদ মতো লবন বা ঝালের কম্বিনেশন না হলে এখন আর নাক সিটকাতে পারিনা মা। অভিমান করে, ‘কি রান্না করেছ এসব!’ -বলে ভাতের থালা দূরে ঠেলে উঠে যেতে পারিনা আর। খুব মিস করি ফোন করে তোমার বলা, ‘বাবা আয়, তোর জন্য ডিম ভাজি করেছি’, ‘ভর্তা করেছি’, ‘মাছ ভাজি করেছি’ এসব কথাগুলো। মাঝেমধ্যে এমন হতো। অন্যের ঘর থেকে হলেও ভালো কিছু এনে আমার পাতে দিয়েছ। আমি ঠিকই খেয়ে বের হয়ে গেছি তবে কখনো জানতেও চাইনি, ‘মা, আমাকে না হয় ওদের ঘর থেকে ভালো খাবার এনে দিলে, তুমি কি খাবে?’ তোমার ছেলে বড্ড স্বার্থপর মা।
ফোনে টাকা থাকলে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিনিটের পর মিনিট কথা হয়। মনে হয়নি ‘আমার মা কি করছে না করছে তার একটা খবর নিই!’ আমার বাড়ি ফেরার খবর শুনলে পৃথিবীতে সবথেকে খুশি হও তুমি। কতবার বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে এসে আমার ফেরার পথ চেয়ে থাকো তার কোন ইয়ত্তা নেই। ঘরে ঢুকলেই জড়িয়ে ধরে, ‘আমার বাবার শরীরটা একদম শুকিয়ে গেছে!’ এভাবে শুধু তুমিই বলো মা।
খেতে বসলে টেবিল জুড়ে আমার সবচাইতে প্রিয় খাবারগুলো সাজিয়ে দাও সেই তুমিই মা। ঘরের সামনে থাকা পেয়ারা গাছটায় জাল দিয়ে পেছিয়ে পেয়ারাগুলো আমার জন্যে তুমিই রাখো মা। সপ্তাহ-দশদিন যে কদিনই বাড়িতে থাকি প্রতিবার কাছে বসে ভাত পাতে তুলে তুমিই খাইয়ে দাও মা। আমাকে জিজ্ঞেস করো, ‘বাবা, যেখানে থাকিস সেখানকার খাবারদাবার কেমন হয়?’ -এভাবে যখন জানতে চাও তখন আমি পৃথিবীর সবচাইতে বড় মিথ্যুক হয়ে যাই মা। পাথরে ভরা ভাত, পানির মতো ডাল, মিষ্টির মতো আলুর তরকারি আর সকল স্বাদহীন খাবার-দাবারের কথা শুনলে তোমার সহ্য হবেনা মা। তাই মিথ্যা বলি।
আমার ছুটির প্রতিটি দিন কমে যাওয়ার সাথে সাথে তোমার মুখের হাসিটা হারিয়ে যেতে থাকে মা। যেখানে হোস্টেলে থাকাবস্থায় নিজের সব কাপড় নিজে ধুই সেখানে বাড়িতে গোসলের পর ভেজা কাপড়গুলো তোমার জন্য দিব্যি রেখে দিই আমি। তুমি সেগুলো ধুয়ে দাও আর বলো, ‘কাপড়গুলো থেকে কত ময়লা বেরিয়েছে এত ময়লা কাপড় পড়িস কি করে?’ আমার দিন ফুরাতে থাকে আর সব কাপড়চোপড় ধুয়ে ধুয়ে, শুকিয়ে ভাজ করে জমা করতে শুরু করো মা তুমিই।
জানি তোমার জলিজা ফেটে যায়। তবুও এসব করো। চোঁখে চোঁখে রেখে বড় করে তোলা মুরগটাকে বিক্রি করে টাকাগুলো রেখো দাও বিদায় বেলায় আমার মুঠিতে দিয়ে দিবে বলে মা। আমার ছুটি শেষ হয় যায়। রাতে ঘুম হয়না তোমার, তোমার বুকের মানিক, সাত রাজার ধন আবার তোমার আঁচল ছেড়ে দুরে চলে যাবে বলে। মুয়াজ্জিনের আগেই তুমি উঠে রান্নাবান্নার কাজে লেগে যাও। আমার প্রিয় সব খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে দাও। পাশে বসে টলমল চোঁখে আমার পাতে তুমি ভাত তুলে দাও মা। বিশ্বাস করো মা, আমার গলা দিয়ে তখন খাবার নামতে চায়না। যে কয়টা লোকমা খাবার খাই সেটা শুধু তোমার মন রাখার জন্য। তখন আমার কলিজা ফেটে যায় মা।
বাথরুম, বেডরুমে, করিডোরেসহ সব জায়গায় কম করে হলেও আট-দশটা চক্কর দাও কোথাও আমি কোনকিছু ভুল করে রেখে যাচ্ছি কিনা। আমার টুথব্রাশ, পেস্ট, ঐ নীল গেঞ্জিটা, গামছাটা সবকিছু খুজে খুজে এনে ব্যাগে ভরে দাও মা তুমিই। এসব করতে করতে চুপিসারে আঁচল দিয়ে কতবার যে চোঁখের পানি মুছো তার কোন হিসাব নেই মা। তিনটি পেয়ারা, কয়েকটি পিঠা, ভুনা গোশতের তরকারি আমার ব্যাগে তুমিই দিয়ে দাও মা। চলে আসার সময় কাছে টেনে কপালে চুমু তুমিই দাও মা। আমি অনেক মিথ্যা বলি তোমার সাথে। অনেক অভিনয় করি। তবে, যখন তোমার মমতার আঁচল ছেড়ে চলে আসতে থাকি তখন আর অভিনয়টা করতে পারিনা মা। আমার চোঁখের পানি তখন আর কোন বাঁধ মানেনা মা। কলিজা ছিঁড়ে সেখানে রক্তক্ষরণ হয় মা। বলতে পারিনা, ‘তোমার মতো আমাকে কেউ এত আদর করেনা। কেউ এত খবর নেয়না। কেউ এত ভালোবাসেনা। তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকতে তোমার ছেলের বড্ড কষ্ট হয় মা।’ আমি এসব বলতে পারিনা মা।
জানি, আমাকে দেখা না গেলেও তুমি বহুক্ষণ রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকো। অঝোরে কাঁদতে থাকো তুমি। আমি জানি, সেদিন আর তোমার পেঠে কোন দানাপানি পড়েনা মা। মুয়াজ্জিন যখন নামাজের জন্য আহ্বান করে তখন তুমি জায়নামাজে রবের কুদরতি পায়ে লুটিয়ে পড়ো। দুহাত তুলে মোনাজাত করো তোমার ছেলেকে যেন আল্লাহ্ সকল আসমানি-জমিনী বালা মসিবত থেকে রক্ষা করেন। পরিবারের সব কাজ করো তুমি। সবকিছু সামাল দাও। সবার সাথেই প্রত্যহ অভিনয় করে চলো তুমি ভালো আছো। কিন্ত আমি তো জানি, তোমার বুকের মানিককে দূরে রেখে তুমি কোনভাবেই ভালো থাকতে পারোনা মা। খুব মিস করি তোমায়। সত্যিই মা, খুব মিস করি।