ক্ষণজন্মা

ক্ষণজন্মা

নবমবারের মত ফোনটা বেজে উঠতেই তিতির লাফিয়ে উঠে বসলো বিছানায়। ফোন কে দিয়েছে না দেখেই দিল এক ধমক।

-সমস্যা কি?রাত সাড়ে চারটায় কেউ কাউকে ফোন দেয়?তোর কি প্রবলেম?
-ইয়ে
-কি ইয়ে ইয়ে
-আপনি কি তিতির? তিতির থমকে গেল।ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে অচেনা নম্বর।

-হ্যা বলছি।
-সন্ধানীর ডোনার?
-হ্যা
-আপনি কি এখন একবার হাসপাতালে আসতে পারবেন?
-আসছি তিতির মেজাজ সামলে বের হলো।সাতাশ মিনিটে গোবিন্দা থেকে সদরে পৌঁছে গেল।ব্লাড ব্যাংকের সামনে থেকে ফোন দিল আগের নম্বরে। কাঁচের দরজা খুলে মাঝবয়েসী এক লোক এগিয়ে এলো।

-তিতির?
-জ্বি
-আমি পেশেন্টের হাজবেন্ড।আমার স্ত্রীর লিউকোমিয়া। এবার ডেটের আগেই ব্লাড লাগছে। দিশেহারা হয়ে গেছিলাম।কারণ ডোনাররা এখন কেউ ফোন ধরছে না।যারা ধরছে তারাও অনেক দূরের। তাই দিশেহারা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে বসেছিলাম।এক লোক বললো আপনার কথা।

-সমস্যা নেই।
-ইয়ে, উনি বললো আপনার নাকি তিনমাস হয় নি এখনো?

তিতির এতক্ষনে হাসলো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ‘সাঈদ আংকেল জেনেই ডেকেছে। ‘লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। সাঈদ আংকেল এসে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে হাতে সুঁই বিঁধিয়ে দিল। বললো,

-আপনি টেনশন করবেন না । আমি আগেও দিয়েছি। ইমার্জেন্সিতে যদি ডোনার পেতে দেরি হয় আর আমার ব্লাড গ্রুপ মেলে, তাহলে আমাকে ডাকে আংকেল।
-আপনি তো অসুস্থ হয়ে যাবেন। তিতির মৃদু হেসে চুপচাপ রইলো।ওর হয়ে উত্তর দিল সাঈদ আংকেল।
-ওর পায়ের পাতা থেকে মাথা অব্দি অসুখ।ও বেঁচে আছে এটাই আশ্চর্য।
-তাহলে যে ব্লাড দিচ্ছে?
-ও কি কাউকে মানে?

তিতির বাসায় আসলো সাড়ে ছটায়। এসেই একেবারে গোসল দিয়ে লেপের নীচে চলে গেল।এখন ওর ঘুম দরকার। সবেই ঘুমটা এসেছে তক্ষুনি আবার ফোন। ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাফি।আর বাজে প্রায় চারটে। তার মানে সবে না, ও প্রায় সারাদিনই ঘুমিয়েছে।কিন্তু অবসাদ যায়নি।ফোন রিসিভ করে বললো,

-কই তুই?
-দরজা খোল ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে আবার লেপের নীচে চলে গেল৷ রাফি ঘরে ঢুকে জানালা খুলে দিল।
-এখনো শুয়ে আছিস ক্যান?
-এই সাতসকালে আমার ঘুমের বারোটা বাজাতে বলছে কে তোকে? রাফি আকাশ থেকে পড়লো।
-সকাল!বিকেল চারটাকে তোর সকাল মনে হচ্ছে?

রাফি প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তিতিরের দিকে তাকালো।ঘুমিয়ে গেছে।গুটিসুটি হয়ে ঘুমুচ্ছে মেয়েটা । চোখের নীচে কালি, ক্লান্তির ছাপ ফুটে আছে । তবুও চোখ ফেরাতে পারছে না ও । কি নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটিকে! রাফি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তিতিরের পাশে বসলো।ওকে দেখতে দেখতে ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিককার কথা ভাবছিল।দস্যি মেয়ে ছিল বটে একটা। রাফি নিঃশব্দে হেসে ফেললো।প্রথম দিন ভার্সিটিতে মাহফুজ চলে এসেছিল হাফ প্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট পড়ে। দুজন হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই ও মাহফুজকে বলেছিল,

-বেটা তোর ড্রেস আপ তো সেই হইছে।

পাশ থেকে উচ্চকন্ঠে হাসি শুনে মাহফুজ দৌড় দিয়েছিল হলের দিকে আর রাফি তাকিয়েছিল হাসির মালিকের দিকে। মেয়েটির চোখ মুখ খুব একটা ধারালো না।গড়পড়তা মেয়েদের মতই।বরং একটু মোটার দিকে। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকাতে হয় চোখদুটোর জন্য।ওই রহস্যময়,অতল গভীর বিষণ্ণতামাখা চোখ যে কাউকে নিঃশব্দে ভালবাসতে বাধ্য করে।

একসাথে প্রায় চার বছর কাটিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা ওকে একেবারে পাল্টে ফেলেছে।ওরগলার স্বর গমগমে। মেয়েটার বকাবকিতে কথা বলতে হয় ঠান্ডা গলায়।আফসোস হয় মাঝে মাঝে। কি কুক্ষণে যে মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়েছিল?আবার হাঁটা নিয়ে পড়েছে। রাফি নাকি বয়সের তুলনায় বেশিই ভারিক্কি ভাব নিয়ে চলে। তিতিরের কথা,

-বয়সটা রঙিন। রাজনীতি কর, খুনোখুনি কর,আর্টিস্ট হ,মেটাল গা সমস্যা নাই।দাদাদের মত মুখ ক্যান গোমড়া রাখবি? ফাঁটাবাঁশের মত গলায় ক্যান আরো গম্ভীর ভাব আনতে হবে?হাঁটার সময় ছায়া দেখছস?মনে হয় দুইশো বাইশ বছরের বুইড়া হেঁটে যাচ্ছে। রাফি হাসলো।মেয়েটা কখনো ওকে নিয়মে বাঁধে নি।মুক্ত প্রাণ ছেড়ে দিয়েছে। ও দশটায় ফিরলে তিতির সাথে থাকার চান্স নিত। যদিও রাফি দাবড়ি দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিত মেয়েটিকে। কারণ ও হলে থাকতো না। ছোট্ট একটা রুম নিয়ে চিলেকোঠায় থাকতো।বাড়িওয়ালা খুব কঠিন ছিলো৷ তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসেই চমকে গেল।সামনে রাফি বসে আছে। রাফি হেসে বললো।

-চা খাবি?
-তুই যাস নাই?
-কেম্নে যাই বল।হা করে ঘুমাচ্ছিলি।মশা মাছি যেন মুখে ডিম না পাড়ে তাই পাহারা দিচ্ছিলাম।
-শালা পিছলা পাঙাশ মাছ রাফি দাঁত বের করে হাসলো।
-চা বানাতে পারিনি তোর মত। খেয়ে দেখতে পারিস।

তিতির চায়ের মগ নিল।মাটির গ্লাস ভর্তি করে ওকে চা দিয়েছে রাফি। তিতির ঘ্রাণ নিল চায়ের।বরাবরই তিতিরের এই কাজটা ভাল লাগে ওর।

-আমি কতক্ষন ঘুমাইসিরে?
-আমি আসার পর থেকে চারঘণ্টা।
-বাপস! আমি তো কুম্ভকর্ণরে ফেল করানোর জোগাড় করছি।

হেসে ফেললো দুজনেই।রাফি যে কবে কিভাবে মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলছে কে জানে! রাফি বলতে চায় ‘তিতির, আমার হয়ে যা না। তিতির-রাফিকে দারুণ মানাবে ‘।

-তিতির কই রে তুই?
-ক্যান?
-গ্রামে যাবি?
-কে কে?
-আমি, তুই, মাহফুজ,হাবীব, তপু, অনন্য,পিংকি, পাপিয়া।
-আচ্ছা।
-শোন বদ মেয়ে। ওষুধ তোল ব্যাগে এক্ষুনি। তিতির শব্দ করে হাসলো।
-তুলছি
-স্ট্যান্ডে চলে আয়।সাড়ে ছটায়।
-আচ্ছা
-ছাড়ছি

বলে ফোন কেটে দিল রাফি। আনমনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তিতিরের হার্ট খুব উইক।ও বেঁচে আছে কিভাবে আল্লাহ্ মালুম।আর কোত্থেকে যে এত প্রাণশক্তি পায় ভেবে পায়না রাফি৷ তিতির-রাফিরা যাচ্ছে রাফিদের গ্রামের বাড়ি।বাইরে ফুটফুটে জোৎস্না। যাকে বলে একেবারে ফুল মুন।বাইরের দৃশ্য দেখছে তিতির।দূরের গ্রাম গুলোয় টিমটিম করে আলো জ্বলছে। তিতিরের মুখে জোৎস্নার আলো এসে পড়েছে। রাফি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছে।কি আছে এই মেয়ের মধ্যে? গ্রামে এসে ঠান্ডা যেন আরো জাঁকিয়ে লাগছে। রাত হয়ে যাওয়ায় খেয়ে যার যার রুমে চলে গেছে। নেটওয়ার্ক খুব বেশিই শক্তিশালী হওয়ায় লগ ইন করতেই লাগছে প্রায় আধাঘণ্টা। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে অনন্যরা। রাফি তিতিরের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে এগিয়ে গেল।কারেন্ট নেই।হারিকেনের আলো উসকে দিয়ে লেপের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বই পড়ছে মেয়েটি।এই মেয়ের ব্যাগে কি সবসময়ই বই থাকে নাকি?রাফি নক করলো।

-খোলা বই থেকে মুখ তুললো না। রাফি বই কেড়ে নিয়ে বললো,
-রাতে তোর বই পড়া নিষেধ। যা ঘুমা। তিতির লক্ষ্মী মেয়ের মত শুয়ে পড়তেই রাফি বললো,
-ভেতরে গল্পের বই যা আছে সব দে। তিতির লেপের ভেতর থেকে তিনটা বই বের করে দিল।
-বালিশের নীচের গুলা দে

দুইটা বই বের করে দিল। রাফি বের হয়ে যেতে যেতে বললো ‘শুভ রাত্রি ‘।তিতির গোমড়া মুখে উত্তর দিল না।বই নিয়ে যাওয়ায় ক্ষেপেছে। সাতসকালে ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা স্পর্শ পেল রাফি।প্রথমে ভেবেছে বাতাস।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল বাতাস আসবে কিভাবে। সাপ! লাফিয়ে উঠে বসে দেখে তিতির সামনে দাঁড়িয়ে।কালো সালোয়ার,অফ হোয়াইট জামা আর কালো শাল গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফি থতমত খেয়ে গেল।হঠাৎ ওর ইচ্ছে করলো এই মেয়েটাকে ও ভেঙে ফেলে।বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে ‘ভালবাসি’।

-চল যাই
-কই যাব?
-কেন?খেজুর রস খেয়ে আসি।
-অন্যরা?
-তোর জন্য কি বসে আছেরে আইলস্যা?সব জোড়া গুলো আগেই বের হইছে।

রাফি দ্রুত বের হয়। লোকজন তেমন নেই পথে। জমাট বাঁধা কুয়াশা।রাফির হাঁটতে বেশ লাগছিল।কিংবা কে জানে, তিতির পাশে আছে বলেই বেশি ভাল লাগছে হয়তো।ওরা সারাদিন ঘোরাফেরা করে। বিকেলে নানীর হাতের পিঠা আর রাতে আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে বসে আড্ডা দেয়। অনন্য গিটারে সুর তোলে।বেশ জমাট উৎসব উৎসব পরিবেশ। রোজ রাতের মত আড্ডা বসেছে। নাড়ার আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসেছে সবাই।জুটিগুলা পাশাপাশি বসেছে। রাফি তিতিরের পাশে বসতে বসতে বললো,

-আহা! আমরাও একটা জুটি।

তিতির চোখ ছোট ছোট করে দেখলো রাফিকে। অনন্য গান ধরলো।চাঁদটা মাথার উপর। মাঝে মাঝে উত্তুরে হাওয়া গায়ে কাঁপুনি তুলে দিচ্ছে।তখনি রাফি খেয়াল করলো তিতির হালকা একটা সোয়েটার পরে আছে। একটু কাঁপছে। রাফি আচমকা তিতিরকে টেনে নিল কাছে। ওর চাদর দিয়ে ঢেকে দিল।তারপর কাঁধচেপে জড়িয়ে ধরে কানের পাশে মুখ নিয়ে বললো,

-আমাদের কাপল হতে প্রবলেম কি?
-তোর মুখে ঠাডা পরুক বদ
-আমি কিন্তু সত্যিই চাই
-যা ভাগ

আচমকা তিতির অনন্যকে বললো গিটারটা দিতে। অনন্য গিটার দিতেই অপটু হাতে সুর তুললো ও। আস্তে আস্তে রিদম ঠিক করে নিল।তারপর গলা মেলালো, ‘যখন নিঝুম রাতে সব কিছু চুপ, নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁঝিঁ রাও ঘুম, আমি চাঁদের আলো হয়ে তোমার কালো ঘরে জেগে রই সারানিশি এতটা ভালবাসি ‘।। গানটা শেষ হওয়ার পরেও চুপ রইলো সবাই।কেউ জানতই না তিতির গান গাইতে জানে। আর গিটারটাও শিখেছে। তারচেয়েও কণ্ঠের জাদুতেই সবাই মুগ্ধ হয়ে ছিল। সেদিন অনেক রাতে সবাই ঘুমুতে গেছে। ঘুম থেকে উঠেই রাফি চমকে গেল।বাইরে লোকজন কেন এত?দ্রুত বাইরে এলো ও। আসতেই অনন্য জড়িয়ে ধরলো ওকে।রাফি যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।তিতির আর নেই। মাহফুজ বললো,

-স্বাভাবিক হার্ট ফেইলিওর।ডাক্তার চেক করেছে।

রাফির কানে অর্ধেক কথা যাচ্ছে অর্ধেক যাচ্ছে না।ওর চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।তিতির নেই!!! রাফি হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো মাটিতেই।হাবীব, অনন্য আর মাহফুজ এগিয়ে আসলো ওকে ধরতে।হাত তুলে নিষেধ করলো। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘ওর বাবা মা ছিল না। দূর সম্পর্কের এক মামা আছে। সে কখন আসবে ঠিক নেই।ওকে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে কবর দেয়া হোক ‘। আটজন এসেছিল।ফিরে যাচ্ছে সাতজন।সবারই মন খারাপ।রাফি একেবারে চুপ।কেউ ওকে কিছু বলেও সাহস পাচ্ছে না।হাবীব আস্তে করে বললো,

-রাফি,চারদিন কিছু খাসনি।এই কেকটা তো খা প্লিজ।
-দোস্ত ওর মৃত্যুতে আমরাও কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না। এবার রাফি নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো।বললো,
-তিতির আমার অস্তিত্বের অংশ ছিল।আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশটুকুই হারিয়ে ফেলেছি।বেঁচে থাকা এখন অর্থহীন।গাড়িটি ছুটে যাচ্ছে। স্তব্ধ হৃদয়ে বসে আছে কয়েকটি মানুষ।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত