দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। হালকা আবছা আলোতে চারপাশটা আরও মধুময় হয়ে উঠছে। কোনো কোলাহল নেই, শুধু মাঝে মাঝে নদীর মাঝখানটা দিয়ে পাল তোলা, পাল ছাড়া নৌকা বয়ে চলছে। পালহীন নৌকাগুলোর বৈঠার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ এতদুর থেকেই একটু আধটু শুনতে পাচ্ছি। অবশেষে দিনের আলো ফুরিয়ে আসলো, আর তখনই নদী যেন এক আলাদা রুপ ধারণ করলো। মাথার উপরের সন্ধ্যা চাঁদটা পানিতে প্রতিফলিত হয়ে হালকা বাতাসে মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুরে দুই একটা আলোর উৎস চোখে পড়তে আরম্ভ করেছে। খেয়া পারাপার আপাতত বন্ধ। সন্ধ্যের পর যে এই খানটা দিয়ে নৌকা যাওয়া আশা করে না এটার সবাই জানা। তবুও হঠাৎ করে দুই একটা নৌকা নিঃশব্দে চলে যায়।
এক মনে নদীর কালো পানিতে চাঁদের নৃত্য দেখছি। মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে গুনগুন সুরে গান বেরিয়ে আসছে। বাসায় ফেরার তাড়া নেই, একা মানুষ তাই বাঁধা বিপত্তি বলতেও কিছু নেই। যখন যা ইচ্ছে করতে মোর নেই মানা। তবে এই জায়গাটাতে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। একটু পরই এলাকার ছেলেরা এসে আড্ডা জমাবে। কিছু বলবে না ঠিক, কিন্তু তবুও বলা তো যায় না । নেশার ঘোরে দুই চারটা চড় থাপ্পার যে মারবে না তারই বা নিশ্চয়তা কি?
রাতের আঁধার যেন নদীকে গিলে খাচ্ছে। পানির রঙ এসে দাড়িয়েছে কালোতে। যেন কেউ পানিতে কলমের কালি ঢেলে দিয়েছে। কালো হলেও চাঁদের আলোতে বেশ চকচক। মাঝে মাঝে মাথার উপরের রুপালি চাঁদটা যখন মেঘের আড়ালে লুকাচ্ছে তখন যেন আশপাশটা আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বুঝলাম পিছনে কেউ একজন নিঃশব্দে এসে দাড়ালো।
আর পিছনে তাকাতেই শরীরে একটা ভয়ের শিহরণ খেলে গেল। একটা ছায়ামূর্তির মত কিছু দাড়িয়ে আছে। রাতে নাকি নদী তার প্রাণ ফিরে পায়, তারপর মেতে উঠে নিজের রণ খেলায়। ভুত প্রেত্নে বিশ্বাস একটু আধটু আছে। তবে কি…..!
– একটু শুনবেন?
কণ্ঠটা মেয়েলী কণ্ঠের। বেশ চিকন কণ্ঠ আর বেশ মার্জিত ভাষা। অন্ধকারে চেহারা যদিও দেখা যাচ্ছিলো না কিন্তু এই অন্ধকারে আর চাঁদের আবছা আলোতেও দেখে মনে মাঝারি গড়নের একটা মেয়ে। উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ” তো হবেই।
– জ্বী বলুন।
– আসলে,,,,
কথাটা বলেই একটু থামলো। তারপর একটু চুপ করে থাকা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু সংকোচ বোধ করছে। বাম হাতের ঘড়ির সাইটের একটা বাটনে চাপ দিতেই হালকা আলোতে সময় দেখিয়ে দিলো। অানমনে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত আটটা সাতাশ বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। এত রাতে মেয়ে ! বেশ অবাক লাগলো, আবার আরও একটা চিন্তা মাথায় আসলো। মেয়েটা কোনো কথা বলছে না দেখে আমিই বললাম,,
– আসলে আপনার একটু ভুল হচ্ছে বোধহয়। আপনি আমাকে যা ভাবছেন আমি তা নয়।
কথাটা বলতেই মেয়েটা তৎক্ষনাত বললো,,,
– না না আপনি ভুল করছেন। আমি তেমন মেয়ে নয়। আমি বড্ড বিপদে পড়েছি। আশেপাশে কাউকে দেখলামও না তাই আপনার কাছে আসলাম। যদি একটু এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন বড্ড ভালো হতো। একলা মেয়ে এই রাতে কোথায় যাবো বলুন তো।
মেয়েটার কথা বেশ সুন্দর। চিকন কণ্ঠের মাঝে ভাঙা ভাঙা ভাবটা যেন কথার মাধুর্য্য আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর তাছাড়া রাতের আধারে যে সব মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় এই মেয়ের কথাবার্তায় মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। তবুও বলা যায় না কার মনে কি আছে। আর তাছাড়া কারও কথায় তো আর……।
– আসবেন একটু?
কথাটা শুনে ঘোর কাটলো। যেতে বলছে? কোথায়? ডাকাত নাকি? যদি তাই হয় তবে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কারণ পকেটে বিশ টাকার তিনটা নোট আর এই ঘড়িটা ছাড়া নেওয়ার মত কিছুই নেই। কিন্তু তবুও ভয়, কিছু না পেয়ে যদি আমার সাথেই কিছু করে বসে! নাহ যাই না কি হয়। আর মেয়েটা যখন এত করে বলছে আমার যাওয়া উচিত। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগেই মেয়েটা আবার বললো,,
– ভয় নেই, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছি না।
– নাহ নাহ তেমন কিছুই না। আচ্ছা চলুন।
মেয়েটা আমার আগে আগে চলছে আমি পিছু পিছু। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি মেয়েটা যেখানে নিয়ে যাবে সেখানটাই আমার গন্তব্য। মেয়েটা কোনো কথা বলছে না নিঃশব্দে হেটে যাচ্ছে।
চারিদির নিস্তেজ। কোথাও টু শব্দও নেই। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি। এমন পরিবেশে হেটে চলছি দুইজন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। এবার আমি একটু হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য সামনে হেটে চলা মেয়েটার পাশাপাশি চলে একটু কথা বলা।
– আচ্ছা, অনেকক্ষণ তো হাটলাম। আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা জানলে খুব ভালো হতো।
– আর একটু সামনে ।
– সেখানে গিয়ে কি করবো?
– গেলেই বুঝবেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। পাশাপাশি হাটছি। মাথার উপর চাঁদটা এবার একটু তার আলোর উজ্জলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই আলোতে মেয়েটার মুখ পরিষ্কার দেখতে পেলাম। বেশ সুন্দর , বাঙালী মেয়েদের চেহারায় যে বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে সুন্দরী বলে ঠিক তেমনি।
– সামনে একটা লাশ পড়ে আছে।লাশটা একটা মেয়ের। আমি একা সেটাকে নিয়ে যেতে পারছি না। তাই আপনাকে আনা।
এবার বুকটা একটু কেঁপে উঠলো। লাশ ! এতো রাতে ! কথাটা ভাবতেই আবারও একবার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত খেলে গেলো।
– মেয়েটা কি আপনার পরিচিত?
কাপাকাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম। মেয়েটা আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। হেটেই চলছে।
আরও খানিকক্ষণ হাটার পর মেয়েটা তার হাটা থামিয়ে দিলো। তারপর বললো,
– ঐ যে ওইখানটায় মেয়েটার লাশ পড়ে আছে।
মেয়েটার কথায় সামনে তাকালাম। চাঁদে লুকোচুরিতে একটু দুরেই একটা কিছু পড়ে আছে বলে মনে হলো।
– কিন্তু….
পুরো কথা মুখ দিয়ে বের হলো না। দাড়িয়ে আছি একলা। আশেপাশে কেউ নেই। এমন কি মেয়েটাও নেই। এবার ভয় এসে বাসা বাধঁলো।
এক পা দুই পা করে সামনে এগিয়ে গেলাম। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আলো জ্বালাবো ঠিক তখনই কেউ পিছন থেকে বললো,
– আলো জ্বালাবেন না প্লিজ। আপনার শার্টটা আমাকে দিন। কারণ মেয়েটার শরীরে কিছু নেই।
পিছনে তাকাতেই দেখি সেই মেয়েটা।
– আরে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
– আশেপাশে দেখার চেষ্টা করলাম আর কেউ আছে নাকি। তাই…..
– আমি তো দেখলাম না।
– অন্ধকারে হয় তো দেখতে পাননি। দিন আর শার্টটা।
কোনো বাক্য ব্যয় না করেই শার্টটা খুলে দিলাম মেয়েটার হাতে।
– কাউকে ফোন দিতে পারবেন? যদি কেউ আসে তবে আপনার একটু সুবিধে হয়।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আমার এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। ফোন দেওয়ার ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় একটা গাড়ি আসলো। লাশটা নিয়ে আগে হাসপাতালে গেলাম। গাড়িতে মোট চারজন। আমি ঐ মেয়েটা আমার বন্ধু আর ড্রাইভার।
হাসপাতালে যেতেই ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করে বললো, নাড়ি নেই মারা গেছে।লাশটা এখনও দেখা হয়নি। একটু পরই পুলিশ আসলো। মেয়েটার বডি সাদা কাপড়ে ঢাকা। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ লাশটা দেখার জন্য মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরাতেই আতকে উঠলাম। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার শক্তি মনে হয় হারিয়ে ফেলেছি। লাশের মুখের উপর থেকে কাপড় সরতেই দেখলাম সেই আলো আধারীতে দেখা মেয়েটাই শুয়ে আছে। চোখটা বন্ধ। যেন ঘুমাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে পাশে তাকালাম। কারণ মেয়েটা আমার পাশেই বসে ছিলো। কিন্তু সেইদিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটা তখনও বসে আছে। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছে। আমি তাকাতেই আমার দিকে একবার মাথা উচু করে তাকালে। তারপর আস্তে আস্তে বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেলো।
– সুদ্বীপ
– বল,
– আমাদের সাথে কোনো মেয়ে এসেছিলো?
– কই না তো, তুই তো ফোন দিলি তারপর লাশটা নিয়ে আসলাম। কেন কি হইছে?
– উম, না কিছু না।
হাটছি, পাশে সুদ্বীপ।
ভাবছি, কার সাথে হেটে আসলাম লাশের কাছে? সবই কি ভুল? হবে হয় তো। কিন্তু……
“হি হি হি হি আপনাকে ধন্যবাদ।”
কানের কাছে কেউ এসে ফিসফিস করে কথাটা বললো কেউ। হয়তো কৃতজ্ঞতায়।
কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই গেলো। মেয়েটা কি নিজের লাশের খোজ নিজেই দিয়ে গেল? যদি তাই হয় তবে আমাকেই কেন? জানা নেই।