বাবা টাকা দিবা না?
– কিসের টাকা? ওমা…!! ঈদের শপিং করবো না?
– ওহহোওওও,,, হুম দিব। কালই দিয়ে দিব। আসলে এখনও টাকা পাই নাই রে মা।( বাবা মন খারাপ করে বললো )
আমি মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে আসলাম।আর কিছু বললাম না।
আড়ালে গিয়ে শুনতে পেলাম মা ফিসফিস করে বাবাকে কি যেন বলছে।বাবা মায়ের কথা আড়ি পেতে শোনা ঠিক না,, তবুও শুনলাম। মা বাবাকে বলছে, তুমি শুধু শুধু মেয়েটাকে মিথ্যা আশ্বাস কেন দিচ্ছো? তুমি টাকা দিতে পারবা না এখনই ওরে বলে দাও। পরে তো আরও বেশি কষ্ট পাবে মেয়েটা।
বাবা : এত কথা বইলো না তো। আমি চেষ্টা করতেছি কিভাবে টাকার ব্যবস্থা করা যায়।
মা : যদি না পারো?
বাবা: আগেভাগেই এগুলা বইলো না। শেষ চেষ্টা করে দেখি যদি পারি।
কথাগুলো বলতে গিয়ে বাবার গলা ভীষণ রকম কাঁপছে। কথা জড়িয়ে আসছে। আমার চোখেও পানি টলমল করছে।
এইসময় কি বলা উচিত বা কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। ও হ্যাঁ,, আমার পরিচয় দেয়া হয় নি। আমি তৃষা। আমার পরিবারে আমরা ৩জনই সদস্য। বাবা,মা আর আমি। আমার কোনো ভাইবোন নেই। ছোটবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি। ভাইবোন না থাকায় সব কিছুতেই রাজত্ব ছিল আমার। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় কখনো কিছুতে না শুনিনি। যা বলতাম তাই করতো বাবা মা। যা চাইতাম তাই পেতাম। যেভাবেই হোক আমাকে এনে দিত। আমার বাবা গাড়ি চালাতো। যাকে বলে ড্রাইভার। তবুও খুব ভালোই ছিলাম আমরা। হঠাৎ কয়েকবছর যাবৎ খুবই দুরবস্থা আমাদের।
যাক আসল কথায় ফিরে আসি,, বাবার কথাগুলো শুনে মন ভীষণ রকমের খারাপ। সারাদিন ঘরে মনমরা হয়ে পড়ে রইলাম। কারো সাথে কোনো কথাও বললাম না। মাকে ইফতার বানাতে সাহায্য করতেও গেলাম না।। ভাবছি কি করা যায়। তবুও নতুন জামা কেনার ইচ্ছাটা যেন মাথা থেকে সরাতেই পারছি না। নতুন জামা পেতেই হবে আমার।
ঈদের পরদিন সব কাজিনরা মিলে ঘুরতে বের হব। বান্ধবীদের নিয়েও ঘুরবো। সবাই দামি দামি নতুন জামা পরে আসবে। আমি কিছু না কিনলে তাদের সামনে কিভাবে দাঁড়াবো? ওদের সামনে যে আমি বড়ই বেমানান। কোথায় ওরা আর কোথায় আমি। তার মধ্যে যদি একটা নতুন জামা না থাকে? ওদের কে যে আমি বলবো, আমি যাবো না তোরা যা। তাতেও অনেক কথা শোনাবে। কোনদিকে যে যাই আমি। গতবছরেও বাবা আমাকে কোনো ঈদেই নতুন জামা দেয় নি। আমি টিউশনির টাকা থেকে জমিয়ে জামা কিনেছিলাম, আম্মুকেও একটা শাড়ি দিয়েছিলাম আর বাবার হাতে ৫০০ কি ৭০০ টাকা দিয়েছিলাম। ঠিক মনে নেই।
এবারও তাই করতাম যদি আমার কাছে থাকতো। তাই বলে বাবা টাকা দিবে না এটা কেমন কথা?? এসব ভাবতে ভাবতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল। গেলাম,সবার সাথে ইফতার করলাম, কারো সাথে কোনো কথা না বলেই ইফতার করে চলে গেলেন নিজের রুমে।তারপর রাতেও কিছু খেলাম না।না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম ভাঙলো।আজ ২৯ রোজা।আজি সম্ভবত চাঁদরাত। ভাবছি, টাকাটা কি আজকে দিবে বাবা? একবার কি গিয়ে জিজ্ঞেস করবো? না থাক, পরে লজ্জায় পড়ে যাবে,, দরকার নেই। সারাদিন গেল, ইফতারের সময় হয়ে এল। তবুও বাবা বাসায় আসছে না। মনে একটা অজানা আশা বাসা বাঁধছে। হয়ত টাকার ব্যবস্থা করছে বাবা তাই বাসায় আসতে দেরি হচ্ছে। ইফতারের পর ঠিকই বাবা টাকা নিয়ে আসবে। আমার কাছে এসে বলবে,, এই নে মা.. তুই ঈদের শপিং করতে যা। ইচ্ছেমত শপিং করে নিয়ে আয়। নতুন জামা কিনে নিয়ে আয়।
আমি আর মা ইফতার করে বাবার অপেক্ষায় বসে আছি।কখন বাবা আসবে। রাত তখন ৮টা বাজে, এখনও বাবা আসছে না। অপেক্ষার প্রহর গুনছি। বাবা আসছে না। এভাবে করে ৯টা,১০টা,১১টা,১২ট সারারাত কেটে যায়,,বাবা আর আসলো না। আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। নতুন জামার ইচ্ছেটাও মাটি হল। এখন আর অপেক্ষা নয়,, চিন্তা করছি বাবা কোথায়? বাবা কখন আসবে? ঈদের দিন ভোরে মায়ের ফোনে একটা ফোন,, কিছুক্ষণ পর মায়ের একটা চিৎকার। তারপর সব শেষ।
নিমিষেই চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে।। অতীত ভাহছে চোখের সামনে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মার্কেটে যাওয়া, নতুন জামা কিনে নিয়ে আসা, ঈদের দিন বিকেলে বাবার হাত ধরে হাঁটতে যাওয়া,, আইসক্রিম খাওয়া আর অনেক অনেক গল্প করা।। এরপর থেকে কখনই আর ঈদে নতুন জামা কিনি না এভাবেই প্রতিনিয়ত শেষ হয়ে যায় হাজারো মধ্যবিত্ত পরিবারের সব স্বপ্ন,আশা, আকাঙ্ক্ষা,হাসি, গল্প।।