বাথরুমে বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ গার্লফ্রেন্ডের ম্যাসেজ এল, “খোদার কসম, তোমার মায়ের কসম, আমার কসম। তিন কসম। তুমি যেইখানে আছো সেখান থেকে এক ইঞ্চিও নড়বে না। নড়লে আমার আর তোমার মায়ের মরা মুখ দেখবা। আর মিথ্যা কথাও বলবা না। এক মিনিটের মধ্যে উত্তর দাও। তুমি এখন কই আছো আর কী করতেছ?” ম্যাসেজটা দেখে আমি যেন আকাশ থেকে কমডে পড়লাম। এইটা কেমন ম্যাসেজ! আমি এখন কই আছি, আর কী করতেছি এইটা ওরে কেমনে বলি? তার উপর এত বড় কসম। আমার শরীর ঘামতে শুরু করল। ঘামে শরীরের শেষ সম্বল গেঞ্জিটাও খুলে ছুরে ফেললাম।
এক মিনিট সময় যে এত দ্রুত যায় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। এখন মিথ্যা কথাও বলা যাবে না। আমার মা এবং গার্লফ্রেন্ডের বাঁচা মরা এখন আমার হাতে। ৪০ সেকেণ্ড ভরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলাম কী করা যায়। সত্যি কথা বললেতো আমার মান-সম্মান কিছুই আর থাকবে না। অবশ্য একসম বাথরুমে বসে মোবাইল চালানটা মানুষের চোখে পাপ ছোট কাজ মনে হলেও আধুনিক ছেলে-মেয়েরা এটাকে কমন করে ফেলেছে। এছাড়া আমার মা আর গার্লফ্রেন্ডের জীবন থেকে আমার মান-সম্মান বড় না। ৫৭.৫ সেকেণ্ড চলে যেতেই আমি বিদ্যুৎ গতিতে রিপ্লাই দিলাম, ” বাবু, আমি কমডে। হাগতাছি।”
সাথে সাথেই অনেকগুলো রাগের ইমুজির সাথে সে রিপ্লাই দিল, ” আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি সেলফি তুলে পাঠাও।” এবার বাথরুমের ছাদ ফেটে আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। এইটা কেমন কথা! আমার পুরো খালি গা। গেঞ্জিটাও নিচে পড়ে ভিজে আছে। এমন সময় সেলফি তুলব কেমনে! কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। গার্লফ্রেন্ডের বিশ্বাস আমায় অর্জন করতেই হবে। হবু বউয়ের সামনে খালি গা কোনো ব্যাপার না। আমি অনেক কষ্টে হাসার চেষ্টা করে কয়েকটা সেলফি তুলে তাকে পাঠালাম। তাতেও ওর মন ভরল না। আবারও রাগের ইমুর সাথে, ” আমি তোমায় বিশ্বাস করিনা। এইগুলো হয়তো পুরনো ছবি। খবরদার তুমি নড়বা না। যেখানে আছ সেখান থেকেই একটা ভিডিও কল দাও।” এবার আমি স্পষ্ট নিজের মনের ভেতর ঘুর্ণিঝড়ের তোল-পাড়ের শব্দ শুনতে পেলাম, বঙ্গপসাগরের ঢেউ যেন মাথায় আঁচড়ে পড়ছে, সাথে বজ্রাঘাত। সে তো আমাকে এত সন্দেহ কখনই করে নাই। ডাইলে নিশ্চই কিছু কালা আছে। আমি রিপ্লাই করলাম, “বাবু, কী হইছে বলতো? তুমিতো এমন ছিলা না! হঠাৎ আমাকে সন্দেহ করার ওপর পি.এইচ,ডি করতেছ কেন?” সে, ” তোমাকে সন্দেহ করব নাতো কাকে করব?
তোমাকে বললাম এই ঈদে একটা জামা কিনে দিতে। কিন্তু তুমি বললা, তোমার আম্মু এই ঈদে তোমারে শপিং এর টাকা দেয় নাই। তাই একা একাই শপিং করতে মার্কেটে আসছি। মার্কেটে ঢোকা মাত্রই দেখলাম তুমি একটা মেয়ের হাত ধরে মার্কেটে হাঁটতেছ। ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করতে গিয়ে দেখি তুমি নাই। ছিঃ ছিঃ মাসুদ ছিঃ। আমার জন্য শপিং করার টাকা তোমার নাই। অথচ অন্য মেয়ে!” আমি দ্রুত রিপ্লাই দিলাম, ” বিশ্বাস করো বাবু! আমি এক ঘণ্টা ১৩ মিনিট ধরে বাথরুমে বসে আছি। পৃথিবীতে এক রকম দেখতে ৭ জন মানুষ থাকে। তুমি হয়তো সেই রকম আমার কপি কাউরে দেখছ। পৃথিবীতে মোট ৩৭টা চেহারা মৌলিক। বাকি গুলা এইগুলার মিশ্রন। আমার চেহারাটা মৌলিক মনে হয়। আমার চেহারার ছাপ আছে এমন কাউরেও তো দেখতে পারো!”
অনেক যুক্তি তর্ক করেও তারে বুঝাতে পারলাম না যে আমি মার্কেটে নেই, বাথরুমে আছি। শেষে বাধ্য হয়েই ভিডিও কল দিতে রাজি হই। অনেক সাবধানে মোবাইলটা ধরলাম। কথা বলতে বলতে মোবাইল একটু বাঁকা হইলেই ইজ্জতের সাড়ে সর্বনাশ।
প্রথম বার কল দিলাম ধরল না। দ্বিতীয় বাড়ে ধরল। আমি মোবাইলের স্ক্রীনে যা দেখলাম বড়লোক হলে আমার হাত থেকে মোবাইলটা ছুটে নিচে পড়ে যেত। গরিব বলে শক্ত করে ধরে রাখলাম মোবাইলটা। মোবাইলের স্ক্রীনে আমার মা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো, না! এটা কিছুতেই হতে পারে না। বলে চিৎকার করতে করতে কলটা কেঁটে দিলাম।মাথায় কিছুতেই ঢুকতেছে না শম্মীর মোবাইল মার কাছে আসল কেমনে! ভিডিও কলে মা! দ্রুত কাজ সেড়ে লুঙ্গী পরে এক দৌড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। মা ড্রয়িং রুমে সোফায় মোবাইল হাতে বসে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মার পাশেই সোফায় বসে আছে শম্মী। আমিতো পুরাই অবাক।
আমি বাথরুমে গিয়েছি মাত্র (?) এক ঘণ্টা ১৩ মিনিট হয়েছে। এর মধ্যেই শম্মী আমার বাড়িতে ঢুকে আমার মায়ের সাথে খাতির জমাই ফেলেছে কেমনে! শম্মীরে তো আগে আমার মা কখনও দেখেনি। কয়দিন আগে মাত্র তাকে আমার বাড়ি চিনিয়েছি। আমি চিৎকার করে বললাম, শম্মী তোমার এত বড় সাহস! তুমি আমার অনুমতি ছাড়া আমার বাড়িতে আসছ! আবার আমি বাথরুমে আছি জেনেও এতক্ষণ আজগুবি কথা বইলা শুধু শুধু আমারে টেনশনে ফেলাইয়া বোকা বানাইছ! আমি তোমারে খুন কইরা ফেলমু। মনে মনে চিৎকার করে এই কথাগুলো বলায় কেউ কিছুই শুনতে পেল না। মা বড় চোখ আরও বড় করে রাগি কণ্ঠে বললেন, এর জন্যই তোর বাথরুমে এত টাইম লাগে! পৃথিবীতে কী এমন কোনো জায়গা নাই, যেইখানে তুই থাকলে তোর থেকে তোর মোবাইল মুক্তি পাইব? বাথরুমে গিয়াও! ছিঃ ছিঃ।
ভাগ্যিস ম্যাডাম পুরো সর্বনাশ হওয়ার আগেই আইসা আমারে সতর্ক করল! আমার ইজ্জতের ফেলুদা হয়ে গিয়েছে। ম্যাডাম! ম্যাডামটা আবার কে? দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য আমার! আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার মা আমাকেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন! মা বেশ উৎসাহ নিয়েই বলছেন, এই ম্যাডামটা একটা এন.জি.ও তে চাকরী করেন। তারা গবেষণা করে জানতে পেরেছেন বেশি মোবাইল চালালে মৃত্যুর ঝুকি বেড়ে যায়। এরা ইন্টারনেট থেকে কারা বেশি মোবাইল চালায় তাদের একটা লিস্ট করেছে। লিস্টে তোর নাম সবার উপরের দিকে আছে। তাই এই মেয়েটা আমাকে সতর্ক করে দিতে এখানে আসছে। আর একটা দুঃখের কথা শোন এই ম্যাডামের ছোট ভাইও প্রচুর মোবাইল চালাইত। তাই কিডনী সমস্যায় পইড়া মারা গেছে ৩ বছর আগে। তারপর থিকাই সে এই কাজ শুরু করে। আমার কথাতো শুনোস না। দিন নাই রাত নাই সারাদিন খালি মোবাইল। এইবার বিশ্বাস হইল তো?
একে নাঁচুনী বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি। আমার মা এমনিতেই মোবাইল চালানোর জন্য সারাদিন আমাকে বকে। তার উপর শম্মী এর উপর ফতোয়া দিয়ে দিয়েছে। এই ভাবে তাহলে খাতির জমিয়েছে! শম্মীর কোনো জন্মেই কোনো ছোট ভাই ছিল না। সবই আঁজগুবি কথা। শপিং করে দেই নি বলে এত বড় শাস্তি!
মা জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছে মোবাইল চালানোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে। শম্মীও সমানে সায় দিয়ে যাচ্ছে। এবার মনে মনে কথা বলা বাদ দিয়ে সাহস করে বলে ফেললাম মাকে, নেশা কী শুধু আমার একার? আপনিও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টার জলসা আর জি বাংলা নিয়ে পড়ে থাকেন! তখন কিছুই হয় না? আমি করলেই দোষ! মুহুর্তের মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কথা বলা বন্ধ। আমার মুখে বিজয়ীর হাসি। সাথে সাথেই শম্মী আবার মাকে বলতে শুরু করে, আমরা এটা নিয়েও গবেষণা করেছি ম্যাডাম। মেয়েরা সারাদিন থাকে বাড়িতে। করে ঘরের নানান কাজকর্ম। তাদের একটু মানসিক শান্তির প্রয়োজন। এর জন্য স্টার জলসা আর জি বাংলার বিকল্প নাই। মন ভালো তো শরীর ভালো। টিভি দেখতে পারেন আপনি ম্যাডাম। এটা বিপদমুক্ত। মা এবার মুগ্ধ , অভিভূত দৃষ্টিতে শম্মীর দিকে তাকিয়ে রইল। না পারে তার সবকিছু মেয়েটাকে দিয়ে দেয়।
দুজনেই তারপর আমাকে জ্ঞান দিয়ে আমার জ্ঞানের পুকুরটাকে সাগর বানিয়ে ফেলেছে। জ্ঞান দেওয়া শেষে শম্মী মাকে বলল, আজ আসি ম্যাডাম। আমাকে আবার আরেকটা বাড়িতে যেতে হবে আরেকটা গর্দভকে শিক্ষা দিতে। আপনার ছেলেকে বলুন আমাকে একটু এগিয়ে দিতে। আপনাদের গলিতো কুকুর দিয়ে ভরা! মা কড়া গলায় আমাকে হুকুম দিলেন ম্যাডামকে এগিয়ে দিয়ে আসতে। আমি আর উপায় না দেখে শার্ট-প্যান্ট পরে শম্মীর সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির গলিটা পাড় হতেই কড়া চোখে শম্মীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, এসবের মানে কী? সে হাসতে হাসতে বলল, তুমি এত কিপ্টা কেন বলতো? তোমার মা বলল তোমাকে চার হাজার টাকা দিছে শপিং এর জন্য। ছেলেদের এত টাকা লাগে? ১৫০০ টাকাই যথেষ্ট। আমার না একটা ড্রেস খুব পছন্দ হইছে। ঐটা এখন তুমি আমায় কিনে দিবা। এত খাটা-খাটনি করলাম এর একটা মূল্য আছে না? তোরে বলছে কে খাটা খাটনি করতে, মনে মনে। আমার উত্তরের অপেক্ষায় আর থাকে কে! একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে আমাকে প্রায় জোর করেই রিক্সায় উঠিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
মার্কেটের সামনে নেমে রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিতেই আনন্দে আমার মন নেঁচে উঠে। একদিন কলেজে ক্লাস চলাকালে মোবাইল চালানোর অভিযোগে আমার মোবাইল জব্দ করে রেখে দেয় ক্লাশ শিক্ষক। সেইদিনই বাড়ি ফেরার পথে একটা ছিনতাইকারী আমায় ধরে। কিন্তু মোবাইলতো স্যারের কাছে। সেই দিনও এতটা আনন্দ লাগেনি যতটা না আজ পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ না পেয়ে লাগছে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসায় মানি ব্যাগ আনতে ভূলে গেছি। হুররে! নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। প্রথমে মুঁচকি হাসলাম, তারপর মধ্যম হাসি, উচ্চস্বরে হাসি, অতি উচ্চস্বরে হাসি, হাসতেই থাকলাম। শম্মী প্রথমে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে প্রথমেই অতি উচ্চস্বরে হাসতে লাগল, তারপর মধ্যম স্বরে, তারপর হাসি থামিয়ে তার ব্যাগ থেকে আমার মানিব্যাগটা বের করে মুচকি হেসে বলল, আমি জানতাম তোমার এইটার কথা মনে থাকবে না। তাই তুমি বাথরুমে থাকতেই এইটা মনে করে আমি ব্যাগে ভরে নিয়েছি। পুরো টাকাটাই দেখি মানিব্যাগে রেখেছ। যদি চোর নিয়ে যেত! আমি বললাম, তোমার মতো ডাকাত থাকতে চোর আসবে কোত্থেকে! মনে মনে বলায় এইটাও শম্মী শুনতে পায়নি।