নতুন জামা

নতুন জামা

— মা, এবারের ঈদে কি নতুন জামা কিনে দিবা না?

ছয় বছরের মেয়ে নিঝুমের মুখে কথাটি শুনে চোখের কোনে টলমল করা জল গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আমেনা বেগমের। আমেনা খুব ভালো করেই জানে এবারের ঈদে ও ছোট্ট মেয়েটাকে নতুন জামা পড়ানো হবে না। অনেক সখ ছিলো অন্তত এবারের ঈদে নতুন জামার রং এ নিঝুম কে রাঙ্গিয়ে তোলা৷ কিন্তু নিঝুমের ঔষধের খরচ, সাংসারিক খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় আমেনার৷ সারাদিন বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে মাস শেষে যে টাকা আসে তার পুরোটাই চলে যায় নিঝুমের ঔষধের খরচে৷ ঈদে বেতন পেলেও কোন বাসা থেকে বেতন বাড়িয়ে দেয়নি৷ আমেনা ভেবে রেখেছিলো ঈদে যদি কেউ বোনাস দেয় তাহলে সে টাকা দিয়ে নিঝুমকে নতুন জামা কিনে দিবে৷ কিন্তু সেটা আর হলো না৷  নিঝুমের কথায় কোন উত্তর দিলো না আমেনা৷ নিঝুম আবারো বললো ;

— মা, ও মা! আমেনা চোখের জল মুছে উত্তর দিলো ;
– বল মা
— ঈদে নতুন জামা কিনে দিবা না৷
– দিবো রে মা।
— জানো মা,

রুহির বাবা রুহির জন্য লাল রংয়ের সুন্দর একটা জামা এনেছে। রুহি সেটা আমাকে দেখিয়ে বললো ওর বাবা নাকি ঈদে লাল রংয়ের জামা ছাড়াও আরেকটা জামা এনেছে৷ মা, তুমি আমাকে একটা জামা এনে দেওগো মা৷ আমি আমার ঈদের জামা দেখিয়ে রুহি কে বলবো ” তোমার জামা থেকেও আমার জামা অনেক অনেক সুন্দর।”

আমেনার চোখে জল এবার আরো ঝুম বৃষ্টি গতিতে পড়তে লাগলো। আমেনা ভাবতে লাগলো ” একটা জামা পেলে কত খুশিই না হতো মেয়েটা৷” দুপুর বেলা নিঝুম কে খুব মেরেছে আমেনা৷ নিঝুমের নতুন জামার বায়না ধিরে ধিরে বেড়েই চলেছে।  আমেনা সইতে না পেরে নিঝুমের অসুস্থ শরীরে মার বসিয়ে দিলো৷ ঘরের কোনে বসে চোখের জল ঝাড়াচ্ছে আমেনা৷ নিঝুমের চোখের জল সইতে পারে না। ” আল্লাহ কি ভুল ছিলো আমার, কেনো এত পরিক্ষা নিচ্ছো আমার ” কথাগুলো চিৎকার করে বলতে গিয়ে থেমে গেলো আমেনা৷ আমেনা ভাগ্য বিশ্বাস না করলেও এখন ভাগ্য মেনে নিয়েছে, বিশ্বাস করেছে৷

রাত নেমে আসছে, নিঝুম ঘুমাচ্ছে। আমেনা বাসা থেকে বের হলো কাজের সন্ধানে। যদি কোন একটা কাজ পাওয়া যায় আর তাতে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায় তার আশায়। সাত বছরের মেয়ে আলো কে খুজে পাচ্ছে না আবির আর ফারিয়া। বিকাল বেলা মার্কেটে যাওয়ার পর ভিড়ের মধ্যে হাত ফসকে আলো হারিয়ে যায়। অনেক খোজাখুজি করার পরেও আলো কে খুঁজে পেলো না আবির, ফারিয়া। মন খারাপ করে বাসায় বসে আছে আবির আর ফারিয়া৷ কারো মুখেই কোন কথা নেই৷ একমাত্র মেয়ে আলো কে হারিয়ে মুখের ভাষা ও হারিয়ে ফেলতে চলছে দু’জনে। পুলিশকে জানানো হয়েছে, পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে তারা সর্বোচ্চ সহযোগীতা করবে৷ কিন্তু পুলিশের আশ্বাসে মোটেও ভরসা পাচ্ছে না আবির আর ফারিয়া।  কলিংবেলের শব্দের আওয়াজ কানে আসলো আবির, ফারিয়া দু’জনেরই। ফারিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো৷ দরজার সামনে আলো দাড়িয়ে আছে। পিছনে এক মহিলা দাড়িয়ে আছে। ফারিয়া কান্না চোখ জরিয়ে নিলো আলোকে৷ জরিয়ে নিয়ে আলোর কপালে আদর করতে লাগলো৷ আবির আর ফারিয়ার মাঝখানে আলো বসে আছে। আর তাদের সামনে ময়লা জামাকাপর পড়া আমেনা বসে আছে। ফারিয়া আমেনাকে উদ্দেশ্য করে বললো ;

— আপনি আমার আলো কে কোথায় পেলেন? আমেনা বললো ;

– ম্যাডাম, রাস্তার এক কোনে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। সামনে এগিয়ে দেখি একটা মেয়ে কান্না করছে। পরে ওকে জিগ্যেস করলাম কেনো কান্না করছে৷ মেয়েটি বললো ‘ ও ওর বাবা মাকে হারিয়ে ফেলছে ‘ পরে ওকে জিগ্যেস করলাম বাসার ঠিকানা জানে কিনা। ও বললো ঠিকানা জানে৷ ঢাকার এত বড় শহরের মধ্যে পথ চিনে বাড়ি ফেরা মুশকিল, তাই ওকে ওর দেওয়া ঠিকানা মতোই নিয়ে আসলাম৷

আমেনার কথা শেষ হতেই একবার আবির আলোকে আদর করছে আবার একবার ফারিয়া আদর করে মায়ায় জরিয়ে নিচ্ছে। এসব দেখে অজান্তেই চোখের কোনে জল চলে আসলো আমেনার৷ আমেনার চোখে জল দেখে আবির বললো ;

— আপনি কান্না করছেন কেনো? আমেনা চোখের জল মুছে উত্তর দিলো ;

– স্যার, আপনাদের আলোর মতোই আমার একটা মেয়ে আছে, নাম নিঝুম। স্যার আমার মেয়েটা অসুস্থ। কখনো কিছু দিতে পারিনা। খুব বায়না করছিলো ঈদের জন্য একটা নতুন জামা কিনে দিতে। কিন্তু পারিনি স্যার৷ নিঝুমের ঔষধের খরচ, সাথে সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে নিঝুমের জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি৷ দুপুরে মেয়েটা খুব কান্না করছিলো নতুন জামার জন্য। ওর কান্না সইতে না পেরে মার বসিয়ে দেই। পরে সন্ধ্যা নামলে বের হই কাজের সন্ধানে। তারপর তো আপনাদের আলোর সাথে দেখা আমেনার কথা শেষ না হতেই ফারিয়া রুমের দিকে অগ্রসর হলো৷ রুম থেকে ফেরার সময় একটা শপিংয়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরলো৷ ফিরে এসেই আমেনার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বললো ” এর মধ্যে নিঝুমের জন্য নতুন জামা আছে আর তোমার জন্য একটা শাড়ি আছে।” আমেনার চোখ ছলছল করছে। আমেনা ফারিয়া কে জরিয়ে ধরলো। তারপর বললো ;

– আপনাদের এই ঋণ কখনো ভুলবো না আমি৷  ফারিয়া বললো ;
— আমাদের না, উল্টো আমরা তোমার ঋণ কখনো ভুলতে পারবো না। তোমার কারনেই আমরা আবার আমাদের আলোকে খুজে পেয়েছি৷ ধন্যবাদ দিয়ে তোমার এই ঋণ ছোট করবো না৷

ফারিয়ার কথা শুনে কান্না চলে আসলো আমেনার মুখে। ফারিয়া আমেনার হাতে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বললো “ঈদে কিন্তু অবশ্যই নিঝুম কে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। ” আমেনা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো ঠিক আছে। আমেনা বাসায় ফিরছে৷ বাসায় ফেরার সময় নিঝুমের পছন্দের সেমাইর প্যাকেট নিয়ে ফিরলো। নিঝুম এখনো ঘুম যাচ্ছে। ফারিয়ার দেয়া নতুন জামাটি নিঝুমের বালিশের পাশে রাখলো। আমেনা কান্না চোখে ভাবতে লাগলো” হয়তো সকাল হলে নতুন জামা পেয়ে নিঝুম খুব খুশি হবে।” সকালবেলা নতুন জামা পেয়ে খুবই খুশি হলো নিঝুম। নতুন জামা পেয়ে মাকে জরিয়ে ধরে আদর করতে লাগলো ছোট্ট নিঝুম। নিঝুম বললো ” মা আমি আমার নতুন জামা রুহি কে দেখিয়ে আসি, আর নতুন জামা দেখিয়ে বললো ওর থেকেও আমার জামা অনেক অনেক সুন্দর।” নিঝুমের পাগলামি আর হাসি মুখ দেখে আমেনার চোখে জল চলে আসলো৷ হয়তো এই চোখের জল সুখের৷ এই সুখ কখনো শেষ হবার নয়৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত