এতদিন এ পাড়ায় সুন্দরী বলতে সবাই তৃণাকেই জানত। বেশিরভাগ ছেলে বুড়ো তৃণাবৌদির ফ্যান ছিল। আর তৃণার বর সৌরভ তো মার্কামারা ছিল বৌমুখো বলে। বৌ ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখত না কোনদিন।
একটা বিরাট বড় দোতলা বাড়িতে থাকত সৌরভরা দুটি মাত্র প্রাণী। কি সব ব্যবসা করত সৌরভ। সেই কাজে ব্যবহার করত একতলাটা। দোতলায় থাকত দুজনে।
সৌরভদের পাশের বাড়িটা সুধীরদের। একই রকম বিরাট দোতলা বাড়ি। থাকে সেখানেও সেই দুটি প্রাণী। অবিবাহিত সুধীর আর তার বিধবা বুড়ি মা। দোতলায় থাকে। বিয়ের বয়েস হয়েছে সুধীরের। কিন্তু পয়সার অভাবে বিয়ে করতে পারে নি। একতলাটা ভাড়া দেয়। সাধারণতঃ দু ঘর ভাড়াটে থাকে তাদের। তিন তিন ছ’হাজার টাকা ভাড়া পায়। আর আছে সুধীরের মায়ের কিছু এমআইএস। তার সুদ আর এই ভাড়ার পয়সায় কোনরকমে কষ্টেসৃষ্টে চলে যায় মা ব্যাটার। সুধীর টুংটাং দালালী করে। ঘুরে মরাই সার। হাত খরচটা ওঠে কোনরকমে। নেহাৎ ঘরে বসে থাকলে লোকে বলবে বেকার, তাই। তা এহেন অবস্থায় সুধীরদের ভাড়া উঠে গেল। প্রায় আগুপিছু দু ঘরই।
ওরা বেশ আতান্তরে পড়ে গেল। খাবে কি সামনের মাসে। তবে বেশি চিন্তা করতে হয় নি। এক দালাল নতুন ভাড়াটে নিয়ে এল। দুই বোন, আর কেউ নেই। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। দুজনেই অফিসে কাজ করে। বাড়ি দেখতে এসে পছন্দ হয়ে গেল দুই বোনের। পুরো একতলাটাই ভাড়া নেবে। সুযোগ বুঝে সুধীরের মা দশ হাজার দর হাঁকল। ওমা! তাতেই রাজী। এমনিতে একতলাটা কেমন যেন এঁদোপুরী, অন্ধকার। বদ্ধ, আলো বাতাস খেলে না বলে ভাড়াটে টেঁকেনা। তা কি দেখে যে ওদের পছন্দ হল কে জানে। বোধহয় সামনে পেছনে অনেকটা উঠোন, কুয়োতলা, মিউনিসিপ্যালিটির কল, আবার বাথরুমে পাম্পের জল আসে ওভারহেড ট্যাঙ্ক থেকে, জলের এই সুখ দেখেই রাজী হল। যাই হোক, ক’দিন পরেই এসে গেল সুধীরদের নতুন ভাড়াটে। আর পাড়ার যত ব্যাটাছেলে আর তাদের বাড়ির মেয়েদের ঘুম ছুটল।
দুই বোন, বড় স্বপ্না, ছোট শবনম। বয়েস যে কত, সঠিক কেউ বলতে পারবে না। তবে দেখে মনে হয়, পঁচিশ থেকে তিরিশের ভেতরে। নেহাৎ শবনম স্বপ্নাকে দিদি ডাকে তাই। নইলে কে ছোট কে বড়, বলা মুশকিল। যেন দুই সখি। দুজনেরই শরীর যৌবন জোয়ারে ভরা নদীর মত থমথম করছে। গা ছমছমে রূপ। মাথায় বিরাট চুল, কোমর ছাপিয়ে প্রায় হাঁটু অব্দি। ইয়া মোটা বিনুনী করে দুজনে। কখনো বা নানা রকম হেয়ার স্টাইল করে সেই চুল গুছিয়ে রাখে। স্বপ্নার কাটা কাটা নাক মুখ, ধারাল চোখ। শবনমের গোলগাল মিষ্টি মিষ্টি মুখ। দুজনেই হাবে ভাবে দারুণ আবেদনময়ী। সোম থেকে শুক্কুর, অফিস যাবার বা ফেরার পথে হেসে হেসে গল্প করে পাড়ার লোকের সঙ্গে।
রসিকতায় ঢলে পড়ে। আর তেমনি পোশাক আশাক। দু বোনে একই রকম পরে রোজ। কোনদিন জিনস্ টপ। টপের তলায় একাদশীর চাঁদের মত একফালি পিঠ পেট বেরিয়ে থাকে। কোনদিন লেগিংস আর কুর্তা। কোনদিন চুড়িদার। পাড়ার যত ছোট ছেলে, আধলা ছেলে, ধেড়ে ছেলে, বুড়ো ছেলে, সব হেদিয়ে মরে দেখে। আবার শখ করে একেক দিন শাড়ীও পরে স্লিভলেস ব্লাউজ দিয়ে। ভোজপুরী সিনেমার হিরোইনদের চোলির মত সেসব ব্লাউজ কোন দর্জিকে দিয়ে করায়, ভেবে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরে পাড়ার বৌ-ঝিরা। তারকের মা, টেঁপির মারা তাদের ঘরে এসে বাসন মাজতে মাজতে বলে,
:- ছেনাল গো ছেনাল! এই তো আমাদের তিরনা বৌদিও রয়েচে পাড়ায়। সেও কি কম সুন্দুরি! কুনোদিন পাড়ার নুকের সঙ্গে একটা ছ্যাবলেমি করে নিকো। সব সমায় নিজের গ্যাবিটি নিয়ে থাকে। হুঁহ্, কালে কালে কতই দেকব!
তার তালে তাল দেয় পাড়ার বৌ-ঝিরা। সব থেকে কষ্ট সুধীরের। মাথার ওপরে ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। নেহাৎ পেটের দায়ে বেরোতে হয় তাই। নইলে বাড়ি ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে করে না আজকাল।
দু বোনের আবার ফুল গাছের শখ। আসার ক’দিনের মধ্যেই আব্দার করেছিল সুধীরের কাছে, সামনের উঠোনে আর পেছনের কুয়োতলায় ক’টা ফুলের টব দিয়ে বাগান করবে। বলা বাহুল্য, দুই সুন্দরীর মিষ্টি মুখের সেই আব্দার ফেলতে পারে নি সুধীর। একে একে ছোট বড় টব এসে হাজির হল। তাতে নাম না জানা কত গাছ। কি তাদের ফুলের বাহার। কোনটায় গোলাপী, তো কোনটায় হলুদ, কোনটায় বা টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে আছে। কি ফুল, কি গাছ কেউ বলতে পারে না। শুধু টবের আর গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে দিনেদিনে। সামনের উঠোন আর পেছনের কুয়োতলা ফুলগাছের বাগান হয়ে ওঠে ধীরেধীরে। ভোরবেলা স্বপ্না আর শবনম পাতলা পাতলা ছোট্ট লেস দেওয়া নেগলিজি পরে সেই সব গাছে ঝারি করে জল দেয়। গোড়া পরিষ্কার করতে বা সার দিতে ঝোঁকে যখন, বিপজ্জনক ভাবে উঠে যায় নেগলিজি। কখনো সখনো প্যান্টির ঝলক দেখা যায়।
ভোররাত থেকে উঠে বারান্দা আর ছাতে ঘোরাঘুরি করে সুধীর ব্যায়াম করার অছিলায়। আর রাতে বিছানায় দুটো পাশবালিশকে স্বপ্না আর শবনম ভেবে ঝাঁপাই ছোঁড়ে। ছ’মাসেই বেচারার চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। পাড়ার আর সব ব্যাটাছেলেদের মত সুধীরও যে তাদের শরীর মাপছে, ভালই বুঝতে পারে দুজনে। কিন্তু হাসি ঠাট্টা, রঙ্গ রসিকতার পরে একটা অদৃশ্য দেয়াল টেনে রাখে। সুধীর এবং পাড়ার আর সবাই, কেউই সে দেয়াল টপকাতে পারে না। শুধু নাচন কোঁদন সার। শনি রবিবারে দুজনেরই ছুটি। সেদিন বাজার করে। ঝুল ঝাড়া, কাপড় কাচা, এইসব ঘরের কাজ করে। সেও এক দর্শনীয় ঘটনা। শুধু জীনসের হটপ্যান্ট আর বুস্টিয়ার পরনে। একজন উবু হয়ে বাসন মাঝছে তো একজন কল টিপে বালতি ভরছে। টানটান নিতম্ব আর উদ্ধত বুক দেখে সুধীরের মনে হয় ছাত থেকে লাফ মারে। বহু কষ্টে সামলে থাকে। সুধীরের মা দেখতে পেলে ছেলেকে ধমকে ডেকে নেয়।
:- ডাইনী, রাক্ষুসী, বেবুশ্যে মাগী যত! গালাগালি করতে থাকে। সুধীর উল্টে মাকেই ধমকায়।
:- মেয়েদের খাটো পোশাক দেখে যারা খারাপ বলে, তাদের মনটাই খারাপ।
:- তুই তাড়া ওদের!
:- তারপর খাবে কি? দশ হাজার টাকা ভাড়া একদানে ফেলবে এমন আছে ক’জন? সাপের মুখে ধুলোপড়া পড়ে।
:- তাই বলে খোলা জায়গায় ওই রকম পরে ঘুরবে! সেটা তো বারন করবি? গজগজ করে সুধীরের মা।
:- আমি বলতে পারব না। আর বললেই বা শুনবে কেন?
নিজের ছেলের উন্মত্ত অবস্থা ভালই বোঝে সুধীরের মা। কি আর করবে। তবু গালাগাল দেয়। কিছু কিছু স্বপ্না শবনমের কানেও পৌঁছয়। রাগ তো করেই না তারা, বরং হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। একই অবস্থা আশপাশের বাড়িগুলোর ব্যাটাছেলেদের। কুয়োর মত উঠোন। চারদিকে সবই প্রায় দোতলা বাড়ি। দেখছে সবাই, অথচ দু বোনের কোন হেলদোল নেই। আপন মনে কাজ করে যায় নিজেদের। তবে খুব একটা সতী সাবিত্রীও নয় দুজনে। মাঝেমাঝেই অফিস ফেরতা অচেনা ছেলেবন্ধু আনে সঙ্গে করে। রাতে থাকেও তারা। পাড়ার কিছু খিটকেল বুড়োর আর গ্রেপস আর সাওয়ার বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা লোকের ব্যাপারটা দেখে গা পিত্তি জ্বলে যায়। ভদ্রলোকের পাড়ার ভেতরে এরকম তো চলতে দেওয়া যায় না। হাতেনাতে ধরবে বলে তারা তক্কেতক্কে থাকে। কিন্তু কখন ভোররাতে কেটে পড়ে অচেনা ছেলেগুলো, কিছুতেই ধরতে পারে না।
শেষে তারা তিনে গুণ্ডার শরণাপন্ন হল। তিনেকে ভয় পায় না, শুধু এপাড়ায় কেন, এ শহরে এমন কেউ নেই। বিরাট দলবল তিনের। নাকি তেইশটা মার্ডার করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে। সব কেস ঝুলে আছে। আর দুটো করতে পারলেই, বর্তমান রাজনৈতিক পার্টি তাকে আগামী ইলেকশনের টিকিট দেবে। দুটো মার্ডারের জন্যে সেই থেকে হন্যে হয়ে আছে তিনে। সব শুনে এক কথায় রাজী হয়ে গেল। ঠিকই তো। পাড়ার ভেতরে এরকম নোংরামী উৎখাত করা দরকার। দুটো মেয়ে, দুটো লাশ, ইলেকশনের টিকিট, সহজ ইকোয়েশন ঘুরছে তখন তিনের মাথার ভেতরে। সেই মত এক শনিবারের রাতে, কোমরে মেশিন আর হিপপকেটে জয় গুঁজে হাজির হল তিনে সুধীরদের বাড়িতে। বেল টিপল স্বপ্না শবনমদের ঘরে। দরজা খুলল শবনম।
:- ও মা! ত্রিনাথদা যে! আসুন আসুন ভেতরে আসুন। বাপ মায়ের পরে তার ভাল নাম ধরে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ডাকেনি। কেমন বোকা বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তিনে।
:- ভেতরে আসুন ত্রিনাথদা।
ফের বলে শবনম। পায়ে পায়ে ভেতরে এসে দাঁড়ায় তিনে। দরজা বন্ধ করে শবনম। আর জোরালো টিউবের আলোয় মভ কালারের, লেস দেওয়া অতি সংক্ষিপ্ত নেগলিজি পরা এক অপ্সরীকে দেখতে থাকে সে।
:- কেরে শুবি? রান্নাঘর থেকে জানতে চায় স্বপ্না।
:- ত্রিনাথদা এসেছে রে দিদি।
:- ওমা তাই নাকি!
বলতে বলতে বেরিয়ে আসে স্বপ্না। একই রকম লেসের কাজ করা কালো মিশমিশে নেগলিজি জড়িয়ে রয়েছে তার দুধ সাদা শরীর। ঢোঁক গেলে তিনে।
:- দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
বলে স্বপ্না। কেমন বেভ্যুলের মত ধপ করে খাবার টেবিলের ধারে চেয়ারটায় বসে পড়ে তিনে। শবনম এসে বসে তার গা ঘেঁষে। কি সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ উঠে আসছে শবনমের শরীর থেকে।
:- চা খাবেন তো ত্রিনাথদা?
টেবিলটা ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলে স্বপ্না। তার অর্ধ উন্মুক্ত চন্দ্রদ্বয়ের মধ্যবর্তী গভীর খাদে চোখ আটকে থাকে তিনের। কি করতে এসেছিল, কি করতে হবে, সব ভুলে গেছে। ভীষণ গরম করছে তার।
:- না না আমার জন্যে আবার কষ্ট করে নিজের আমতা আমতা গলাটা নিজের কানেই কেমন অচেনা শোনায়।
:- ওমা কষ্ট কিসের? চা তো করছিলামই।
খানিক পরে ডালমুট সহযোগে সুগন্ধী দার্জিলিং চা খেতে খেতে ভাবে ত্রিনাথ, তেরো বছর বয়েস থেকে আফটার সান ডাউন এই প্রথম চা খাচ্ছি। শালা হল কি আমার! সেই শেষ স্বাধীন চিন্তা ভাবনা তিনে গুণ্ডার। খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে পাশে বসে তিনের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে স্বপ্না।
:- রাতে পরোটা আর কষা মাংস করব। তুমি কিন্তু খেয়ে যাবে তিনুদা। আপত্তি করবে না। তিনের বোতাম খোলা শার্টের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে বুকে হাত বোলাতে থাকে স্বপ্না।
:- আপত্তি করলে শুনছে কে!
গলা জড়িয়ে ধরে বলে শবনম। তার একটা বুক তখন পিষে যাচ্ছে তিনের কাঁধে। আরো খানিক পরে দুই সুন্দরী যখন দুহাত ধরে তাকে বেডরুমে নিয়ে যাচ্ছিল, নিজের নাম, বাপের নাম, সব ভুলে গেছিল তিনে গুণ্ডা।
রাত দুটো নাগাদ ধুঁকতে ধুঁকতে বেরোল তিনে। দুটো গুলির আওয়াজ শোনার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে যারা ছিল, তারা বোর হয়ে তখন শুতে চলে গেছে। হাত পা অবশ। বাইকটাকে ঠিক মত স্টার্ট দিতেও পারছিল না তিনে। দুই বোনে দরজার কাছে এগিয়ে এল।
:- দুটো অবলা নিঃসহায় মেয়ে একলা থাকি তিনুদা। কত লোকে কত কি যা তা বলে। তুমি একটু দেখো প্লীজ আমাদের।
:- কোন চিন্তা কোর না। কেউ কিছু বললে, শুধু জানাবে একবার আমাকে। লাশ ফেলে দেব। আমি আছি। দেখব তোমাদের। বলে কোনমতে বাইকটা চালু করে চলে গেল। তা দেখেছিল তিনে। মাস খানেক ধরে নিয়ম করে প্রত্যেক শনিবারে। সে কি নেশা। বাংলার নেশাও হার মেনে যাবে তার কাছে। তারপর এক সকালে গলায় বোতল উপুড় করতেই কাশির দমক এল। কাশতে কাশতে সব শেষ। ডাক্তার এসে দেখে বলল, মাল গিলে গিলে লিভারের বারোটা পাঁচ হয়ে গেছে। সিরোসিস অফ লিভার। তার ওপরে অ্যাকিউট অ্যানিমিয়া। লিভার ফেটেছে, সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেলও করেছে। যাই হোক, তিনে গুণ্ডা ছবি হয়ে গেল। শহর জুড়ে শোকসভা, শোক মিছিল। শুধু সুধীরের মা গালাগাল দিল,
:- ডাইনি রাক্ষুসী দুটো মিলে চুষে চুষে খেল তিনেকে! কথাটা কানে গেছিল দুবোনের। সেদিন কিন্তু হাসল না। দিন পনেরো পরের কথা। একটা দালালির কাজে সুধীরকে একটু দূরে যেতে হয়েছিল। সন্ধে আটটা নাগাদ ফোন এল স্বপ্নার। দু বোনের নম্বরই সেভ করা ছিল সুধীরের কাছে।
:- সুধীরদা, অফিস থেকে ফিরে দেখি বাথরুমের কলে জল নেই। পাম্প চালাবার জন্যে মাসিমাকে ডাকলাম। কোন সাড়া নেই। সেই থেকে ডেকেই যাচ্ছি। কোন সাড়াশব্দ নেই। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। ভীষণ ভয় করছে। কোন বিপদ আপদ ঘটেনি তো?
ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসে সুধীর ছুটতে ছুটতে। এসে দেখে বাড়ির সামনে বেশ ভীড় জমে গেছে। দোতলায় ওঠার দরজার সামনে স্বপ্না আর শবনম মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে। গ্রীলের দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে উল্টো দিক থেকে বহু কষ্টে তালা খোলে সুধীর। তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে ছোটে ওপরে। পেছনে স্বপ্না শবনম। বেশি দূর যেতে হয় না। বাথরুমের দরজার সামনে পড়ে আছে সুধীরের মা। বাঁদিকটা বেঁকে গেছে। শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা। কোনরকমে পাঁজাকোলা করে মাকে বিছানায় এনে শোয়ায় সুধীর। মা এত রোগা আর হালকা হয়ে গেল কবে? এত দুঃখের মধ্যেও ভাবে সুধীর। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন,
:- শরীরে রক্ত নেই মোটে। প্রেসার লো হয়ে গেছিল। সিভিয়ার অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। একটু অনুযোগও করলেন,
:- শরীরের এই অবস্থা হয়েছে, যত্নআত্তি করতে না মোটে মাকে।
:- কিন্তু মা তো বেশ মোটাসোটা ছিল। প্রেসার বরং হাই ছিল একটু। ওষুধ খেত রোজ। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে সুধীর। স্বপ্না তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চেষ্টা করে,
:- কেঁদোনা সুধীরদা। মা বাবা তো চিরকাল থাকে না। একদিন সবাই চলে যায়।
শ্রাদ্ধশান্তি মিটল। এখন বাড়িতে সুধীর একা। না একা কেন হবে? আছে স্বপ্না আর শবনম। আরো ক’মাস কাটল। পাড়া শুদ্ধু সব পুরুষ মানুষ দুই বোনের বশে এসে গেছে। শুধু বাকি আছে পাশের বাড়ির সৌরভ। সেই বা বাকি থাকে কেন? শনি রবিবারে বাজারের রাস্তায় প্রায়ই দেখা হতে লাগল সৌরভের সঙ্গে হয় স্বপ্নার নয় শবনমের। প্রথমে দৃষ্টি বিনিময়। তারপরে পরিচিতির হাসি। তারপরে টুকরো কথা। আলাপ জমে উঠতে লাগল। পুরুষের মন না মতি। টলে গেল, গড়িয়ে গেল। অমন যে স্ত্রৈণ বলে বিখ্যাত সৌরভ, সেও আড়ালে আবডালে দেখতে লাগল দু বোনকে। তবে ধরা পড়ে গেল তৃণার কাছে। এক রবিবারে ছাত থেকে মৌজ করে রূপসুধা পান করছিল সৌরভ স্বপ্নাদের। তারাও মাঝেমাঝে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি হাসছিল। পেছনে কখন তৃণা এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই ছিল না। হাতটা আচমকা ধরে হিড়হিড় করে ঘরে টেনে আনল তৃণা সৌরভকে।
:- দেখ, বেশি বাড়াবাড়ি কোর না। ফের যদি দেখি, ওদের দিকে তাকিয়েছ কিম্বা কথা বলছ আগুন চোখে তাকায় তৃণা সৌরভের দিকে,
:- আমি স্বমূর্তিতে এলে, পালাবার পথ পাবে না, বলে দিলাম। খুব সাবধান!
ভয়ে লজ্জায় চুপ করে বসে থাকে সৌরভ। কিন্তু কি এক অমোঘ টানে ছটপট করতে থাকে ভেতরে ভেতরে। কল্পনায় কখনো স্বপ্না, কখনো শবনম, কখনো বা দুজনেই তার শরীর নিয়ে খেলতে থাকে। পাগল পাগল লাগে সৌরভের। শেষে এক নির্ঘুম গভীর রাতে ছাতে এসে দাঁড়ায় স্বপ্নাদের কুয়োতলার দিকে মুখ করে। দেখে এসেছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে তৃণা। হঠাৎ অন্ধকারে সৌরভের চোখে পড়ে দুটো আগুনের ফুলকি কুয়োতলায়। একবার কমছে একবার বাড়ছে। চোখ একটু সয়ে যেতে দেখে দুই বোনে কুয়োর পাড়ে বসে সিগারেট টানছে। তাকে দেখে হাতছানি দিয়ে নিচে ডাকে। সে ডাক এড়াতে পারে না সৌরভ। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এসে সদর দরজা খুলে নিচু পার্টিশন ওয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়। স্বপ্না, শবনম দুজনেই এগিয়ে আসে তার কাছে । গা সিরসির করে ওঠে সৌরভের। তারার আলোয় আবছা দেখে, দুটি অপূর্ব দেহবল্লরী ঢাকা আছে শুধু টুপীসে। আর কিচ্ছুটি নেই তাদের শরীরে। দম যেন আটকে আসতে থাকে সৌরভের।
:- কি হল? ঘুম আসছে না?
:- হ্যাঁ।
:- বউ ঘুম পাড়িয়ে দিল না?
:- না তো।
:- আহা রে! আমাদের কাছে এসো। আমরা দুজনে মিলে যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
এক লাফে পাঁচিল ডিঙ্গোয় সৌরভ। দুজনে এসে দুহাতে ধরে তাকে নিয়ে যায় ভেতরে। সৌরভ খেয়ালও করে না, তাদের ছাতের আলসের ধারে অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা। তার দু চোখে ধকধক করে জ্বলছে দু টুকরো নীল আগুন।
ভোর রাতে চোরের মত চুপিচুপি ফিরে আসে সৌরভ। টলতে টলতে গিয়ে বউয়ের পাশে শুয়ে বেহুঁশ হয়ে যায়।
সকাল বেলা তৃণা ডেকে ডেকে সৌরভকে তুলতে পারছিল না কিছুতেই। ভাল করে দেখে, সৌরভের ঠোঁট আর জিভ ক্ষতবিক্ষত। রক্তহীন শরীরে জ্ঞান নেই। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সৌরভকে নিয়ে যায় একটা নার্সিংহোমে। তারপরে চলে সারাদিন ধরে যমে মানুষে টানাটানি। সন্ধের একটু পরে স্টেবল হয় সৌরভ। নিঃশব্দে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে আসে তৃণা। তারপর হাজির হয় স্বপ্নাদের দরজায়। বেল বাজায়। শবনম দরজা খুলে তাকে দেখে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করতে যায়। কিন্তু তৃণার হাতের এক ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়ে ডাইনিং টেবিলের ওপরে। দরজা বন্ধ করে এসে দাঁড়ায় তৃণা। তার দুচোখে তখন জ্বলছে নীল আগুন। তীক্ষ্ণ চীৎকার করে শবনম ঝাঁপিয়ে পড়ে তৃণার ওপরে। লক্ষ্য তৃণার গলা। হাঁ করা মুখে ধারাল লম্বা চারটি শ্বদন্ত ঝিকিয়ে ওঠে। কিন্তু মাঝ পথেই তৃণার বাঁ হাতটা লম্বা হয়ে পেঁচিয়ে ধরে শবনমের গলা। সেই ভাবেই তাদের বেডরুমে ঢোকে তৃণা।
বিছানার ওপরে নগ্ন স্বপ্না তখন একমনে সুধীরকে শুষে নিচ্ছিল, শেষ বারের মত। তারপরে তার নিরক্ত শরীরটার ওপরে হাত বোলাতে থাকে বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে। আস্তে আস্তে সুধীরের শরীরটা পরিণত হতে থাকে একটা অদ্ভুত গাছে। ডালে ডালে নীল সাদা ফুল। সেই ফুলগাছটাকে বিছানার পাশে রাখা একটা বড় টবের মাটিতে পুঁতে রেখে উঠে দাঁড়ায় স্বপ্না। ঘুরেই তৃণাকে দেখে। আর দেখে তার হাতের বাঁধনের প্যাঁচে ঝুলন্ত শবনমকে। ধারাল চারটে দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বপ্না তৃণার ওপরে। কামড়ে ধরে তৃণার ঘাড়। তৃণার ডান হাতটা ঠিক আগের মতই লম্বা হয়ে পেঁচিয়ে ধরে স্বপ্নার গলা। শরীরটা ক্রমশঃ লম্বা হয়ে আঁশে ঢেকে যায়। তিন জনে মিলে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে থাকে সারা বাড়ি জুড়ে।
সেদিন সারারাত ধরে পাড়ার লোকেরা ভয়ে কাঁটা হয়ে শুনে ছিল ভয়ঙ্কর জান্তব গর্জন আর হিসহিসানি। তোলপাড় হচ্ছিল সুধীরদের বাড়ির একতলাটা। তারপর ভোরের একটু আগে সব শান্ত নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। তবুও বেলা বাড়ার আগে কেউ সাহস করে এগোয়নি সেদিকে। বেশ বেলায় পাড়ার লোকেরা গিয়ে দেখে সুধীরদের দোতলায় যাওয়ার দরজা খোলা। কেউ নেই কোথাও। তারকের মা এসে খবর দেয়, পাশের বাড়িও ফাঁকা। সকালে বাসন মাজতে গিয়ে দেখে তৃণা বৌদি কোথাও নেই। ঘরদোর সব খোলা পড়ে রয়েছে। অবশেষে স্বপ্নাদের দরজা ভেঙ্গে ঢোকে সকলে। শোবার ঘরে গিয়ে দেখে মেঝেতে পড়ে রয়েছে কবেকার পুরনো শুধু হাড় আর চামড়া সর্বস্ব দুটো কঙ্কাল। আর তাদের পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরে মরে পড়ে রয়েছে একটা দুধ গোখরো সাপ। বিছানার পাশে একটা টবের গাছে তখন থোকা থোকা নীল সাদা ফুল ফুটেছে।পাড়ার বুড়ো বুড়িরা বলতে লাগল,
:- কে যে কখন কি রূপ ধরবে তার কিছুই বলা যায় না।