জীবনের গলিতে

জীবনের গলিতে

আমার বিয়ের কথা চলছে দাদুর বন্ধুর একমাত্র নাতির সাথে। আমরা দুই বোন এক ভাই। আমিই বাবা মায়ের বড় মেয়ে। আমিতো কেবল ক্লাস সেভেনে পড়ি। তবুও আমার বিয়ের কথাবার্তা চলার পিছনে একটা কারণ আছে।

আমাদের বাড়ি বরিষালের পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ থানায়। এই মির্জানগরের প্রায় অর্ধেক মানুষই কুয়েত প্রবাসী। এমনও দেখা যায় মেয়ে বিয়ে দেবার সময়ও জানতে চায় ছেলে কুয়েতি কিনা। এমনটা নাকি সিলেটেও হয়। সিলেটে ছেলে যদি লন্ডন প্রবাসী হয় তাহলে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে সবাই রাজী হয়। আমার বাবাও কুয়েত প্রবাসী। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন বাবা আমার মায়ের জন্য ভিসা পাঠায়।

জন্মের পর থেকে বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছি। ছুটিতে যতদিন থাকতেন ততদিনই কাছে পেয়েছি। আর ফাইভে উঠার পর থেকে মা”কেও হারালাম। হারালাম বলতে মা’কে বাবা ভিসা দিয়ে কুয়েত নিয়ে গেল। আমি আর ছোট দুটি ভাই বোন দাদা দাদীর কাছেই বড় হতে লাগলাম। সেভেনে উঠার পর বাবা বাড়িতে এলেন ছুটিতে। আমাদের তিন ভাই বোন’কে কুয়েত নিয়ে যাবার জন্য বাবা সাথে করে ভিসা নিয়ে আসলেন। দাদুকে বাবা বলছেন, “বাবা আমি ছেলে মেয়েগুলোকেও আমার কাছে নিয়ে যেতে এসেছি।” তখন দাদু বললেন, “সবাইকে যদি তোর কাছে নিয়ে যাস তাহলে তো আর দেশেই আসবিনা। তোর বড় মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দে। অন্তত মেয়ের টানে হলেও দেশে আসবি। ” বাবা যখন আবারো জিজ্ঞেস করল সায়মাকে রেখে আপনি কী করবেন? তখন দাদু বলল সায়মা এখান থেকেই লেখাপড়া করবে। আর আমার বন্ধু তার নাতির সাথে সায়মাকে বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেছে। আমারো ইচ্ছে সায়মাকে আমার বন্ধুর নাতির সাথেই বিয়ে দেব।

যার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছিল তার দাদা ও তার পূর্ব পুরুষদের এলাকায় একটা সুনাম রয়েছে। তারা গ্রাম্য শালিস বা পঞ্চায়েতের বিচার কার্য করতেন। যদিও এখন তারা দরিদ্র অবস্থানে আছে। দাদু বাবার সাথে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, দরকার হয় আমার স্বামীকে ভবিষ্যতে কুয়েতে নিয়ে যাবে। তখন আর কোন সমস্যাই থাকবে না।

১৯৯৯ সালের ২১ শে ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী বিয়ে করতে আসার সময় বরযাত্রীর যে খরচটা সেটাও আমার বাবা দিয়েছে। দেয়ার মধ্যে আমার স্বামী তৎকালীন একশত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পুরাতন একটি নাকফুল কিনে দিয়েছিল। যা পরবর্তীতে শুনা যায়, নাকফুলটি ছিল স্বর্ণ কর্মকারের স্ত্রীর। সে যাই হোক, যতটুকু সামর্থ্য ছিল ততটুকুই দিয়েছে। কিন্তু সামর্থ্য থাকার পরও কী দিতে পারে আর কী দিবে না তা বুঝেছি বিয়ের পরে।

বাবা ছুটিতে এসে আমার বিয়েটা দিয়েছিল। যেহেতু আমাদের ভাই বোন তিনজনেরই ভিসা নিয়ে এসেছিল, সেহেতু বাবা চেয়েছিল আমাকেও সাথে করে কুয়েত নিয়ে যাওয়ার জন্য। দরকার হলে বছর খানেক পর আমার স্বামীকেও কুয়েতে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার দাদু আর আমার স্বামীর পরিবার সেটা চায়নি। যে কারনে আমাকে রেখে বাবা আমার ছোট ভাই বোনকে সাথে নিয়ে কুয়েতে ফিরে গেলেন। প্রথমে বাবা, তারপর মা এবার ভাইবোনও চলে গেল। আমি কেমন যেন একা হয়ে গেলাম।

মাত্র সেভেন পড়ুয়া মেয়ে আমি। বউ এর “ব” বুঝিনা। আমি পড়ায় মন দিলাম। কিন্তু আমার স্বামীর পরিবার আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তাদের ধারনা বাবা মা ছাড়া দাদু আর চাচাদের কাছে আমি ভাল থাকব না। তাই আমাকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে। ছোট্ট মেয়েটি বউ হয়ে অজানার পথে পা বাড়িয়েছি। এলাকার প্রতি ঘরে ঘরেই একজন হলেও কুয়েত প্রবাসী আছে। আর সেজন্যই আমি সুখে আছি না দুঃখে আছি তা আমার বাবা মা’কে আমার ফোন করে বলতে হত না। এলাকার মানুষই ফোন করে বলে দিত। তখন হয়তো বাবা ভাবত কত বড় ভুল করে গেছে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে।

খাওয়ার কষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট। পেটে ভাত না থাকলে মানুষ ধর্ম কর্মও ভুলে যায়। আমি খাওয়ার কষ্ট করেছি অনেক। শ্বাশুড়ী পাশের বাড়ি থেকে সকালবেলা এক দেড় প্লেট পানিভাত ধার আনত। তিনটে ননদ, শ্বাশুড়ী খাইত। ভাগ করে কখনো ইচ্ছে হলে আমাকে দিত। দুপুরে ভাত রান্না করে আবার সে ভাত পাশের ঘরে ফেরত দিত।  সকালে শ্বশুর মুড়ি খেত। স্বামী খেত বাইরে। বাবা এই খবর শোনার পর প্রতি মাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠাইতো আমার খরচ চালানোর জন্য। কিন্তু দেখা গেল মাসের বিশ তারিখ আসতেই আমার উপর অত্যাচারটা বেড়ে যেত। উদ্দেশ্য, বাবা যেন আবার টাকা পাঠায়। কিন্তু ২০০০ সালে মাসে দশ হাজার টাকা হিসেবে অনেক কিছু।

আমি সকালে বাড়ির কাজ কর্ম সেরে স্কুলে রওনা দিতাম। দুপুরে স্কুলে থাকায় শুধু রান্নাটা করতে পারতাম না। নয়তো বাকি সব কাজই আমি করতাম। স্কুল থেকে ফিরে এসে খাবার খাইতাম। ওরা খাবার পর অবশিষ্ট যা থাকত আর কী। কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে পারতাম না। শ্বাশুড়ী ইনিয়ে বিনিয়ে আমার স্বামীর কাছে সব বলত। আর আমার স্বামী ধরে ধরে মারত। শ্বশুর বুড়া মানুষ, গায়ে শক্তি কম। উনি কত করে আমার স্বামীকে বলত তুই মেয়েটাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে, তবুও মেয়েটাকে এভাবে মারিস না। আল্লাহ একজন আছেন, উনি সহ্য করবেন না। শ্বশুরের কথা কানেই তুলত না আমার স্বামী।  বাবা একটি মোবাইল পাঠিয়েছিল ফোন করে বাবার সাথে, দাদু আর চাচা চাদীদের সাথে কথা বলার জন্য। সে ফোনটা শ্বাশুড়ী কেড়ে নিয়েছে, আমি নাকি সারাদিনই ফোনে পরপুরুষের সাথে কথা বলি। বাবা’কে কতবার বলছি আমি এখানে থাকব না। আমাকে বুঝাইত, ধৈর্য ধর মা। সব ঠিক হয়ে যাবে  বাবা যদি একবার বৌ হয়ে এই সংসারে আসত তাহলে হয়তো কেঁদে কেঁদে বলত, মা তুই চলে আয়।

আমার এস এস সি পরীক্ষার পর আমার একটি মেয়ে সন্তান হয়। অর্থাৎ বিয়ের প্রায় চার বছর পর। তখন বাবা আমার স্বামীকে ভিসা দেয়। পটুয়াখালী থেকে লঞ্চভাড়া সহ, পাসপোর্ট, মেডিকেল, ভিসার যাবতীয় খরচ দিয়ে কুয়েতে নিয়ে যায়। শুধু আমার একটু সুখের জন্য। স্বামী যাবার পর কিছুদিন একটু ভালো ছিলাম মেয়েটাকে নিয়ে। এই ভালো থাকার পিছনেও কারণ ছিল। আমার স্বামী রান্না পারত না। আবার মা রান্না করত, বাবা গাড়ী দিয়ে আমার স্বামীর কাছে খাবার নিয়ে যেত। ছয়মাস পর থেকে আমার স্বামী আমার বাবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাবা ফোন দিলে বাজে ব্যবহার করত। আমার সাথে সপ্তাহে পনেরো দিনে একদিন কথা বলত। মেয়েটা ছোট, সে যদি আমার চোখের পানির কারণ জানত তাহলে অবশ্যই বলত, “মাগো তুমি আমাকে নিয়ে এই দোযখ থেকে পালিয়ে যাও।” আমার একবার পেটে টিউমার ধরা পড়ে। তখন আমার মেয়ের বয়স সাড়ে ছয়। রক্ত যেতে যেতে আমার অবস্থা চরম দুর্ভোগে। মা’কে ফোন করে সব বলার পর বাবা শ্বাশুড়ীকে ফোন করে বলেছে চিকিৎসা করানোর জন্য। করাবে করাবে বলে আর চিকিৎসা করায় না, অথচ আমার অবস্থা করুণ।

অবশেষে বাবা চাচাকে ফোন করলেন। চাচা আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবে, আমার বড় ননদ বলছে সেও যাবে। তার স্বামীর বাড়ি ঢাকায়। পথে বলছে, আমাদের বাড়ির বউ আমরা চিকিৎসা না করালে লোকে মন্দ বলবে। তার চেয়ে ভাল ভাবীকে আমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাই। ননদ তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে গেল আমাকে । চিকিৎসা করানোর কথা বলে ঊনিশ দিন কোন ডাক্তার দেখায়নি। ঊনিশ দিন পর ডাক্তার দেখিয়ে আমাকে আবার পটুয়াখালী নিয়ে আসল। ডাক্তারই যা দেখাইছে, চিকিৎসাও করায়না ঔষধও খাওয়ায় না। উল্টো আমার স্বামী আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমি নাকি ঢাকা গেছি রং ঢং করতে। বন্ধু বান্ধব আর ফোনের প্রেমিকদের সাথে দেখা করতে।

শেষ পর্যন্ত বাবার বাড়ি চলে এলাম দাদার কাছে। বাবা আর চাচার পরামর্শে মামলা করলাম স্বামী আর শ্বাশুড়ীর নামে। মামলার কারণে আমার স্বামী দীর্ঘ সাত বছর পর দেশে আসল। আমার জন্য বা মেয়েটার জন্য কিছুই আনেনি। তখন বুঝতে বাকি নেই যে আমার স্বামী আর আমার নেই। কোর্ট থেকে রায় হল আমার উপর আর অত্যাচার হবে না। চিকিৎসা করানো হবে ঠিকভাবে । হ্যাঁ, চৌদ্দ দিন থাকতে পেরেছিলাম আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে। তাদের নামে মামলা করেছি তারা আর কতটুকু ভালো রাখবে আমাকে?  আমাকে আবার বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য করে। মেয়েটাকে রেখে দিয়ে স্বামী বলেছে, গেলে একা যাও। মেয়ে আমার, আমার কাছেই থাকবে।

তার পর থেকেই প্রথমে চাচার বাড়ি তারপর বাবার বানানো বাড়িতে থাকি। আমার বিয়ে হয়েছে সাড়ে আঠারো বছর। এর মধ্যে স্বামীর সংসার করেছি চার বছর। শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়েছি সর্বমোট সাত বছর। আর হিসেব করলে পুরো জীবনটাই পাড়ি দিচ্ছি একা।  এখনো আমার স্বামীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়নি। আমার স্বামী কুয়েতে সাড়ে তেরো বছর। সাত বছরের সময় মামলার কারনে একবার এসেছিল, আর আসেনি। শুনেছি সে নাকি কুয়েতে কলকাতার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে।  আমার বাবাও ডিভোর্স করতে দেয়না আমাকে।  দাদী কত করে বুঝায় তাকে। সায়মা একটা মেয়ে মানুষ। তার বয়স তো ত্রিশ পেরুলো। বাবা নাই দেশে। নাই স্বামী নাই সন্তান। সায়মার ভবিষ্যত কি?

এত বুঝানোর পরও বাবা ডিভোর্স করাতে চান না। আরেকবার ভিসা পাঠিয়েছে আমার জন্য। কিন্তু নাম সংক্রান্ত ঝামেলার কারনে সে ভিসাও বাদ দিতে হয়।  এখন কিছুদিন ধরে কুয়েতের ভিসা বন্ধ। ভিসা চালু হলে যাব কুয়েতে। একটিবার আমার স্বামীর সাথে দেখা করব। তারপর বাবা রাজী হোক বা না হোক আমি নিজেই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব। আড়াই বছর হল আমার মেয়েটার সাথে ফোনেও কথা বলতে পারি না। বড় ননদের শ্বশুর বাড়ি ঢাকায়। আমার স্বামী সেখানে টাকা পাঠায়।  মেয়েকে হয়তো উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে। আর ননদের কাছে ফোন দিলেও আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে পারিনা। মেয়েটা এবার ক্লাস নাইনে, অনেক বড় হয়ে গেছে।

প্রতিবেশীরা বলে আমি নাকি অনেক ভুল করছি। আমার নাকি নিজের পথ নিজেরই বের করে চলে যাওয়া উচিত ছিল অন্য কারো সাথে। আমি তো বাবা মায়ের, দাদুর সম্মানের কথা ভেবেছি। অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেও স্বামীর সংসার চেয়েছি। মেয়েটাকে বুকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।  জীবনের অর্ধেকটা দুঃখের ভেলা বেঁয়ে চলতে চলতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানি না বাকিটা জীবন পাড়ি দেব কিভাবে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত