পুরো বাড়িতে থমথমে এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এক জায়গায় অনেক মানুষ একত্রিত হয়েছে কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই।সবার চোখ একদিকে স্থির।অন্যদিকে তাকানোর সময় যেনো কারও নেই।থেমে থেমে ভিড়ের মাঝখান থেকে উচ্চস্বরে এক মহিলার কান্নার আওয়াজ আসছে। তাঁর কান্নায় সবার মুখেই পানির রেখা দেখা দিয়েছে।আর এই সবকিছু এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিল অনিমা দূরে দাঁড়িয়ে।স্কুলের তুষার স্যার তাকে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে কিন্তু কেন তা বলেনি।বাড়িতে এসে এসব দেখে ক্রমশঃ তার মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। তার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরছে।”কি হয়েছে?কেন হঠাৎ স্যার তাকে ছুটি দিল?তাদের বাড়ির সামনে কেন সবাই ভিড় করছে?আর ভিড়ের মাঝখান থেকে কে এভাবে কান্না করছে?”যতই এসব ভাবছে ততই তার পা যেন আটকে যাচ্ছে।হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও হেঁটে চলেছে।ভিড়ের কাছাকাছি আসতেই সবাই তাকে যাওয়ার জন্য জায়গা করে দিয়েছে।আর একে অপরের সাথে খুব সন্তর্পণে কি যেন বলছে।কিন্তু অনিমার কানে কিছুই যাচ্ছে না।তার চোখ এখন সামনে স্থির।
ঘরের বারান্দায় তার বাবাকে শুয়ে রাখা হয়েছে।কি নিষ্পাপ লাগছে বাবার মুখটা।বাবা এমনি ফর্সা আরও ফর্সা লাগছে। কিছুটা দূরে বসে মা ও কান্না করছে।কিন্তু বাবা এভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কেন।বাবার চারপাশে অনেকে বসে কুরআন পড়ছে। তাইলে কি তার বাবা মারা গেছে?কিন্তু কখন কেমনে মারা গেলো?বাবা তো একঘন্টা আগে টিফিনের সময় ও তার সাথে দেখা করেছে ,তাকে অনেক আদর দিয়েছে আর অনেক চকলেট ও কিনে দিয়েছে।এরমধ্যে এমন কি হয়েছে যে বাবা মারা গেলো।এসব ভাবছে অনিমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।কেউ একজনকে বলতে শুনেছে যে বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।এর বেশি কিছু জানেনা অনিমা।
আসরের নামাজের পর বাবার জানাজা হবে তাই সবাই বাবাকে খাটিয়ায় এনে রেখেছে।নামাজ শেষে সবাই এসে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে কবর দেওয়ার জন্য।তখন মায়ের সে কি কান্না।কিন্তু অনিমার চোখে একটুও জল নেই সে শুধু তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনিমার মা অপর্ণা সেদিনের পর থেকে অনেক বেশি নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া তিনি কারো সাথেই কথা বলেন না।তাঁর একটাই লক্ষ্য মেয়েকে মানুষ করতে হবে।আলাদা মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠবে তাঁর অনিমা।ঠিক যেমনটা অনিমার বাবা চেয়েছিলেন।
অনিমার বাবা যখন মারা যায় তখন অনিমা মাত্র ক্লাস থ্রি তে পড়ত। তাই আপনজন মারা যাওয়ার কষ্টটা তেমন অনুভব করতে না পারলেও বাবার অনুপস্থিতি ঠিকই তার ভিতরে নাড়া দেয়।বিশেষ করে খাওয়ার সময়।কিন্তু সেই কষ্ট যেন মেয়ে অনুভব করতে না পারে তাই অপর্ণা এখন বাবা ও মা হয়ে বাবা তাকে যেমনটা সাপোর্ট করত তেমনটাই করে।তবুও ছোট্ট অনিমা বাবাকে খুব বেশি মিস করে।তখন সে তাঁর মাকে জিজ্ঞাসা করে যে তার বাবা কি আর কখনো আসবে না?তখন অপর্ণা মেয়েকে কিছুই বলেন না।বরং লুকিয়ে কাঁদেন।তাই সে আর তার মাকে জিজ্ঞাসা করেন না তার বাবার ব্যপারে কিছুই।বাবার ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে নিজের মনেই উত্তর খুঁজে যায় কিন্তু পায় না।
অনিমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ঘরের বাহির ও ভেতর সবকিছুই একলা হাতে সামাল দিচ্ছে অপর্ণা।কোন অভাব যেনো মেয়ের মন অবধি না পৌঁছে সেটাই যেন অর্পণার প্রধান উদ্দেশ্য।সবসময় আগলে রাখেন মেয়েকে তিনি। অর্পণার বাবার বাড়ি থেকে তাকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল।কিন্তু অর্পণা আর বিয়ে করেনি। তাই অনেকেই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।তবুও তিনি তার পথে অটল। অর্পণা এস এস সি পাশ করেছিলেন। এবং সায়েন্স থেকে রেজাল্ট ও ভালো করেছিলেন।সেই সুবাদে টিউশন মিডিয়া এর সাথে যোগাযোগ করে কয়েকটা ভালো মানের টিউশন যোগাড় করে নেন। তা দিয়েই কোন মতে তারা মা মেয়ে চলে যেত।
এর মধ্যে ও মানুষের কানাঘুষা থেকে রেহাই পায়নি তিনি।একা একটা মেয়ে থাকা যে কতটা কষ্টকর তা একমাত্র যে থাকে সেই বুঝে।পাড়ার কয়েকটি দল বাজে ইঙ্গিত ও দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।যে কোনো মুহুর্তে তারা ঘরে আসতে পারে এমন অবস্থা।এটা ও প্রতিবেশীরা তার ঘাঁড়েই চাপায়।কোথায় তারা প্রতিবেশী হয়ে সাহায্য করবে তা না বরং বলে ঐ মেয়ের উদ্দেশ্য খারাপ তাই আর বিয়ে করেনি। এসব কথা অর্পণার খারাপ লাগলে ও কিছুই করতে পারবে না।কারণ সে তো আর নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করতে পারবে না। আবার তাদের কথায় নিজে পিছুপা হবেন এমন বোকা ও অপর্ণা নয়।
তাইলে যে আর তার স্বামীর ইচ্ছা আর মেয়েকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন দুই ই ভেঙে দিতে হবে।এটা তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারে না।আর মানুষরূপী হায়ানা গুলোকেও উল্টাপাল্টা কিছুই বলতে পারবে না।এতে যদি তারা ক্ষেপে যায় তাইলেও তাদেরই ক্ষতি।তাই ঠান্ডা মাথায় প্রতিবাদ করে টিকে থাকতে হবে তাকে।তার বিশ্বাস মেয়েকে মানুষ করতে পারলেই তার স্বার্থকতা। তিনি চারদিক সামলে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে টিকে থেকে মেয়ের গায়ে যেনো কোনো আছড় ও না লাগে সেভাবে মেয়েকে বড় করছে।অনিমা স্কুল থেকে বই ভিত্তিক শিক্ষা লাভ করলেও আরবি সাথে নৈতিক শিক্ষা অপর্ণার কাছ থেকে লাভ করে।
অনিমা তার মায়ের কষ্ট বুঝে।তার মায়ের কষ্ট দেখে মন খারাপ হয়।তাই তো মায়ের কষ্টের মূল্য দিয়ে সে প্রতি ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে।কোন খারাপ সঙ্গে না মিশার চেষ্টা করে।যেটা তার কাছে খারাপ মনে হয় তা এড়িয়ে চলে।আর যেটা ভালো কি খারাপ বুঝতে না পারে তা সে মায়ের সাথে শেয়ার করে।মা তাকে যা বলে তাই করে।অনিমার ও প্রবল ইচ্ছা বড় হয়ে মায়ের সব কষ্ট দূর করবে।
কিছুদিন থেকে অনিমা প্রাণচঞ্চল হয়ে গেছে। এই বয়সে স্বাভাবিক সবার এমন হয়।এখন অনিমা নবম শ্রেণীতে পড়ে।এখনই বেশ লম্বা হয়ে গেছে,চোখে মুখে এক ধরনের লাবণ্যতা ভর করেছে। এখন তার স্বাধীন জীবন যাপন করতে ইচ্ছা করে যেমনটা অর্পণা করে।তাকে কোনো কাজে বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। পড়ায় ও কেন যেন মন বসাতে পারে না।সারাক্ষণ বান্ধবীদের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে।
অনিমার এসব পরিবর্তন দেখে অর্পণা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।অনিমা প্রত্যেক ক্লাসে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে আসছে।এখন তার এই পড়ালেখার অনিহার কারণে যদি পিছিয়ে পড়ে তখন কি হবে এসব চিন্তাই এখন কুঁড়ে খাচ্ছে অপর্ণার ভিতরটা।অনিমার পড়ালেখার এক্টিভিটি আর আচরণ দেখে তার স্কুলের শিক্ষক তাকে বেশ পছন্দ করে। অন্য উপায় না পেয়ে অপর্ণা অনিমার একজন শিক্ষিকার শরনাপন্ন হলেন।
অনিমার শিক্ষিকা মিসেস রেশমা অপর্ণা কে বলেন এই বয়সে এই পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক।এই কারণে তাকে বকাঝকা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।তাই তাদের ভালোবেসে বুঝাতে হবে।আর সরাসরি তাদের ভুলটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিয়ে বরং এমনভাবে বুঝানো উচিত যেন সে সেখান থেকে শিক্ষা ও লাভ করে আবার নিজেকে সংশোধন ও করে নেয়।আর যা সে করতে চায় না তা নিয়ে তাকে জোর করাটা মোটেই উচিত নয় বরং অন্যভাবে তাকে দিয়ে সেটা করানো উচিত যেন সে নিজেকে পরাধীন না ভাবে আর আমাদের তার প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে ভালো বন্ধু ভাবতে পারে।আর তাদের মন সাধারণত চঞ্চল প্রকৃতির হয় তাই মাঝেমধ্যে তাদের ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।
সেদিন রেশমা মেম এর সাথে কথা বলে আসার পর থেকে তিনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই অনিমার সাথে চলতে চেষ্টা করে।একজন বন্ধুর মতো করে অনিমাকে সময় দেয়।একসময় তার এই কষ্ট সফল হয়।অনিমা এস এস সি তে ও গোল্ডেন এ প্লাস পায়। এরপর সে ভালো এক সরকারি কলেজে ভর্তি হয়।এর মধ্যেই অনিমা দু একটা টিউশন করতে চেয়েছে।কিন্তু অর্পণা করতে দেয়নি। ধীরে ধীরে অনিমা কলেজে ও সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে।এরপর রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে পড়ে মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায়। অনিমার এই সফলতার কারণে অর্পণার মনোবল আরও দৃঢ় হচ্ছে।কারণ অনিমার প্রত্যেকটি সফলতা অপর্ণার সফলতা।
আজ অপর্ণা সফল,সার্থক তাঁর অনিমার জন্য করা প্রতিটা কষ্ট। অনিমাকে সে মানুষের মত মানুষ করতে পেরেছে।অনিমার মধ্যে নেই কোনো অহংকার , নেই কোন অহমিকা।কারও কষ্ট তার মধ্যে তোলপাড় করে ফেলে।মা-বাবার আদর্শ নিয়েই গড়ে ওঠেছে সে।বড় বড় সিজার হয় এখন অনিমার হাতে।মেয়ের এ সফলতার চেয়ে বড় স্বার্থকতা একজন মায়ের কাছে আর কি হতে পারে।আজ পুরো পৃথিবীকে তার সুখের সঙ্গী করতে ইচ্ছা করছে অপর্ণার।
সমাপ্ত