জীবনের জোয়ার ভাটা

জীবনের জোয়ার ভাটা

— “আচ্ছা, আমি কি দেখতে সুন্দর?”

— “না।”

— “তাহলে সবাই যে আমায় সুন্দর বলে?”

— “ভুল বলে।”

— “কেন?”

— “এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা সৃষ্টিই সুন্দর। শুধু কেউ কম সুন্দর, কেউ মোটামুটি সুন্দর, কেউ অতিরিক্ত সুন্দর, কেউ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর। আর তাই যারা তোকে শুধু সুন্দর বলে, তারা ভুল। তুই শুধু সুন্দর না। তুই মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর।”

— “হ্যাঁ থাক, খুব হইছে। যদি খুব সুন্দরই হতাম, তুই রাতদিন আমার প্রশংসা করতি।”

— “সুন্দরীদের চারপাশে প্রশংসা করার মানুষের অভাব থাকে না। তাই আমি করিনা।”

— “ধুর, তুই একটা বোরিং।”

— “বোরিং না। বল এক্সসেপশোনাল। আচ্ছা অর্পিতা, তুই তো সুন্দর। খুব সুন্দর। তোর কি মনে হয়? এটা কি তোর ক্রেডিট? কিংবা এর পিছে তোর কোনো হাত আছে?”

— “অবশ্যই না। আমি কি সেটা বলেছি নাকি?”

— “তোর যদি ক্রেডিট নাই থাকে তবে তোকে এতো প্রশংসা করতে হবে কেন?”

— “তোর প্রশংসার আমার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। হুহ।”

— “একসময় দেখবি পৃথিবীতে এই ফালতু, যুক্তিহীন বিষয়টা থাকবে না। সবাই বাহ্যিক সুন্দরের পিছে হুমড়ি খেয়ে পড়বে না। সবাই তখন যে নিজের কর্ম দিয়ে সুন্দর তার পিছে হুমড়ি খাবে। আমরা এখনো অনেক অযৌক্তিকতাকে আবেগের বশে বরণ করে নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে তা কখনোই থাকবে না।”

— “হইছে, লেকচার থামান স্যার। এখন চলেন। ফুচকা খাবো।”

— “অর্পিতা, তোকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি।”

— “তোর এতো ভয়াবহ কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না। তবুও বল।”

— “বি সিরিয়াস।”

— “হুম ড্যাম সিরিয়াস।”

— “কোনো ভনিতা বাদ দিয়ে সরাসরি বলবো?”

— “আরে গাধা বল।”

— “আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে চাই।”

— “হা হা হা, এর থেকে আমার ফুচকা খাওয়া বেশি সিরিয়াস। চল ফুচকা খাবো। বিল তুই দিবি।”

— “আমি কিন্তু সত্যিই সিরিয়াস।”

— “এতো সস্তা রসিকতা এখন ভালো লাগছে না।”

— “আমার চোখের দিকে তাকা।”

— “তোমার সুন্দর চোখের পানে তাকালে এই অর্পিতা কি প্রেমে পড়ে যাবে বালক?”

— “তাকা বলছি।”

— “তাকালাম।”

— “আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি রে। আমি তোকে বিয়েও করতে চাই। আমি ভালো গান গাইতে পারি। তুই দেখিস, আমি একদিন অনেক বড় গায়ক হবো। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোকে বিন্দুমাত্র টেনশন করতে হবে না।”

— “তুই কি স্বাভাবিক আছিস?”

— “হ্যাঁ।”

— “আসলে আমি সব বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু বলি না। কারণ তোকে আমি অনেক অনেক ভালো একটা বন্ধু ভাবি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোকে নিয়ে আমি কখনোই এসব চিন্তা করতে পারবো না। তাছাড়া, ভবিষ্যৎ বলতে একটা কথা আছে। স্বীকার করছি তুই ভালো গান পারিস। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। এসব দিয়ে জীবন চলবে না। তুই অনেক ভালো একটা ছেলে। আমার থেকে অনেক ভালো মেয়ে পাবি। আমার সাথে আর যোগাযোগ করিস না। সেটাই অনেক ভালো হবে তোর জন্যে। ভালো থাকিস। আজ ফুচকা খাবো না। ভালো লাগছে না। নিজের খেয়াল রাখিস।”

চার বছর পর, অর্পিতা আমায় নদীর পাড়ে আসতে বলেছে। এর থেকেও তো অনেক ভালো জায়গা ছিল। তো মেয়েটা এখানে কেন ডাকলো বুঝলাম না। আজ দীর্ঘ চার বছর পর আমার অর্পিতার সাথে দেখা হবে। কথা হবে। সেদিন প্রপোজ করার পর থেকে আমি নিজ থেকেই আর অর্পিতার সাথে যোগাযোগ করি নি। অর্পিতাও করে নি। কেনই বা করবে? অর্পিতা কি আমায় ভালোবাসে নাকি? তখনকার সেই বোকা সহজ সরল আমিকে কেই বা ভালোবাসতো? আসলে আমি তখন অর্পিতার যোগ্য ছিলাম না। অর্পিতা সেটা প্রত্যেক্ষভাবে না বললেও পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমার এই অযোগ্যতাটাও ছিল সম্পূর্ণ বাহ্যিক। আমি নম্র, ভদ্র, দেখতে শুনতে, আচার-আচরণে ভালোই ছিলাম। কিন্তু হ্যান্ডসাম, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এগুলো না থাকায় বোধহয় আমি অর্পিতার যোগ্য ছিলাম না।

জীবনে বড় কোনো আঘাত পেলে দুইটা জিনিস হতে পারে। প্রথমত, খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারে। আর দ্বিতীয়ত, সেই আঘাত থেকে শিক্ষা নিয়ে অতি অসাধারণ কিছু হতে পারে। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছিলাম। প্রথমেই নিজের সরলতাকে বলি দেই। তারপর জীবনে একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি এবং সফল হয়েছি। আজ আমি একজন গায়ক। বড় মাপের গায়ক। লোকজন আমায় দেখলেই আমার থেকে অটোগ্রাফ নেয়। সেলফি তোলে।

অর্পিতা দুপুর আড়াইটায় নদীর পাড়ে আসতে বলেছিলো। এখন প্রায় তিনটা বাজে। আমি গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বললাম, গাড়িতে বসে থাকতে। নদীর পাড়ে একটা বড় আমগাছ আছে। কেউ একজন নীল শাড়ি পড়ে গাছের নিচে ঘাসে বসে আছে। আমি কাছে গেলাম। অর্পিতাই বসে আছে। অর্পিতার চুল গুলো খুলে দেয়া। কি সুন্দর লাগছে পিছন থেকে। এখন ভাদ্র মাস। কিন্তু নদীর পাড়ে কোথাও কাশফুল দেখতে পেলাম না। হয়তো অন্য জায়গায় আছে, এখানে নেই। নদীটা বেশ ছোট। আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে। দক্ষিণে প্রচুর মেঘ। আমার দাদী বলতো, দক্ষিণের মেঘে নাকি বৃষ্টি হয়না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি হবে। প্রচুর বৃষ্টি। আমি অর্পিতার পিছনে যেয়ে দাঁড়ালাম। অর্পিতার শরীর থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছি। খুব করে পারফিউমের নামটা মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে করতে পারছি না। অর্পিতা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,

— “দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”

আমি দুইটা কারণে অবাক হলাম। প্রথম কারণ, অর্পিতা আমায় তুমি করে বলছে। দ্বিতীয় কারণ অর্পিতা এমন ভাবে আমায় বসতে বললো যেন সকালে আমরা একসাথে দু’ঘন্টা ধরে রিক্সায় ঘুরেছি। দুপুরে আবার দেখা হয়েছে। এবং অর্পিতা আমায় দেখে কোনো রকমের অবাক না হয়ে স্বাভাবিক গলায় বসতে বলছে। কিন্তু অর্পিতার সাথে আজ চারবছর পর দেখা হলো। তাই তার অবাক না হওয়াতেই আমি অবাক হচ্ছি। আচ্ছা, অর্পিতার কি বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে?

— “কি হলো? বসো। নাকি ঘাসের উপর বসলে প্রেস্টিজ চলে যাবে?”

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ পা ছড়িয়ে ঘাসের উপর বসলাম। চোখের সামনে নদী। তারপর সবুজ আর সবুজ। তারপর নীল আর সাদা আকাশ। মনে হচ্ছে, ক্লাস ফাইভের কোনো চিত্রশিল্পী খাতায় ছবি এঁকে রেখেছে। অর্পিতা খুব নরম স্বরে স্বাভাবিক গলায় বললো,

— “কেমন আছো?”

আমি অর্পিতার দিকে তাকালাম। এবং আরেকবার অবাক হলাম। অর্পিতা আগের থেকে কয়েকগুণ সুন্দর হয়েছে। কোনো নায়িকা সিনেমা জগতে চার বছর পার করার পর প্রথমের থেকে যেমন রাতদিন পার্থক্যের মতো সুন্দর হয়, ঠিক তেমনি অর্পিতাও হয়েছে। চোখে খুব হালকা করে কাজল দেয়া। ঠোঁটের উপর একটা তিল। আগে তো তিল ছিলো না। এখন এই তিল কই থেকে আসলো?

— “কি রে? কেমন আছো?” আমি অর্পিতার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,

— “আমি সবসময়ই ভালো থাকি। ভালো থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করি। তুমি কেমন আছো?”

— “তোমায় আগের থেকে অনেক চেঞ্জ লাগছে। চেনাই যাচ্ছে না। আচ্ছা, আমায় কেমন লাগছে? ওই নীল আকাশটাকে বেশি সুন্দর লাগছে নাকি আমাকে?”

— “নীল আকাশটাকে।”

— “নদীতে নৌকা আছে। চলো নৌকায় কিছু সময় কাটাই।”

— “না।”

— “তুমি বিজি নাকি? আসতেও দেরি করলে যে?”

— “ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।”

— “সরি। বুঝলাম না।”

— “আমি দুপুর ছাড়া আর ঘুম থেকে উঠতে পারি না। আর ঘুমাই ভোরে।”

— “ও। তুমি কিছু প্রশ্ন করো। আমি হাজার হাজার কথার ভীড়ে আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না।”

— “আচ্ছা, আমি কি ভালো গান পারি অর্পিতা?”

— “না।”

— “কেন?”

— “তুমি শুধু ভালো নয়, মাত্রাতিরিক্ত ভালো গান গাইতে পারো।”

— “তো, তুমি আমার প্রশংসা করছো না যে?”

— “সেলিব্রিটিদের চারপাশে প্রশংসা করার মানুষের অভাব থাকে না।”

— “এই চার বছরেই দেখি কর্মের সৌন্দর্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।”

— “হ্যাঁ। খুব। আচ্ছা, তুমি কাউকে কি ভালোবাসো?”

— “হ্যাঁ।”

— “আমায়?”

— “হা হা হা। এই সুন্দর পরিবেশে এমন সস্তা রসিকতা ভালো লাগছে না। তোমায় কেন হতে যাবে? তাছাড়া তুমি আমার অনেক অনেক ভালো একটা বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার এর থেকে বেশী কিছু আমি কখনোই ভাবতে পারবো না। তাছাড়া ভবিষ্যৎ বলতেও তো একটা কথা আছে। এসব সৌন্দর্য দিয়ে তো আর জীবন চলবে না। বাস্তবতা অনেক কঠিন।”

— “আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?”

— “কোনো সমস্যা আছে?”

— “না। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি তোমায় আজ সরি বলার জন্য এসেছি।”

— “আমি সবই বুঝতে পারছি অর্পিতা। কিন্তু যে অযোগ্য আমিকে ভালোবাসে নি, তার যোগ্য আমিকে ভালোবাসার কোনো অধিকার নেই।”

— “হুম। আমি নাহয় ভুল করেছি যোগ্য অযোগ্যতার বিচার করে। কিন্তু তুমিও তো এখন সেই বিচারই করছো। সেই ভুলই করছো। তাহলে তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য কই থাকলো? এভাবে ভুলে ভুলে ভুলটাকে সারাজীবনের কষ্টের কারণ করিও না। তাছাড়া আমি জানি তুমি আমার পরে আর কাউকেই ভালোবাসো নি।”

— “আমি কি করবো না করবো সেটা কাউকে জবাবদিহিতার প্রয়োজন বোধ আমি আর করি না।”

— “তুমি এসব কথা মন থেকে বলছো না।”

— “আমি মন থেকে বলবো নাকি বাহির থেকে সেটাও আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

প্রচুর মেঘ ডাকছে। এক নিমিষেই পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। অর্পিতা তবুও চুপচাপ নিশ্চিন্তে বসে আছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি আসবে। আমার বৃষ্টিতে ভিজতে প্রচুর ভালো লাগে। কিন্তু আজ ভালো লাগাটাকে প্রাধাণ্য দেয়া উচিৎ হবে না। আমি ইচ্ছা করলেই এখন অর্পিতা আর আমার গল্পের হ্যাপি এন্ডিং দিতে পারি। ইচ্ছা করলেই স্যাড এন্ডিং। আচ্ছা, আমার কি করা উচিৎ? এসব ভাবতে ভাবতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। অর্পিতাও। অর্পিতা নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অর্পিতার দিকে। অর্পিতার কয়েকটা ভেজা চুল এসে চোখে মুখে পড়লো। অর্পিতা তবুও এক দৃষ্টিতে নদীর উপর বৃষ্টির ফোঁটা দেখছে। আচ্ছা, অর্পিতা কি কাঁদছে? কাঁদাই তো উচিৎ। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে অর্পিতা কাঁদছে না। আমি অর্পিতাকে বললাম,

— “বৃষ্টি খুব বাড়ছে অর্পিতা। আমি গেলাম। তুমিও যাও।” অর্পিতা নদীর দিকে তাকিয়েই বললো,

— “আমি যাবো না। বৃষ্টিতে ভিজবো আর ভিজবো। তারপর জ্বর আসবে। ১০২ ডিগ্রী জ্বর। ভালো হবে না? বলো।”

আমি হাঁটা শুরু করলাম। মনে হচ্ছে আমগাছ থেকে গাড়িতে যেতে আমার কয়েকবছর লাগবে। আচ্ছা, অর্পিতা কি এখন কাঁদছে? আর অর্পিতা কাঁদবে কিনা তা আমি কিভাবে বুঝবো? আমি কাঁদছি কিনা সেটাই তো বুঝতে পারছি না। অর্পিতা কি এখনো নদীর দিকে তাকিয়ে আছে নাকি আমায় দেখছে? পিছনে কি তাকাবো আমি? তাকালেই কি হবে? তবুও আমি তাকালাম না। আমি কি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত