ছবিওয়ালা

ছবিওয়ালা

নিশিকে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হয়।কিছু রুটিনবাঁধা নিয়মে এগোতে হয় তাকে।সকালে দুইটা প্রাইভেট শেষ করে তারপর কলেজের ক্লাস, সেখান থেকে ফিরে অল্প সময় রেস্ট নিয়ে বাচ্চাগুলোকে অক্ষর শিখাতে হয়।বাচ্চাদের পড়িয়ে উঠতে উঠতেই সন্ধ্যে নেমে অাসে ব্যাস।এরপর নিজের পড়া শেষ করতে করতেই ঘড়ির কাঁটা এসে থামে বারোটায়।ক্লান্তি লাগলেও কোনটাকেই এড়িয়ে যেতে পারেনা সে।কেবল সপ্তাহের শুক্রবারটাই যেন সে গলা ভরে শ্বাস নিতে পারে।

নিশি পরিবারের বড় মেয়ে।বড় ছেলের মতই সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে।তাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার।মা, বাবা অার ছোট দুই বোন। নিশির বাবা একটা হাইস্কুলে কেরানির চাকুরী করে সামান্য বেতন পায়।ওটুকুতে বর্তমান যুগে সংসার ঠিকিয়ে রাখা বেশ মুশকিল।তাইতো অার্থিক টানাপোড়ন থেকে রেহাই পেতে নিশি বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে মাস শেষে কিছু টাকা পায়।ওই টাকায় নিজের হাত খরচ মিটিয়ে বাড়তি টাকা সে সংসারে দেয়।এতে নিশির বাবা – মা দুজনেই খুশি।

নিশির জীবনটা খুবই সাদামাঠা।সে চাইলেই পারে তার জীবনকে রঙিন চকচকে করে তুলতে।কিন্তু অভাবের সংসারে ওসব কি অার মানায়।তাছাড়া ওসব করার সময়-ই বা অাছে কই।কলেজের ছেলেমেয়েদের অাধুনিকতা দেখে মাঝেমাঝে অবাক হয় সে।একঝাঁক ছেলেমেয়ে ফুসকার দোকানে ভীড় জমিয়ে রাখে, কেউ কেউ অাবার দামী রেস্টুরেন্টে নি:শব্দে ঢুকে যায়, কয়েকজোড়া মানুষ অাবার হাত ধরে এদিক-ওদিক হেঁটে চলে।কত কি বাহার তাদের। নিশির দুই বান্ধবী সাবিরা অার প্রিয়া ওরাও নিশির মতই সাদামাঠা, অভাবি।সংগ্রাম চালিয়ে সমাজে ঠিকে অাছে।তারা তিনজনই একসাথে থাকে বেশিসময়।স্কুলের বন্ধু বলে কথা।গলায় গলায় ভাব তাদের।ইদানিং প্রিয়ার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।বলতে গেলে বিয়ে একপ্রকার ঠিক হয়েই অাছে।ছেলে দেখতে সুন্দর, স্মার্ট।সরকারি ব্যাংকে ভালো পোস্টে চাকুরি করছে।সবকিছু ঠিকঠাকমত চললে অাগামি মাসেই বিয়েটা হওয়ার সম্ভাবনা একশ ভাগ।

এক মাস ১২দিন পরের ঘটনা প্রিয়ার বিয়ের অায়োজন চলছে।নিশি অার সাবিরা সকাল থেকেই প্রিয়ার সাথে সাথে অাছে।দুইজনেই সেজেছে বেশ মন ভরে।একমাত্র বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা, একটু ভারি সাজ না দিলে হয়।শাড়ির সাথে মায়াবী সাজে কেউ নিশির প্রেমে পড়ে যাবেনা এমনটা কখনও এর অাগে হয়েছে।প্রতিবারের মত অাজও তার ব্যতিক্রম কিছুই হয়নি।নিশিকে প্রথম দেখেই প্রেমের জলে হাবুডুবু খেতে শুরু করল বরপক্ষের ফটোগ্রাফার সৌরভ।ছেলেটার হাবভাব দেখেই নিশি বুঝে গিয়েছে তার মনের ভিতর ঠিক কী চলছে।

যেহেতু ক্যামেরা হাতে পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে সৌরভ ছেলেটা ছিল তাই নিশি যতটা সম্ভব নিজের ছবি তোলাকে এড়িয়ে গেল।কয়েকটা জয়েন ফটো তুলেছে শুধু।এর বাইরে একটাও এক্সট্রা ছবি তুলেনি।যদিও নিশি অাজ অনেকগুলা ছবি তোলার প্ল্যানিং করে এসেছিল।মধ্যরাতেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়।তারপর ভোর হওয়ার অপেক্ষায় থাকে সবাই।রাতের শেষভাগে নিশি অার সাবিরা মিলে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে অাড্ডা দিচ্ছিল এমন সময় হুট করে ক্যামেরা হাতে লোকটা এসে হাজির। অাজব ব্যাপার।ছেলেটা কিছুই বলেনি।একপলক দেখেই চলে গেল।নিশি যেন একটু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল।এতক্ষণ সে কি ভয়েই না ছিল।ছেলেটা কি বলতে কি বলে ফেলবে।যাক এবারের মত বাঁচা গেল।সকাল হওয়ার অপেক্ষাতেই মুখিয়ে রইল নিশি।এখান থেকে ছুটতে পারলেই বাঁচে।সাবিরা হঠাৎ বলে উঠল- হ্যাঁ রে নিশি লোকটার মতলব কি ছিল বুঝলামনা? নিশি ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞাস করল – কোন লোক?

– ওই যে ফটোগ্রাফার ছেলেটা…
– তা অামি কি জানি।

এটুকু বলেই কিছু না বুঝার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিল নিশি। তারপর সকাল হলে কন্যা বিদায়ের সময় প্রিয়াকে জড়িয়ে দুই বান্ধবীর কান্না যেন দেখার মত ছিল।প্রিয়ার বাবা-মাও এতটা কাঁদেনি যতটা কেঁদেছে দুই বান্ধবী।চোখের জলে ভাসছিল পুরো কমিউনিটি সেন্টার।এরপর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যে যার গন্তব্যে ফিরে অাসে।বাড়ি অাসার পর নিশির এক ঘুমে দুপুর।অাগের রাতে নির্ঘুম থাকলে যা হয় অারকি।সেই ঘুমে সন্ধ্যা নেমে অাসত যদি তার মা তাকে ঝাঁকানি দিয়ে না ডেকে দিত।যাদের রাত জাগার অভ্যেস নেই তারা একরাত ঘুম যেতে না পারলেই পরবর্তী দুই রাত ঘুম যেয়ে সেটা পুষিয়ে নিতে পারেনা।নিশির বেলাতে ঠিক সেটাই হল।

পরদিন ঘুমে ঘুমে দুইটা প্রাইভেট মিস।তবে কলেজের সময়টা হাতে অাছে এখনো।ওটা মিস দেয়া যাবেনা।নিজের ফোন হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলা মিসডকল সাবিরার।নিশি কল ব্যাক করে জানতে চাই – সাবিরা, কোথায় তুই?
সাবিরা জবাব দেয়- এইতো ফয়সাল ভাইয়ার প্রাইভেট শেষ করে এখন কলেজে যাচ্ছি।এতবার তোরে ফোন দিলাম তুলছিলিনা কেন?

– ঘুমে ছিলাম রে.. অামি অাসতেছি কলেজে।
– হুম অায়।

এরপর নিশি মিনিট বিশেকের মধ্যে রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। কলেজ অভিমুখে যাওয়ার পথে বাঁধে মহা ঝামেলা।পথিমধ্যে ১২-১৪ বছরের এক স্কুল পড়ুয়া ছেলে এসে তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিতে চাইল।নিশি প্রথমে নিতে চাইনি সেটা।পরে ছেলেটার জোরাজুরিতে রাজি না হয়ে পারেনি।কে পাঠিয়েছে খামটা, কে দিতে বলেছে তোমাই ওটা জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটা হাওয়া হয়ে গেল।নিশ্চয় কেউ না কেউ ছেলেটার হাতে এটা পাঠিয়েছে।তবে সেটা কে হতে পারে।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়ে খামের উপর ছোট্ট একটা লেখায়।যেখানে লেখা অাছে- “স্যরি ফর সিক্রেট ক্যাপচার”।নিশি কিছু একটা অান্দাজ করে।তারপর খামটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।

নিশি এক এক করে কলেজের সব ক্লাস শেষ করে।খামের ব্যাপারে সাবিরাকে কিছুই বলেনি সে।খামের উপর ছোট্ট লেখাটায় চোখের সামনে ভাসছিল তার।কি থাকতে পারে ওটার ভেতরে।নিশি ব্যাগের সামনে থেকে অাজকে অার নড়েনি।অন্যদিন সে একবারের জন্যও হলেও ওয়াশরুম থেকে ঘুরে অাসত।অার অাজ তাকে এত জোরাজুরি করেও ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে পারেনি সাবিরা।ভয়ে ভয়ে ছিল সবসময় যদি ব্যাগে হাত দিয়ে কেউ ওটা দেখে ফেলে।তখন অাবার বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।এরপর নিশি খুব সাবধানে বাড়ি ফিরে।

বাড়ি পৌঁছে প্রথমেই নিশি রুমের দরজাটা অাটকে দেয়।পাখা ছাড়ে।তারপর ব্যাগ থেকে খামটা বের করে বিছানার উপর ঝপাং করে শুয়ে পড়ে অাড়াঅাড়িভাবে।খামের উপরে লেখাটার উপর অারো একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে।এবার নিশি খামের ভিতর থেকে একটা লেমেন্টিং করা ছবি বের করে নেয়।অাশ্চর্য্যের বিষয় ছবিটা নিশির-ই।সেদিন প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে যখন সে কাঁদছিল তখনি কেউ গোপনে তুলে রেখেছে ছবিটা।খাম থেকে পরপর অারো কতগুলি ছবি বের করে নিশি।তবে সবগুলা ছবিই একই সময়ে বিভিন্ন এংগেল থেকে তোলা।নিশির বুঝতে অার বাকি থাকেনা যে এটা সেই ছবিওয়ালার-ই কাজ।ভাবতেই অস্ফুট হাসি পায় নিশির।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত