ভদ্র মহিলার দিকে টাকার খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম ” আন্টি এগুলা আপনার বেতন” ভদ্রমহিলা খানিকটা ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে সামলে নিয়ে বললেন ” আমার বেতন মানে? এইটাতো তোমার গত মাসের বেতন, একটু আগে আমি তোমাকে দিলাম” দাঁতে দাঁত চেপে হাসতে হাসতে বললাম ” না আন্টি এগুলা আপনার ই বেতন” আমার ক্লাস এইটে পড়ুয়া স্টুডেন্ট টা আই মিন ভদ্র মহিলার ছেলেটা কি বুঝল কে জানে সেও আমার সাথে তাল মিলিয়ে বল উঠল ” আহা আম্মু স্যার যখন তোমাকে টাকাটা দিচ্ছে, নিয়েই নাওনা৷ তুমিও বেতন পাচ্ছ হিহি৷ আর তোমাকে আব্বুর পকেট থেকে টাকা চুরি করতে হবে না।
হিহি “ভদ্র আন্টি তার ছেলেকে মারল ঝাড়ি “তুমি চুপ থাকো, একদিন মানা করেছিনা বড়দের মাঝে কথা বলবেনা।ঝাড়ি খেয়ে আমার ছাত্রটা বাধ্য সন্তানের মতন চুপ হয়ে গেলে। ভদ্র আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল ” তুমি কি বলতে চাইছ আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ছেলেকে গত এক মাস পড়িয়েছ, তাই এইটা তোমার এক মাসের বেতন। আর তুমি উলটা বলছ আমার বেতন। আরেবাবা আমার বেতন হতে যাবে কেন?” আমার ছাত্র আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল ” স্যার তাত্তাড়ি বলে দিন, নাইলে আমার আম্মু আপনাকে মারবে। আমার আম্মু কিন্তু আমার আব্বুকে ডেইলি মারে। ”
ভদ্র আন্টি মাথাটা খুবজোর ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এতগুলা টাকা আমার বেতনের জায়গায় যদি সত্যি সত্যি ওনার বেতন হয়ে যায় তবে ক্ষতি তো না। কিন্তু ওনার বেতন কেন হতে যাবে এই কারণটাতো জানতে হবে। ভাবলাম কারণটা ভদ্র আন্টিকে জানানো কারণটা জানানো জরুরী। ভদ্র আন্টি দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করতে করতে করতে বললেন ” বাবা, বেতনটা তো আমার বুঝলাম। কিন্তু আমি তোমার কি এমন কাজ করে দিলাম যে তুমি আমাকে তোমার প্রাপ্য বেতন আমাকে দিতে চাচ্ছ।” আমি আবার জিহবা দাঁতের তলে কামড় দিয়ে বললাম ” কি করেননি আন্টি আপনি তাই বলুন”। অমনি আমার ছাত্রটা দাঁতের তল থেকে কলমটা বের করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ” তাহলে কি স্যার, আম্মু যে আপনাকে ডেইলি চা নাস্তা এনে দিত, এইটার জন্যে বেতন দিচ্ছেন”। ছাত্রের মা আই মিন ভদ্র আন্টি মাথা নাড়ল ছেলের কথায় ” হ্যা বল বাবা, সে জন্যে বেতন দিচ্ছ?”।
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম ” না আন্টি সেজন্যে না” ভদ্র আন্টি আবার দাঁতের তলে দাঁত রেখে কটমট করে বলল ” তাহলে কেন? আমি তোমার কি কাজ করলাম” আমি মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে বললাম ” আসলে আন্টি কিভাবে যে বলি কথাটা?” ভদ্র আন্টি শান্ত থাকার অভিনয় করে বলল ” বল বাবা, লজ্জা পেয়োনা। বল বাবা, কি কাজ করে দিলাম আমি তোমার?” আমি গাল চুলকাতে চুলকাতে বললাম ” বলব আন্টি?” ভদ্র আন্টি রাগ সামলে বললেন ” বল বাবা বল” আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম ” সত্যি বলব আন্টি?” ক্লাস এইটে পড়ুয়া স্টুডেন্ট টা বলে উঠল বলে দেন স্যার বলে দেন। ভদ্র আন্টি ছেলের সাথে মাথা নাড়লেন। ভদ্র আন্টির দিকে মাথা ঘুরিয়ে শান্তস্বরে বললাম – না মানে আসলে গত মাসেই তো আপনারা আমাকে টিউশানটা দিলেন। তাইনা?
– হ্যা দিয়েছি তো!
– তো প্রথমে তো আপনি ক্লাস এইটের সম্পূর্ণ সিলেবাসের উপর আমার একটা ওয়াক-ইন- ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, তাইনা?
– হ্যা নিয়েছি। তো?
– আমি তো সেই পরীক্ষায় পাশ করলাম তাইনা?
– হ্যা করেছ তো?
– তার মানে কি ডিফাইন্ড করে, ডিফাইন্ড করে যে আমি আপনার ছেলেকে পড়ানোর যোগ্য তাইনা?
– হ্যা যোগ্য।
– যোগ্য আই মিন পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করার পর বলেছিলেন আপনার ছেলেটাকে যেন আমি মন দিয়ে পড়ায়। তাই না?
– বলেছি তো। তো কি হয়েছে?
– তারপর থেকেতো আপনার ছেলেকে পড়ানোর জন্যে আমি আসা শুরু করলাম। তাইনা?
– হ্যা আসলে। তুমি তো একদিন ও ফাঁকি দাওনি।
– আমার ছাত্র ও আমার কাছে পড়তে বসল।
– আরেবাবা বসল তো। এইটা আমিও জানি।
– সমস্যা সেটা না আন্টি।
– তাহলে?
– আসলে গত এক মাসে প্রায় বারো দিন আমি আমার ছাত্রটাকে পড়াতে আসলাম। তাইনা?
– আরেবাবা কথা এত প্যাঁচাচ্ছ কেন? কি হয়েছে ক্লিয়ার করে বলোনা৷
– বারোদিন ই আমি আসলাম। অথচ আমার কি দূর্ভাগ্য আমি আমার ছাত্রটাকে একটা দিন নিজের মত করে পড়ানোর সুযোগ পেলাম না।
– মানে?
– মানে বলব আন্টি?
– আরে বাবা বল কি হয়েছে? এত সংকোচ করছ কেন?
– না আসলে হল কি আন্টি, প্রথম দিন আমি আসলাম। এসে একটা গল্প শোনালাম।
গল্পটা শুনে ছেলেটা ভীষণ এক্সাইটেড হল। আমার কাছে পড়তে সে রাজী হল। আমি ওরে অংক বই নিতে বললাম। সাথে সাথে হৈ চৈ করে আপনি ভেতরের রুম থেকে এন্ট্রি নিলেন। আমার ধারণা আপনি রোজ ঐ যে পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এন্ট্রি নিয়েই আমাকে বললেন ” না না, বাবু এখন ম্যাথ পড়বেনা। এখন ওর সাইন্স পড়ার টাইম। আমি আপনার বাবুর দিকে তাকালাম। আপনার বাবু চোখের ইশারায় বোঝালো সে এখন ম্যাথ ই করতে চায়। আমি তার ইশারাটা বুঝে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
আপনি আমাকে বললেন আমি যা বলছি, তাই কর। আপনার কথামতন সাইন্স পড়াতে নিলাম। অধ্যায় দুই। খুব ইন্টারেস্টিং টপিক৷ আপনি আবার পর্দার আড়াল থেকে দৌড় মেরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন- না, না, বাবুর এই অধ্যায়টা সিলেবাসে নেই। অন্য অধ্যায় পড়ান। আমি তখন আপনার বাবুর চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম সে বিরক্ত, আমি যা পড়াতে চাইছিলাম সে তা পড়তেই আগ্রহী। কিন্তু ঐ যে ” আমি যা বলছি তা করো” তেমন একটা আদেশ আমার উপর ইতিমধ্যেই ধার্য্য করে দিলেম। আমিও আজ্ঞা পালনে অন্য অধ্যায় পড়াতে নিলাম। ছাত্রকে দেখিয়েও দিলাম। আমার ছাত্র সেটা পড়তে আরম্ভ করল অমনি আপনি আবার এন্ট্রি নিয়ে আপনার বাবুকে দিলেন ভয়ংকর ঝাড়ি। কি পড় এত আস্তে আস্তে, পড় জোরে জোরে যেভাবে আমি পড়ছি। আমিও ভয় পেলাম, খেয়াল করলাম আমার বাবুও ভয়ে কেঁপে উঠল। এরপর তো আপনি আর ভেতরেই গেলেন না। নিজেই বসে গেলেন পড়ার টেবিলে।
আপনি নিজেই আপনার বাবুর পড়াটা পড়তে আরম্ভ করে দিলেন। আপনার বাবু বলল “আম্মু এইটা আমার পড়া” আপনি তাও শুনলেন না। পড়তেই থাকলেন। একসময় ক্লান্ত হয়ে ভেতরে চল গেলেন। চা নাস্তা আনলেন। এসব সার্কাস করতে করতে এদিকে আমি ঘড়িতে দেখি আমার পড়ানোর জন্যে যে নির্ধারিত সময় আপনি ঠিক করে দিলেন তা ইতিমধ্যেই শেষ। আমি স্টুডেন্টকে হোমওয়ার্ক দিয়ে চল গেলাম। এইটুক বলে থেমে গেলাম। ভদ্র আন্টি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন। আমার ছাত্রটা দু গালে দু হাত দিয়ে পড়ার টেবিলে ভর করে আমার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে। আমার কথা থেমে যাওয়ায় ছেলেটা মুখে বিরক্ত এনে বলে উঠল ” আহা, স্যার আপনি বলুন স্যার। থামলেন কেন স্যার।”
আমি আবার ভদ্র আন্টির দিকে তাকিয়ে বললাম – এভাবে পরের দিন আসলাম সেই একই ঘটনা। এর পরের দিন। এর পরের দিন। এর পরের দিন। এর ও পরের দিন, প্রত্যেক দিন ই একই ঘটনা। আমি শুধু আসি, চা নাস্তা খাই, আর আপনার ছেলেকে হোমওয়ার্ক দিয়ে চলে যাই। গল্প শোনাতে দেননা, ওর সাথে কোন আইকিউ গেইম খেলতে দেননা। ওর সাথে এই পৃথিবী এত শত রহস্য নিয়ে কথা বলতে চাই তা দেননা। আপনি শুধু এন্ট্রি নেন। আমাকে সিলেবাস দেখিয়ে দেন৷ কিভাবে খুব দ্রুত পড়া মুখস্ত করবে তার জন্যে তাগাদা দেন। আমার সামনেই ছেলের গায়ে হাত দেন। সব কাজ ই আপনি ই করে দেন। আমি শুধু আসি, দর্শকের মতন আপনার পারফর্মেন্স দেখি। মনে মনে হাততালি দিই। চা-নাস্তা খাই। আর ঘড়ির টাইম দেখে চলে যাই। এখন আপনি ই বলেন আন্টি বেতনটা কার প্রাপ্য? আমার না আপনার? ভদ্র আন্টি তখনো হা হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমার ছাত্র আই মিন ভদ্র আন্টির ছেলে বলে উঠল ” আম্মু এভাবে তাকিয়ে আছ কেন, স্যার এর প্রশ্নের উত্তর দাও। স্যারের যুক্তিমতে টাকাটাতো তুমি ই প্রাপ্য। হিহি” ভদ্র আন্টি তার ছেলেকে আবার ঝাড়ি মারতে গিয়েও আর মারলেন না।
আমার কথা শেষ। পরের মাসটা চলতে খুব কষ্ট হবে জেনেও টাকার খামটা টেবিলে ছেড়ে উঠে চলে আসব। পা বাড়ালাম দরজার দিকে। দুই কদম বাড়াতেই টের পেলাম পেছন থেকে আমার ছাত্রটা জড়িয়ে ধরে ফেলল আমাকে। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল ” স্যার আপনি আর আসবেন না আমার কাছে?”মন অনেকটা শক্ত করেই জবাব দিলাম ” নারে, চ্যাম্পিয়ন” ছেলেটা এবার প্রায় উচ্চস্বরে কেঁদে বলল ” আমাকে তাহলে গল্প কে শোনাবে? কে হবে আমার বেস্ট স্টোরিটেলার? “চোখের জল সামলে ছাত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম ” শুধু চোখ কান খোলা রাখবি, চ্যাম্পিয়ন। তাহলে গল্প তুই নিজেই একদিন শোনাতে পারবি এই গোটা পৃথিবীকে” পা বাড়ালাম। পেছন থেকে আমার ছাত্রের মা কি মনে করে যেন ডাক দিল ” দাঁড়াও, প্লিজ।
টাকাটা নিয়ে যাও” আমি আরেকবার দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম ” বেয়াদবি মাফ করবেন আন্টি, একটা হাউজ টিউটর শুধুমাত্র ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১২ দিন দাগিয়ে মাস শেষে মাইনে নেয়ার জন্যেই কিন্তু এই অঘোষিত সম্মানজনক পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে না। এখান থেকে আপনার ছেলের মতন কারো কারো সাথে ইশারায় যে আত্মার সম্পর্ক হয়ে ওঠে তা আপনি কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পারবেন না। আরেকটা কথা আন্টি, নিজের পেটের ছেলেকে মানুষ করতে চাইলে, আরেক মায়ের পেটের ছেলেকে বিশ্বাস আর ভরসা করাটা খুব জরুরী। খুব। ভালো থাকবেন। ভালো থাকিস চ্যাম্পস তুইও।