বুড়িগঙ্গা নদীতে মাথা বিহীন অর্ধগলিত একটি মানব দেহ ভেসে উঠেছে। ধারাল কিছু দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে দেহ থেকে মাথাকে পৃথক করা হয়েছে। সন্ধ্যার পরপর সদরঘাটের বয়োজ্যেষ্ঠ মাঝি হানিফ মিয়া সর্বপ্রথম ভাসমান দেহটি দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। তারপর ডুবুরীর মাধ্যমে লাশটিকে পাড়ে উঠানো হয়। পুলিশের ধারনা প্রায় ৪/৫ দিন মৃত দেহটি পানির তলায় ছিল। লাশের চারপাশে জুড়ে উৎসুক জনতার ভীড়,বিচ্ছিরি দূর্গন্ধ বের হচ্ছে বিকৃত শরীর থেকে।
লাশটি পাড়ের যে পাশটায় উঠানো হয়েছে তারথেকে অানুমানিক ৫০/৬০ গজ দূরত্বে হাজী লেনের ৩নং বাড়িটি আসাদ চৌধুরীর। সেখানে মহা ধুমধামে বিয়ের সানাই বাজছে। আসাদ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে চৈতীর বিয়ে আজ।
আসাদ সাহেবের পূর্বপুরুষগণ এক কালে এখানকার জমিদার ছিলেন। কালের বিবর্তনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও মান-মর্যাদা, শান-শৌকত, ধন-দৌলত কিছুই লোপ পায়নি, বেড়েছে বৈকি। বুড়িগঙ্গার কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী গ্রুপের প্রায় হাফ-ডজন গার্মেন্টস। জানা-অজানা আরো ব্যবসাতো আছেই। বংশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়েও দিচ্ছেন পুরান ঢাকার বংশীয় এক পরিবারে। পাত্র আসাদ চৌধুরীর ব্যবসায়ীক বন্ধু শরীফ আহমেদের বড় ছেলে শাহেদ আহমেদ।
শাহেদ অনেক আগ থেকেই মনেপ্রাণে চৈতীর পাণি প্রার্থী ছিল। পূর্ণিমার এই তিথিতে চাঁদ বড় উজ্জ্বল। চারিপাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারকারাজি যেন তারই স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু আজ চন্দ্রের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল চৈতীর মুখাবয়ব। গহনা-মোড়া দেহ নিয়ে ফুলে সাজানো বিছানায় বউ সেজে বসে আছে চৈতী। অলংকারের ভারে সারাদেহ হাসলেও কাঁদছে চৈতীর কাজলকালো চোখ দু’টি। খুব মনে পড়ছে একজনকে, আরো বেশি মনে পড়ছে কোন এক পড়ন্ত বিকালে তার কাঁধে মাথা রেখে দেওয়া ওয়াদাটি- ” তুমি আমার জিবনের প্রথম পুরুষ যাকে মন দিয়েছি, এই দেহের প্রথম পুরুষও তুমি বিনা অন্য কেউ হবেনা।” মূহুর্তেই বিষিয়ে উঠে চৈতীর মন।
-উহ, কার কথা ভেবে চোখের জল ফেলছি আমি।
-মানুষ কিভাবে পারে এত লোভী হতে!
-ছোটলোক! লম্পট! পরক্ষণে নিজেই যেন নিজের কথার বিদ্রোহ করে বসে।
-নাহ, ও এমন হতে পারেনা। আমি বিশ্বাস করিনা। কিন্তু..কিন্তু সিসি টিভির ফুটেজতো মিথ্যে নয়!
আর কিছু ভাবতে পারেনা চৈতী, মাথাটা ধরে আসে। এরই মাঝে উপস্থিতির সংকেতসূচক আওয়াজ দিয়ে রুমে প্রবেশ করল শাহেদ। চৈতী টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে ঠিকঠাক হয়ে বসল। ভারী কোন কাজ না করলেও সারাদিনের অবশ্য পালনীয় ফরমালিটিতে বর-কনে দু’জনের উপরেই বেশ ধকল গেছে। তাই খুচরো কিছু কথাবার্তা বিনিময় শেষে অবসন্ন দেহদ্বয়কে বিশ্রাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা।
চোখের পাতা এক করতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসল শাহেদের। কিন্তু চৈতীর ঘুম আসেনা। মুদ্রিত আঁখিযুগল তাকে টেনে নিয়ে গেল নিকট অতীতের অমীমাংসিত এক উপাখ্যানে রাজধানীর নামকরা একটি কসমেটিক্স মার্কেটে সেলসম্যান হিসাবে কাজ করত সোহেল। বারবার যাওয়া আসার সুবাদে হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত ছেলেটির সাথে এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যায় চৈতীর। সোহেলের দু’কূলে আপন বলতে কেউ নেই। সেই অবুঝ বয়সেই বাবাকে হারিয়েছে। বছরখানিক হল মরণব্যধি ক্যান্সারের কাছে হার মেনে মমতাময়ী মা’ও না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সোহেলের দুঃখের কথা শুনে চৈতীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কারো জিবন এত বেদনার, এত নিঃসঙ্গতার হতে পারে!! একপ্রকার মায়া থেকেই সোহেলের জন্য চৈতীর হৃদয়ে এক অসম অনুরাগের সৃষ্টি হয়। ধীরে-ধীরে দু’জনের মাঝে ভয়-সংশয়, আবেগ-বাস্তবতা, ধনী-গরীব, শ্রেণী বৈষম্য- সবকিছুর উপরে একটি মাত্র শব্দ জয় লাভ করে, তা হল- প্রেম, অনিশ্চিত প্রেম। সোহেলের ২৩ তম জন্মদিনে রোলেক্সের সোনালি কালারের একটি ঘড়ি হাতে পড়িয়ে দেয় চৈতী।
-সোহেল তোমার জন্য সুসংবাদ আছে। মিটিমিটি হেসে রহস্যের মত করে কথাটি বলতে চায় চৈতী।
-কী সুসংবাদ? সোহেল উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
-আব্বুর সাথে তোমার ব্যপারে কথা বলেছি। আজ সন্ধ্যার পর তোমাকে অফিসে দেখা করতে বলেছেন। এই নাও, আব্বুর ভিজিটিং কার্ড। আর হ্যাঁ, একটু ভালো জামাকাপড় পরে পরিপাটি হয়ে যেও।আর হ্যাঁ, ঘড়িটা কিন্তু সবসময় কাছে রাখবা। ওটা আমার ভালোবাসার নিদর্শন। যখনই সময় দেখবে আমার কথা মনে পড়বে।
– হুমম, মরণের পরেও রাখব।
সোহেলকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাসার দিকে পা’ বাড়ায় চৈতী। নিজের অফিসে পায়চারি করতে করতে সিগারেট ফুঁকছেন আসাদ চৌধুরী। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও উত্তেজনায় রিতীমত ঘামছেন তিনি। এদিকে ওনার পছন্দের পাত্র শাহেদ সান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
-শশুর আব্বা এত টেনশন কইরেন না তো। যদি পাঁচলাখ টাকায় কাজটা হয়ে যায়। তাহলে ….
মুখের কথাটির ইতি টানতে পারেনা শাহেদ তার আগেই সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করল সোহেল। সোহেল আসতেই শাহেদ বের হয়ে গেল। আজকে কর্মচারীদের সন্ধ্যার আগেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো বিল্ডিং ফাঁকা। ছমছমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে চারিদিকে। সোহেলকে বসতে বলে আসাদ চৌধুরী স্বাভাবিকভাবেই কথা বলা শুরু করলেন। এই যেমন- কতটুকু পড়াশোনা করেছে? বাড়িতে কে কে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা বলতে বলতে তিনি ডেক্সের তলা থেকে একটা ব্রিফকেস বের করলেন। ভিতরে থাকা ১০০০ টাকার ১০ টা ব্যান্ডেল গুণে দেখলেন ঠিক আছে কিনা। প্রতিটি ব্যান্ডেলে ৫০ হাজার করে মোট ৫ লাখ টাকা আছে এখানে।
-বাবা সোহেল, তুমি কি কষ্ট করে এই ব্রিফকেসটা ৩২ নং রুমে পৌছে দিতে পারবে? কেমন যেন অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন আসাদ চৌধুরী।
-কেন নয় আংকেল! অবশ্যই পারব।
ব্রিফকেস নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে ৩২ নং রুমের দিকে গেল সোহেল। এদিকে বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর কী হল, তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে চৈতী। সোহেলকে কল দিলে ফোন সুইচস্টপ দেখায়, দুশ্চিন্তা বাড়ে চৈতীর। রাত ১০ টায় আসাদ চৌধুরী মুখ কালো করে ঘরে ফিরলেন।
-কী হয়েছে বাবা? চৈতীর কণ্ঠে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। আসাদ চৌধুরী কোন উত্তর করলেন না। সাথে করে নিয়ে আসা অফিস রুমের সিসি টিভি ফুটেজটি দেখালেন নিজের মেয়েকে। কিন্তু ভিডিওতে কী কথা-বার্তা হয়েছে তা শুনতে পেলনা চৈতী।
– মা’রে, সোহেল আসলে তোকে চায়নি, চেয়েছে তোর ধন-সম্পদকে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন আসাদ চৌধুরী। চৈতী নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। যতই কাঁদছে ততই ঘৃণা বাড়ছে সোহেলের প্রতি। রাগে-ক্ষোভে, অভিমানে এক পর্যায়ে শাহেদকে বিয়ে করার প্রস্তাবে মত দিল চৈতী। বিয়ের দুই’দিন পরই ব্যাংককে হানিমুনে এসেছে শাহেদ-চৈতী। সী-বিচের পাশ্ববর্তী অভিজাত এক হোটেলে উঠেছে। সারাদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি শেষে হোটেলে ফিরতে রাত প্রায় ১১ টা বেজে গেল ওদের। এ দু’দিন শাহেদের কাছ থেকে যথাসম্ভব নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেিল চৈতী। কিন্তু আজ সারাদিন একত্রে থাকার সুবাদে পরস্পর বেশ ফ্রি হয়ে গেছে। চৈতী স্নান সেরে হালকা-গোলাপী কালারের নাইটি পরে নিল। অপ্সরীর মত লাগছে ওকে। এদিকে শাহেদ সিগারেট খুঁজতে গিয়ে প্যাকেট খালি দেখে অস্থির হয়ে পড়ল।
– চৈতী, তুমি একটু ওয়েট কর। আমি সামনের মার্কেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসি। এই যাব আর আসব।
– শাহেদ, এইসব ছাঁইপাশ না খেলে হয়না?
-আজকের রাতে অন্তত নিষেধ করনা বেবি।
শাহেদ রুম থেকে বের হওয়ার পর চৈতী দরজা লক করে খাটে বসতে না বসতেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলতেই দেখে শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে।
– কী ব্যাপার শাহেদ, যাওনি?
– নাহ, ভাবছি আজ থেকে সিগারেটের নেশা ছেড়ে দিব। চৈতীর ঠোটের দিকে তাকিয়ে বলে শাহেদ। চোখে তার অদ্ভূত মাদকতা।
-কেন? চৈতী অবাক হয়ে জানতে চায়।
-তুমি থাকতে দুনিয়ার সব নেশা তুচ্ছ চৈতী। আজ থেকে তোমাতেই নেশা করব।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠে চৈতীর ফর্সা মুখখানি। রুমের নেটওয়ার্ক জ্যামার’টি অন করে দেয় শাহেদ। তারপর ডিম-লাইটের মৃদু আলোয় অচেনা সুখের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে দু’জন। সতীচ্ছেদের লঘু যন্ত্রণা আর মিলনের তীব্র জ্বালায় পুড়তে থাকে চৈতী, নিরন্তর পুড়তে থাকে। এক সময় দপ করে নিভে যায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। জ্যামারটি অফ করে, চৈতীর ঘর্মাক্ত ললাটে চুমু খেয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় শাহেদ। হঠাৎ চৈতীর ফোনটি বেজে উঠে, রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শাহেদের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে আসে।
-হ্যালো চৈতী, বারবার তোমাকে কল দিচ্ছি অথচ সিগন্যাল পাচ্ছিনা। যাক বাবা শেষমেশ পাওয়াতো গেল। আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
শোন, সিগারেট কিনে ফিরার পথে বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। তাই রুমে ফিরতে আরো ১০ /১৫ মিনিট লেট হতে পারে। প্লিজ লক্ষী’টি, রাগ করেনা! উম্মাহ,উম্মাহ। ফোন কেটে দেয় শাহেদ।চৈতী হতভম্ব হয়ে যায়। কোনমতে টাওয়াল পেঁচিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। অথচ দরজা ভিতর থেকে লক করা। আবছা আলোয় চৈতী দেখতে পায়, বেলকনির টি-টেবিলে সোনালি কালারের একটি ঘড়ি জ্বলজ্বল করছে। ঘড়িটি ভেজা, ফোঁটা-ফোঁটা পানি ঝরছে ওটা থেকে। এদিকে বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠা সেই ভেজা লাশটি এখনো হিমাগারে পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ।