দেড় বছর বয়সী আনাফকে কোলে নিয়ে, ভাবতে ভাবতে নীরবে চোখের জল ছেড়ে বুক ভাসাচ্ছেন কোহিনুর।
তার চাকরিজীবী স্বামী ইকবালের দুটি কিডনীই অকেজো হয়ে গেছে। ডাঃ বলেছেন জরুরী ভিত্তিতে ইকবালের কিডনী প্রতিস্থাপন করতে হবে, না হলে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যাবে ইকবাল। কিন্তু ইকবাল না ফেরার দেশে চলে গেলে আনাফের কি হবে? কোহিনুরের কি হবে? স্বামী হারা কোহিনুরকে সবাই বিধবা বলবে, স্বামী ছাড়া বজ্জাত শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, দেবর, জা এর সংসারে এক সেকেন্ডও টিকতে পারবেন না কোহিনুর। বাবা হারালে অর্থাভাবে না খেয়ে না দেয়ে, মানুষের লাথি উষ্টা খেয়ে বাঁচতে হবে আনাফকে। আনাফের অংশটুকু ভাবতেই কোহিনুর ভেতরে কলিজাফাটা আর্তনাদ শুরু হয়ে গেছে।
কোহিনুর আনাফকে বুকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত বিলাপ করলেন। না না ইকবালকে বাঁচতেই হবে, আমার আনাফের জীবনে আমার চেয়ে ইকবালের প্রয়োজন অনেক অনেক অনেক বেশী। আমি বেঁচে থাকলে আমার আনাফ দুঃখিনী মায়ের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই পাবেনা, আর ইকবাল বেঁচে থাকলে মায়ের ভালোবাসা ছাড়া সবই পাবে আনাফ। কোহিনুর সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের কিডনী দান করেই বাঁচাবেন স্বামী ইকবালকে। যেই ভাবনা সেই কাজ, ইকবালকে কিডনী দেয়ার সব রকমের প্রস্তুতি নেয়া হলো। কোহিনুর কিডনী দেয়ার আগে, ডাঃ কে অনুরোধ করে কারো কাছে কিছু একটা বলতে নিষেধ করলো। কথাটা কি ছিলো, সেটা শুধু কোহিনুর আর ডাঃই জানতো।
অবশেষে ইকবালের জন্য কোহিনুরের কিডনী খুলে নেয়া হলো, একটি মাত্র কিডনী খুলে নেয়ার পর, ধীরে ধীরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কোহিনুর। কোহিনুর মারা যাওয়ার পর সবাই ডাক্তারকে ধরলো, কোহিনুর মারা গেলো কেনো? ডাঃ কোন কথা না বলে কোহিনুরের লিখে যাওয়া একটি চিঠি, তার শ্বশুর শ্বাশুড়ীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। শ্রদ্ধেয় শ্বাশুড়ী আম্মা, আমার শেষ সালাম নিবেন, শ্বশুর আব্বা, রুম্মান ভাই ও শেফালি ভাবিকেও আমার সালাম দিবেন। আমি জানি আম্মা, স্বামী বিহীন আপনাদের সংসারে আমার আর আমার আনাফের টিকে থাকা অসম্ভব হতো, আপনারা আমার আর আমার ছেলের উপর অত্যাচারের হাতুড়ী চালালেও, আপনাদের ছেলের সামনে ছিলেন দুধে ধোয়া পবিত্র তুলসী পাতা।
তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার আনাফের জীবনে আমার ছেয়ে তার বাবার প্রয়োজনই বেশী। আমি চাইনি বাবার অবর্তমানে আমার আনাফ মানুষের/আপনাদের লাথি উষ্টা খেয়ে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠুক।
সেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না, সেই কষ্ট আমার আজকের মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়েও বেশী হতো। আমার শেষ অনুরুধ আম্মা, আনাফের বাবার অনপুস্থিতিতে তাকে কখনো আমার মতন নির্যাতন করবেন না, পারলে মায়ের অভাব ভুলে থাকার ভালোবাসা দিয়েন।
আমি মারা যাওয়াতে হয়ত কারন জানতে চেয়েছেন আম্মা, কারনটা বেশী কিছু নয় আম্মা। বিয়ের যৌতুক বাবদ বাকী ৮০ হাজার টাকার জন্য যখন চুলের গোছা চেপে ধরে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মেরে, বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছিলেন আম্মা, বাবার বাড়ীতে গিয়ে টাকার জন্য ঔষধ কিনতে না পারা বিছানায় শোয়া বাবাকে দেখে, আমি ঐ টাকার কথা বলতে পারিনি আম্মা। পরে নিরুপায় হয়ে, মাত্র ৮০ হাজার টাকায় একটা কিডনী বিক্রি করে, আপনাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে ছিলাম আম্মা। যৌতুকের টাকা বুঝে পেয়ে, আপনাদের মুখের ভোজন হাসি আমাকে কিডনী হারানোর ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছিলো আম্মা।
একটা কিডনী নিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিলাম আম্মা। কিন্তু নিজ চোখে স্বামীর করুন মৃত্যু, আর সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, আমি সেটাও নিজের কাছে রাখতে পারলাম না আম্মা। বিশ্বাস করুন আম্মা, আমি খুশি মনে আমার স্বামীকে কিডনী দান করেছি আম্মা। তবে যদি আমাকে যৌতুকের টাকার জন্য কিডনী বিক্রি করতে না হতো, তাহলে আমার আনাফ হয়তো দুনিয়াতে আরো কিছুদিন মায়ের স্নেহের পরশ পেতো আম্মা। অনেক কথা বলে ফেলেছি আম্মা, আমি বড্ড ক্লান্ত আম্মা। খুব মন চাচ্ছে একটু পানি পান করি, কিন্তু ডাক্তার সাহেব বলেছে এই মুহুর্তে কিছু খাওয়া যাবে না আম্মা।
ডাঃ সাহেবকে কিছু বলবেন না আম্মা, আমিই তাকে হাত জোড় করে সবকিছু বলতে নিষেধ করেছি আম্মা, তার কোন দোষ নেই আম্মা, তিনি নির্দোষ আম্মা। চলে গেলাম আম্মা, ভালো থাকবেন। আর আমার স্বামীর কিডনী প্রতিস্থাপনের টাকা জোগাড় করতে না পারলে, আমার চোখ, হার্ট বিক্রি করে দেইখেন কিছু জোগাড় করতে পারেন কি না। ভালো থাকবেন আম্মা, আমার আনাফকে আপনাদের হাতে দিয়ে গেলাম, ওকে কষ্ট দিয়েন না আম্মা, ওকে কষ্ট দিয়েন না।
ইতি
কোহিনুর