কামিনী

কামিনী

মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড আকাশের নীচে। অন্ধকারের আঁধারে আচ্ছন্ন রাতটা সে খুব ভালোবাসে। খুব আয়েশ করেই উপভোগ করে সে বলা যায়। তার তীক্ষ্ণ চোখ দুটো যেন অন্ধকারের মধ্যেই ভালো দেখে। তার চোখ দুটি রক্তিম লাল আভায় পরিপূর্ণ। ভেজা চুল গুলো পুষ্টিহীনতায় ভুগেও পা পর্যন্ত নেমে গেছে। তার উঁচু বক্ষ শোভায় একজন পরিপূর্ণ যুবতীর থেকে বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। তবুও তার চোখেমুখে উত্তপ্ত যৌবনতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শহরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। ছাদের রেলিঙ করে সে ভিজে যাচ্ছে, কাকভেজা। তার অঙ্গপতঙ্গে শুদ্ধ পবিত্রতা ফিরে পেয়েছে। চোখের কষ্টটা বৃষ্টি জলের সাথে স্নান করে মুছে গেছে। শুধু মনের কষ্টটা মুছতে পারে নাই। ওটা মুছে দেয়ার ক্ষমতা বৃষ্টির নেই, আর না তার নিজের আছে।

নীচ থেকে তাকেও কেউ দেখলে নিশ্চিত মনে করবে একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তির দেহে যেমন প্রাণ তাকে না। তার দেহেও এখন প্রাণ আছে বলে বুঝা যাচ্ছে না। সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। চোখের পলক পড়ছে না। ঠিক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দূরের আকাশটার বিজলীর আলোয় তাকে এক ঝলক দেখতে পায় কেউ কেউ। ওরা মনে হয় মনে করে বৃষ্টি পাগল কেউ হয়তো ভিজতেছে।

মোজাম্মেল হুসেন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন শব্দ করে। শব্দ না করে তিনি কখনও চা খেতে পারেন না। আর খেলেও তৃপ্তি পাননা। তাই শব্দ করেই চা খেতে হয় তাকে। তবে বাইরে এটা করতে পারেন না। আশেপাশের মানুষ একটু হাসি নেয় এই বিষয় নিয়ে। তিনি সেসব মানুষকে শুধু একটি কথাই বলেন “খাওয়ার মর্ম বুঝলা না।” মোজাম্মেল হুসেন ব্যাংকের একজন সিনিয়র অফিসার। চাকরী করছেন অনেক দিন ধরে। নিজের জীবনের চেয়ে চাকরীটা কে বেশি ভালোবাসেন তিনি। তার বয়সটাও পঁয়তাল্লিশ পেড়িয়ে গেছে। তবে দেখতে এখন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মনে হয়। মাথার চুল গুলো এখনো তেমন একটা সাদা হয়নি। শরীর স্বাস্থ্য পুরাই ঠিক আছে। শুধু মনটাই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

তার পাশেই সালেহা বেগম বসে আছেন। হাতে পানের কৌটা। এই ভদ্রলোক যেমন চা ছাড়া চলে না, তেমন ভদ্র মহিলারও পান সুপারি ছাড়া চলেনা। সালেহা বেগম মাদ্রাসায় পড়েছিলেন। সেই কারণে একটা মাদ্রাসায় চাকরীও করেছিলেন দুই বছর। পরে আর করেননি, ছেড়ে দিয়েছেন। তার মেয়েকে একটু বেশি সময় দেয়ার জন্য। সালেহা বেগমের বয়স এই এক মাস আগে ত্রিশ পেরুল। উনি ঠিক উনার স্বামীর বিপরীত। দেখতে মনে হয় চল্লিশ বছর বয়সী বুড়ী। এই কথাটা অবশ্য তার স্বামী বলে বারবার। আগে তো কাব্যিক একটা নামে তাকে ডাকতো। এখন ডাকে না, এখন বুড়ী বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে। উনিও কম যান না। যেদিন বুড়ী বলে অতিরিক্ত চিৎকার চেঁচামেচি করে, সেদিন চা খাওয়া বন্ধ করে দেন। তারপরও শুরু হয় মান অভিমান ভাঙ্গানো। কিন্তু আজকাল এটাও করতে পারছেন না। কারণ চা বন্ধ করলে বেচারা নিজে গিয়ে চা বানিয়ে খেয়ে নেয়, তারপরও বুড়ী ডাকে।  চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে মোজাম্মেল হুসেন বললেন

– নোজাইফা কি এখনো ছাদে?
– হ্যা। বৃষ্টি শেষ হয়েছে কি না দেখো তো?

চায়ের কাপ ট্রি টেবিলে রেখে জানালার দিকে উঠে দাঁড়ালেন। এই একতলা বাড়িটা মোজাম্মেল হুসেনের নিজের। প্রথম চাকরী পেয়েই এই বাড়িটা কিনেছিলেন। ভাগ্য ভালো কম দামে পেয়েছিলেন তখন। এখন তো এর দাম তিনগুণ হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু কেমন বেড়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে। পুরুষের কামনাবাসনা বাড়ছে। শুধু বেড়েই চলছে। কমতেছে শুধু মানুষের মন মানসিকতা। এত নীচু পর্যায়ে চলে এসেছে যে একজন মানুষ নিজেকে সঠিক জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারছে না। আর এমন সব অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে যার কোনো ক্ষমা নেই।

জানালা দিয়ে তাকালেন বাইরে। ঝিরঝির করে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো হঠাৎ করেই। এর মানে তিনি জানেন। বুকের ভেতরে এই একটি জিনিসের জন্য তার আফসোস হয় সবসময়। অতিরিক্ত কষ্ট পান এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে। সেটা হচ্ছে তার মেয়ে। ১৯ পা দিলো কয়েকদিন হয়েছে। দেখতে সুন্দর না হলেও মেয়েটার মুখে আলাদা একটা মায়া কাজ করে। সেই মেয়েটা কে নিয়ে অতল সমুদ্রে পড়েছেন। কি হয়েছে এটাই কেউ বলতে পারছে না।

এমনকি মেয়েটা নিজ থেকেও কিছু বলছে না। অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। মেয়েটার রোগ বলতে কি, কিছুই জানেন না। শুধু জানেন মেয়েটা অতিরিক্ত বৃষ্টি পাগল। যতদিন বৃষ্টি হবে তাকে ভিজতে হবে এটাই। আর জানেন মেয়েটা অতিরিক্ত কি, একটা কথাও বলে না। যেন বোবা একটা মেয়ে। কিন্তু মোজাম্মেল হুসেনের এখনো মনে আছে ত্রা মেয়ে পাঁচ ছয় বছর পর্যন্ত খুব বেশিই কথা বলেছে। তারপর আস্তে আস্তে কথা বলা কমে এসেছে। আর এখন একদম কথা বলেনা। সারাটা দিন এক রুমের মধ্যে বসে থাকে। বাইরে যাওয়া মানে শুধু কলেজে যায়। তাও কয়েকমাস ধরে সেটাও বন্ধ। কিন্তু আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে, তার মেয়ে পড়াশুনা না করেই পরীক্ষা দিলে ভালো রেজাল্ট করছে। মেয়েটার যে একটা বড় জঠিল সমস্যা আছে সেটা তিনি জানেন, কিন্তু এর প্রতিকারটাই এখনো জানতে পারেননি। কিভাবে এটা নির্মূল করবেন সেটা ও না।

দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসটা বেড়িয়ে আসতেই সোফায় গিয়ে আবারও বসে পড়লেন। রাত দুইটা বাজে। কিন্তু মেয়েটা এখনো ছাদে। বেশ চিন্তা হয় তার, কিন্তু তিনি নিরুপায়। কিছু করতে পারবেন না। ছাদে গিয়ে যে নিয়ে আসবেন সেটাও তিনি করতে পারবেন না। কারণ, ছাদের দরজা মেয়েটা বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখে। কিন্তু বাইরে থেকে লাগানোর মতো ছিটকিনি তো নেই দরজায়। মেয়েটার উপর জ্বিন টিনের আছর করলো কি না এটাই বুঝতে পারছেন না। কারণ, অনেক মোল্লা কবিরাজ দেখিয়েছেন। কোনো লাভ হয় নাই। ওরা কিছুই বলতে পারেনা। সাইকিয়াট্রিস্ট একজন শুধু বলেছিল মেয়েটার মনে সমস্যা। সে না’কি কল্পনায় নিজেকে এইরকম চরিত্রে খুঁজে পেয়েছে, তাই এমন করতেছে।
এইরকম জ্বিনে আছর করলে না’কি তারা আগাম বিপদ বার্তা বলে দেয়। কিন্তু তার মেয়ে এইরকম কিছু এখনো পর্যন্ত বলে নাই। শুধু একবার বলেছিল “মৃত্যুর কথা শরণ করো।”

সত্যি বলতে মোজাম্মেল হুসেন মৃত্যুর কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। তাকেও যে মরতে হবে। সেদিনই তার সাথে এক বিদঘুটে ঘটনা ঘটেছিল। ব্যাংক থেকে আসার পথে গাড়িতেই স্ট্রোক করেছিলেন। তবে হাসপাতালে নেয়ার ফলে আর উপরওয়ালার রহমতে বেঁচে ছিলেন। নামাযটা ছেড়ে দিয়ে দিছিলেন শয়তানের ধোকায়। কিন্তু মেয়ের কথা শুনে, আর এই ঘটনার পর আবারও পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া শুরু করেন।  মোজাম্মেল হুসেন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সালেহা বেগম এখনো পান চিবুচ্ছেন। তবে চোখে একটা আতংক। সেটাও মেয়ের জন্য।

– আমি কি একবার দেখে আসবো?
– চলো আমিও যাচ্ছি।

সিঁড়ি বেয়ে দুজনেই ছাদের দরজায় গেলেন। দরজাটা খোলা আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। মোজাম্মেল হুসেন ছাদে গেলেন। তবে নোজাইফা কোথাও নেই? থাকার কথাও না। কারণ, বৃষ্টি শেষ হলেই সে চলে যায় তার রুমে। ছাদের দরজা লাগিয়ে মেয়ের রুমের দরজায় আসলেন। দরজাটা বন্ধ। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দাটার প্রস্থ অনেকটা। একদিকে বেশ কয়েকটা ফুলের গাছ, টবের মধ্যে। এল্যোবেরা, জল গোলাপ, গন্ধরাজ, কামিনী, আরো কয়েকটা নাম না জানা ফুল। অন্যদিকে একটা চেয়ার রয়েছে, ছোট ট্রি টেবিল। রুমের সাথে লাগানো বারান্দাটা।

মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। শরীরের সাথে এখনো লেপ্টে আছে ভেজা কাপড়চোপড়। চুল গুলো শুধু ভেজা থাকা অবস্থায়ও উড়তেছে। চোখে এখন রক্তিম লাল আভা নেই, সেখানে এখন বেশ মায়াময়ী চোখ। কাজল বিহীন গাড় কালো দুটি চোখ। চুল গুলো এখন হাটুর উপর চলে আসছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে প্রেশার উঠানামার মতো তার চুল গুলো ও এই বাড়তেছে, তো এই কমতেছে। ফর্সা মুখটা হঠাৎ করেই শ্যামলা হয়ে গেল। কামিনী ফুলের গন্ধটা নাক টেনে ভেতরে নিচ্ছে।

পূর্ব দিকে ভোরের সূর্য্যটা মনে হয় উঁকি দিকে একটু পর,পাশে থাকা নারিকেল গাছের ডালের আড়াল থেকে। মিষ্টি আলো এসে ভড় করবে তখন। পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনা যাচ্ছে এখন। ওরা ঘুম থেকে উঠে গেছে। কিন্তু সে তো ঘুমায় না অনেকদিন ধরে। ঘুম তার থেকে চিরবিদায় জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কষ্টটা কেন দিচ্ছে না। আর কি কারণে কষ্ট পাচ্ছে সেটাই কি?

– কামিনীর গন্ধটা পাচ্ছো! আজ মনে হচ্ছে একটু অতিরিক্ত গন্ধ ছড়াচ্ছে।

কথাটা শুনা মাত্রই সে কামিনীর সুভাষের দিকে এগিয়ে গেল। উৎসুক কণ্ঠস্বরটা কোথা থেকে আসছে সেটার দিকে খেয়াল নেই তার। কারণ, কথাটা তার ভেতর থেকেই একজন বলেছে। সেই ছোটবেলা থেকে বলে আসছে। মনে মনে সে বলে উঠল কামিনী

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত