একটুকরো স্মৃতি

একটুকরো স্মৃতি

নব প্রভাতে রবির স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত চারিদিক। বেলি ফুলের সুবাসে ভরে গিয়েছে বারান্দার এক পাস। এক নির্বোধ কাক ডেকে চলেছে অনবরত। এর মধ্যে একটা চড়ুই তার বাচ্চা সহ বাসা বেধেছে এসির খোপে।সারাদিনের একাকীত্ব সময়ে চড়ুই পাখি ও তার বাচ্চারা অদ্ভুত ভাবেই রাখিকে পাখার ঝাপটা দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

প্রতিদিন সকাল বেলা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রাখির চিকন মাজায় শাড়ির গোছা বেধে রান্নাঘরে ব্যাস্ত তম বাসন-কোসনের ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে যায়।রান্না শেষ হলে হাতে খবরের কাগজ আর এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এক কোণে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় রাখি।রাজ্যের যত খুন খারাবি আর সরক দুর্ঘটনার খবর রাখির দিনটাকে করে তোলে বিষাদময়।

স্বামীকে অফিসের জন্য বিদায় দেওয়া,ঘর সংসার গোছানো ইত্যাদি কাজে ব্যস্ততম সময় কাটে রাখির। দুপুরে তেমন একটা রান্না করে না। সকালের নাস্তার একটা অংশ দুপুরে খেয়ে নেয়। স্বামী খালিদের জন্য প্রতিদিন সকালে ভারী খাবার রাঁধে রাখি। খালিদ লাঞ্চ নিয়ে যায় অফিসের জন্যে।তাই রাখি সকালে উঠে খিচুড়ি নইলে ফ্রাইড রাইস আবার কোন কোন দিন ছোট ছোট করে খাসির মাংস কেটে তেহারি করে দেয় টিফিন বক্সে।

খালিদের লাঞ্চ বক্সের প্রতি তার কলিগদের আলাদা নজর থাকে। সুযোগ পেলেই দু’চামচ টেস্ট করে দেখে তারা। খালিদ তাতে আপত্তি করে না।রাখি এত বেশি বক্স ভর্তি খাবার দেয় যে তার একার পক্ষে সবটুকু শেষ করা সম্ভব হয় না। কলিগদের সাথে রাখির সুস্বাদু খাবারের সুবাদে আলাদা একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছে। কথায় আছে নারী অনেক ক্ষেত্রেই এক অজানা বাঁধনে পুরুষের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। কথাটি অবশ্য নারীদের বেলায় মিথ্যে নয়।

রাখি আর খালিদের সংসারটা বেশ মসৃন,নিয়মতান্ত্রিক আর ঝুট-ঝামেলা হীন ভাবেই চলছিলো।খালিদের পর পর দুটো প্রমোশন হয়ে গেল অল্প বয়সেই। নিজের মেধা বুদ্ধি আর শ্রম এর দ্বারা সফলতার হাতছানি খালিদকে অনেকটা সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।বউ,সংসার আর অফিস এই নিয়েই খালিদের পৃথিবী। পুরনো দিনের অযথা হট্টগোল আনন্দ, বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাবাজি সবকিছু এখন স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে খালিদের।

খালিদের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন রাখি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ,একগোছা কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল আর ছিপছিপে গরণ। রাখির সরল চেহারা খালিদকে মুগ্ধ করেছিল। ছিমছাম,লাজুক আর নরমশরম মেয়েটি খুব বেশি পতি ভক্ত হয়ে ওঠে দিনের পর দিন। বিয়ের পর রাখি দু তিন মাস কলেজ করেছে। তবে সকালে খালিদকে এভাবে একা ফেলে, সংসার ধর্ম ফেলে নিজেরটা গুছিয়ে কলেজে চলে যেতে তার একদম ভালো লাগে না।

সংসারের অজানা জালে কেমন করে যেন রাখি নিজে থেকেই আটকে ফেলল নিজেকে। তারপর ধীরে ধীরে কলেজ ছেড়ে দিল রাখি। এইজন্য বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির সবার কাছে বকা শুনতে হয়েছে রাখিকে। রাখি এখন ব্যক্তি আমি কে ভুলে গিয়ে খালিদের ব্যক্তিত্বের সাথে আত্মসমর্পণ করার জন্যই নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে অকৃপণভাবে। যেখানে নিজের লেখাপড়াটা ও গৌণ হয়ে গিয়েছে রাখির কাছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাখি নিজের ইচ্ছা ও তার গুরুত্ব কে মন দিয়ে নয় মস্তিষ্ক দিয়েই প্রাধান্য দিতে পছন্দ করে। আর সে কারণেই খুব সহজে কঠিন ভুলগুলোকেও প্রশ্রয় দিতে দ্বিধা করেনা রাখি। খালিদ তার পছন্দের পুরুষ। যে পথ দিয়ে রাখি তার কলেজ জীবন শুরু করেছিল সেই পথ দিয়েই খালিদের অফিসের যাতায়াতের রাস্তা। পথে মাঝে মাঝে দুজনের চোখাচোখি সেই থেকেই শুরু হলো প্রেম।সেই প্রেমের সূত্রই বিয়ে নামক অংকের সমাধানে গিয়ে শেষ হয়েছে।

আজ সকাল থেকেই ভারী বৃষ্টি। খালিদের লাঞ্চ বক্সে খিচুড়ি আর সরষে ইলিশ। ঘর গুছিয়ে স্নান শেষে রাখি রান্নাঘরের পাশে বড় বারান্দায় আরাম কেদারায় এসে চুল মেলে দিয়ে বসলো। একটু জোরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দিয়েছে রাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটা গানের কলি রাখির মনে প্রানে দোলা দিয়ে ওঠে।

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে জানি নে জানি কিছুতে কেন যে মন লাগেনা রাখি মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে আর গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ অস্থির লাগছে রাখির। কি যেন এক অজানা, অসহ্য অথচ তীব্র ভয় আর ভালো লাগা কাজ করছে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। জীবনের বাস্তবতার কাছে অনেক পুরোনো স্মৃতি মনের অন্তরালে চাপা পড়ে গেলেও তা হারিয়ে যায় না একেবারে। খালিদের সাথে রাখির প্রেম কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ নয়। কারণ এ সময়ের সত্য কে আঁকড়ে ধরে রাখির পুরোটা জুড়ে খালিদের অস্তিত্ব । তবে রাখির জীবনে খালিদ আসার পূর্বেও আরেকটি সত্য অস্বীকার করা যায় না। তার কথা বলবো। সে রাখির প্রথম প্রেম। নাম তার শুভ। সেই চাপা পড়া স্মৃতি আজ রাখির উপর আবার ভর করল।

রাস্তার কোনায় ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে শুভ ভিজছে আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাখির বারান্দার দিকে।এই দৃশ্য দেখে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল রাখির মাথায়। শরীর হিম হয়ে এলো। কোন এক অজানা উত্তেজনায় দিক দিশা হারিয়ে দরজা খুলে নেমে এলো বাড়ির গ্যারেজে। হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল শুভকে। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে রাখি পাগলের মত ভেজা পিচঢালা রাস্তায় দৌড়াতে লাগল খালিপায়ে এপাশ থেকে ওপাশে। চলন্ত গাড়ির পরোয়া না করে এলোপাথারি খুঁজতে লাগল শুধু খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এ কি কেউ তো নেই! দারোয়ানকে ড্রাইভারকে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল।সবাই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাখির দিকে। রাত থেকে ধুম জ্বর রাখির। মুখে বিড়বিড় করে কি যেন অনর্গল বলে যাচ্ছে সারাক্ষণ। যার কোন স্পষ্ট প্রকাশ নেই।তিনটি রাত রাখির জন্য নির্ঘুম সেবায় কাটিয়ে দিল খালিদ। খালিদ সমস্ত কাজ বন্ধ করে রাখির জন্য সময় দিল আরো একটি সপ্তাহ।

রাখি কি আদৌ তার পুরনো দিনের কথা ভুলতে পারবে? শুভ রাখি প্রথম প্রেম। যদিও অবচেতন মনের ছোট্ট বেলার সাথী ছিল শুভ।তবুও শুভর নির্মম সড়ক দুর্ঘটনার দুর্বিষহ স্মৃতি রাখি এখনও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তার জীবনে। আসলে জীবনের কোন কিছুই পুরোপুরি শেষ বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না অন্তর থেকে।বরং নতুন শুরুর জন্য পুরনো শুরুটা কে কোথাও যতি চিহ্ন দিয়ে থামিয়ে দিতে হয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত