রেস্টুরেন্ট পক্ষ বনাম নেতা পক্ষ ফাইট

রেস্টুরেন্ট পক্ষ বনাম নেতা পক্ষ ফাইট

রেস্টুরেন্ট এ বসে আছি। ওয়েটার কোল্ড কফি দিয়ে গেলেন। আমি না খেয়ে, পাইব এর মধ্য দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি, এতে এক ধরনের বুতবুত শব্দ হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে আমি যখন টেনশন করি তখন অদ্ভূত অদ্ভুত সব কান্ড করি। এখন টেনশন করছি কফিটার বিল দেওয়া নিয়ে।

ওয়েটার অডার মেনু দিয়ে গেলেন। আমি দেড়শ টাকার কফির অডার দিবো, কিন্তু ভুলে আড়াই’শ টাকার কফি অডার দিয়ে ফেলেছি। মাসের শেষ, বাবা এখনো হাত খরচের টাকা দেননি। বরাবরই আমার ম্যানিব্যাগ এ সময় বেশ অসুস্থ থাকে। আমি জানি, ম্যানিব্যাগ কে এখন আমি হত্যা করতে চাইলেও সে বলবে, হুজুর আপনি আমার বাহিরটা দেখলেন ভিতরটা দেখলেন না। আপনি আমাকে হত্যা করেন আর জেলে ঢুকান দুইশত দশ টাকার বেশি দিতে পারবোনা।

টেনশন হচ্ছে। চল্লিশ টাকা বিল না দেওয়ার জন্য তারা আমাকে দিয়ে কি করিয়ে নিবে। থালা বাসন পরিষ্কার করিয়ে নিবে নাকি ফ্লোর মুছে নিবে! তাহলে আমার এই ফিল্মি স্টাইলে বসে থাকার কি হবে। ছেলে বন্ধুর সাথে আসা মেয়ে গুলো আমার দিকে কৌশলে দেখছে তার কি হবে। স্টাইল বজায় রাখতে হবে, যা হবে সেটা পরে দেখা যাবে।

জানালা দিয়ে গাড়ি চলাচল দেখছি। কতো ছোট লাগছে গাড়িগুলো, মনে হচ্ছে খেলনা গাড়ি। বেশ কিছু গাড়ির মালিক ছোট বেলায় আমিও ছিলাম। বাবা গাড়ি কিনে দিতে চাইতেন না। বাবা বলতেন, এ গুলো পচা গাড়ি, তোকে আমি এর থেকে বড় গাড়ি কিনে দিবো, ইত্যাদি। আমি বাবার কোনো যুক্তিকে তোয়াক্কা না করে, কান্না শুরু করে দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতাম। বাবা সাথে সাথে গাড়ি কিনে দিতেন।

আমার ভাবনা অবসান ঘটিয়ে, পাশের টেবিলে বসে থাকা তিনটি মেয়ের মধ্য একজন বললো, এই যে ভাইয়া শুনছেন? আমি তাদের দিকে ফিরে তাকালাম। মেয়েটি বললো, কিছু মনে না করলে, আপনি টেবিলের ওই পার না বসে যদি এই পার বসতেন। আসলে আমাদের সেলফি তুলতে সমস্যা হচ্ছে। বারবার আপনার ছ্যাকা খাওয়া মুখ, কোনো ভাবে আমাদের ছবির মধ্য জায়গা করে নিচ্ছে। আমি বললাম, আমি যে ছ্যাকা খেয়েছি এটা আপনি বুঝলেন কীভাবে? মেয়েটি বললো, আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে। আমি বললাম, আমার একটা উপকার করেন। আমার মাথায় কয়টা চুল আছে, এটা আমার জানার খুব ইচ্ছা।

একটু বলেদেন? মেয়েটি বললো, এটা কীভাবে সম্ভব! আমি কীভাবে বলবো আপনার মাথায় কয়টা চুল? আমি বললাম, কেনো, আপনি চেহারা দেখে বলতে পারেন আমি ছ্যাকা খেয়েছি। তাহলে আমার চুল দেখে বলতে পারবেন না কেনো আমার মাথায় কয়টা চুল আছে? মেয়েটি রাগী গলায় আমাকে বললো, অসভ্য। আমি বললাম, অসভ্য তা আপনারা হবেন। সেই একঘন্টা যাবত দেখছি টেবিলে রাখা খাবার টার সাথে ছবি তুলে যাচ্ছেন। না জানি খাবার এক সময় বিরক্ত হয়ে বলে বসে, আমাকে খাওয়ার জন্য কিনেছেন নাকি ছবি তুলার জন্য।  মেয়ে গুলো আমার কথা শুনে, মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে। যেনো যে কোনো সময় আমাকে কামড়ে দেবে।

এক নেতা টাইপ লোক ফোনে কথা বলতে বলতে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলেন। উনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে রাজনীতি ভালোবাসেন। উনার সাথে কিছু ছেলেপেলে ও আছে। ছেলে গুলোর বয়স ১৬, ১৭ থেকে ২৬, ২৭ এর মতো। উনাদের সাথে সব সময় এ রকম ছেলেপেলে থাকবেই। আর থাকাটাও স্বাভাবিক, না থাকলে নেতা বলে ঠিক মানানসই হয়না।

নেতা সাহেব মাত্র বসতে যাবেন। আমি জোর গলায় বলে উঠলাম, মামা কেমন আছেন? কতো দিনপর দেখছি আপনাকে। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে একবার তাকালো। নেতা সাহেব বললেন, ভাগ্নে কী অবস্থা তোমার? এখানে আসো। আসলে নেতা ধরনের মানুষদের আপনি যে ভাবেই ডাকুন না কেনো উনারা আপনাকে সারা দেবে। মোটকথা, আমি উনাকে ভাই বা কাকু বলে ডাকলেও উনি ফর্মালিটির জন্য আমাকে সারা দিতেন।

নেতা সাহেবের পাশে বসে আছি। আমার সামনে সিনিয়র দুটো ছেলে বসে আছে। আমার ধারণা নেতা সাহেবের কাছের লোক এরা দুইজন, নয়তো বসার সাহস পেতো না বাকি গুলোর মতো দাঁড়িয়ে থাকতো। নেতা সাহেব খুব আন্তরিকতার সাথে আমাকে বললেন, এবার বলোতো, মামা বলে এরকম চিক্কুর পাড়ার কারণ কী? আমি বললাম, আসলে মামা আমি আপনার অনেক বড় ভক্ত। আপনার সাথে দেখা করার অনেক দিনের ইচ্ছা। আজ হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে যাওয়াই আবেগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। নেতা সাহেব হেসে বললেন, আচ্ছা বুঝলাম। তা তুমি আর কিছু কী বললে? আমি বললাম, মামা আমার কিছু বলার নেই। আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি আপনার নীতি অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করি। শুধু একটি কথা বলার আছে, আপনি এখানে যখন ইচ্ছা আসবেন, যা ইচ্ছা খাবেন, কিন্ত কোনো বিল দিতে পারবেন না।

আমি ম্যানেজার কে বলে রাখবো আপনার কথা। নেতা সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সেকি, কেনো, আমি আমার বিল দিবোনা কেনো? আমি বললাম, ভালোবাসার মানুষের নিকট হতে কেউ বিল নিতে পারে। আমার বাবার রেস্টুরেন্ট মানেই আমার রেস্টুরেন্ট। আপনি বাহিরে সাইনবোর্ডে হয়তো দেখেছেন মোস্তাফিজুর রেস্টুরেন্ট এন্ড হোটেল। আমিই মোস্তাফিজুর মামা। নেতা সাহেব খুশি হয়ে বললেন, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি সত্যিই খুব ভালো ছেলে। তোমার কথাও কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। আজ তাহলে উঠি মাম। আমি এসে আমার জায়গায় বসলাম এবং চিক্কুর দিয়ে বললাম, ওয়েটার দেখো আমার মামার কি লাগবে। আর আমার কাছে এসে কিছু অডার নিয়ে যাও।

কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে বললো, স্যার আপনি যা যা বলছেন সব প্যাক করা হয়ে গেছে। আমি বললাম, আচ্ছা যাও আমি আসছি। বিল পেমেন্ট করতে গিয়ে ম্যানেজার কে বললাম, আমার মামা সব বিল পেমেন্ট করে দিবেন। আমি আরো কিছু বলতে যাবো কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিয়ে ম্যানেজার বললো, জী স্যার বুঝে গেছি আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।

রেস্টুরেন্টের দরজা ধাক্কা দিয়ে বের হবার সময়, আবার চিল্লিয়ে নেতা সাহেবকে বললাম, মামা আপনার পেছনে চার নাম্বার টেবিলে তিনটা মেয়ে বসে আছে দেখেন, এদের একটা ব্যাবস্থা নিবেন। এরা আমাদের রেস্টুরেন্টের মান নষ্ট করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। পাঁচ টাকার খাবার কিনে পাঁচ হাজার সেলফি নিবে। নেতা সাহেব বললেন, আচ্ছা ভাগ্নে আমি বিষয়টা দেখছি।  আমার কথা শুনে, রেস্টুরেন্টের সবার চেহারা প্রায় নাজেহাল। আর মেয়ে গুলো একদম মূর্তির মতো বসে আছে কোনো নড়াচড়া নেই, মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। আর যেটা পাচ্ছি সেটা যাবেনা। আকাশ থেকে একটা চেয়্যার পড়লো। উপরে তাকাতেই বুঝলাম আকাশ থেকে না রেস্টুরেন্ট থেকে পড়া শুরু হয়েছে। রেস্টুরেন্ট পক্ষ বনাম নেতা পক্ষ ফাইট হচ্ছে। আবহাওয়া পূর্ব সংকেত দিচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলে থাকা যাবেনা। তাই পায়ে হেটেই রওনা দিলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত