মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে তারা ঘরে দরজা দিয়ে নীরবে বালিশ ভেজায়। আমি নারী নই – পুরুষ। বালিশ নিয়ে আমারও কিছু একটা করা উচিৎ। কারন কিঞ্চিৎ পুর্বে আমারও একখানা প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি ড্যান ব্রাউনের ” দ্যা দা ভিঞ্চি কোড” বইটা বালিশের উপর রেখে পড়া শুরু করে দিয়েছি। বালিশের ব্যাবহার হলেই হলো। বইটা ভাল। পরতে-পরতে রহস্যের জটলায় ভরা! ভিঞ্চি কোডের রহস্য ভেদের আগেই রুমে ভাবি ঢুকে পড়ল। সে প্যালেস কন্সপিরেসি করা কূটনি মহিলাদের মত খুচুর-খুচুর স্বরে কথা বলছে। আশেপাশে কেউ নেই। খুচুর-খুচুরের কোন দরকার ছিল না।
— শোন্। এখন বাবার মেজাজ খুবই হট! মেয়ে পক্ষ কথা দিয়েছিল বিয়ের পানচিনি করে ফেলবে। মেয়ে আমরা পরে তুলে নিব। এখন পিছিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের কী ভাবে ওরা, হু? আমি ড্যান ব্রাউন বন্ধ করে একটা হাই তুললাম। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পেছনে আমারও হাত আছে, এটা ভাবিকে বলা যাবে না। পাত্রি আমার অপরিচিতা নয়, ছোট বেলা থেকে চেনা-জানা। মেয়ের নাম রিমকি। প্রায় তাকে চিপায়চাপায় ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। ছেলে মাঝেমধ্যে বদলও হয়। সামনাসামনি দেখা হলে লজ্জায় গদ-গদ হয়ে বলে,
“ভাইয়া, সাইবার ক্যাফেতে গিয়েছিলাম। একটা জরুরী ফাইল ডাউনলোড করলাম। সাথে আমার ফ্রেন্ড একটু হেল্প করল। সামনে এসাইনমেন্টের ঝামেলা আছে তো, তাই!” সাথে থাকা অতিশয় লম্বা ও কিঞ্চিৎ কুঁজো হয়ে থাকা ছেলে-ফ্রেন্ড হাত বাড়িয়ে অদ্ভুত উচ্চারণ আর ভারী স্বরে পরিচয় দেয়। ” হ্যালো, আমি ড়িশাদ। পড়িচিত হতে পেড়ে ভাল লাগল। জড়ুড়ি এসাইনমেন্ট আমড়া এক সাথেই কড়ি।”
সাইবার ক্যাফের ব্যাবসা এখন তুঙ্গে। সেখানে ছোট ছোট কেবিন করা আছে। শহরে পর্যাপ্ত পার্ক নেই। ছেলেমেয়েরা অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় কেবিনগুলোতে পড়াশুনা করতে ঢুকে। পরীক্ষা এলে আগের রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ” এই বার ফেইল মারমু! আমি এখন কিতা করতাম, ফ্রান্স?” আমি “র” কে “ড়” বলা প্রজন্মের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার উদ্দেশ্যে কথা সংক্ষেপ করি। বলি, “ও, আচ্ছা। ভাল। মিলেমিশে কাজ করা ভাল। ক্যাফের কেবিনে আরও ভাল। যুগ এগিয়ে যাচ্ছে। এসাইনমেন্টও সব এখন নেটেই পাওয়া যায়!” গত রাতেও এই মেয়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। আমার সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে – ব্যাপারটায় তাকে বেশ খুশিই মনে হলো। “ভাইয়া, আমি আপনার মত ম্যাচিউরড ছেলেই মনে মনে চাচ্ছিলাম।” “কেন, কেন?” “চ্যাংড়া পুলাপাইন হাজবেন্ড হিসেবে মানায় না। এরা মেয়েদের চেয়ে বেশি অভিমানী হয়। কথায় কথায় সিনক্রিয়েট করে। এসব বিয়ের পরে ভাল লাগবে না।”
“বাহ! তোমার অভিজ্ঞতা দেখে আমি মুগ্ধ!” “আপনার বিদেশ যাওয়ার খবর কী?” “আমি বিদেশ যাচ্ছি না।” “হায় হায় ! বউকে খাওয়াবেন কী? ইদানীং পার্লার খরচ বেশ চড়া!” “অসুবিধা নাই। সস্তায় লাল গমের আটা কিনব। কিছু দিয়ে রুটি বানানো হবে আর কিছু অংশ বউয়ের মুখে ডলার কাজ চলবে! পরিচিত ফর্মুলা! ওয়ান স্টোন, টু বার্ডস!” “ভাইয়া, আপনি যে একটা কী না !! খালি ফান করেন! আচ্ছা, আপনি গান গাইতে জানেন?” “জানি, তবে রাতে ছাড়া গাওয়া হয়ে ওঠে না।” “হাউ রোমান্টিক! রাতের গানই আমার ভাল লাগবে। প্রতিরাতে আমাকে শোনাবেন।” “শোনাতে হবে না। এটা অটো রেকর্ডার!” “মানে কী, ভাইয়া?” “মানে আমি ঘুমের মধ্যে ভয়ানক নাক ডাকি! তুমি আসার পর নাকে তুলো দিয়ে ঘুমাব ভাবছি। কিন্তু সমস্যা আরেকটা আছে। নাক বন্ধ থাকলে মুখ হা হয়ে যাবে। এটা নিয়ে একটু চিন্তায় আছি!” “ও মাই গড! আর ইউ সিরিয়াস???”
কথার এই পর্যায়ে ওপাশে চিং করে ফোন কেটে দেয়ার শব্দ হলো। রিমকি বেশ হতাশ হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে। এই আলট্রা মডার্ন মেয়ের সাথে যে আর বিয়ের কথা এগোবে না, তা আমি মোটামুটি তখনই নিশ্চিত ছিলাম।
যাহোক, এসব কথা ভাবিকে বলা যাবে না। যেকোনো কিছুতে সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। অথচ এটা তার উত্তেজনার সময় না। সন্তানসম্ভবা নারীদের এক্সাইটমেন্ট থেকে দূরে থাকা উচিৎ। এখন সে এডভান্সড স্টেইজে আছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ সাধারণত পঁয়তাল্লিশ ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। একজন নারী বাচ্চা প্রসবের সময় যে ব্যথা সহ্য করে তার পরিমান সাতান্ন ইউনিট, যা একসাথে কুড়িটা হাঁড় ভাংগার সমান! ভাবি সেই ভয়ানক ব্যথা নেয়ার জন্য হাসি মুখে অপেক্ষা করছে। আগে একবার তার মিসক্যারেজ হয়েছে।
আমি ভাবির দিকে চেয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলাম।
“তুই গাধার মত হাসছিস কেন? বুঝতে পারছিস, বাবার এক কালের ঘনিষ্ঠ কলিগ! তিনি এখন কথা রাখতে পারছেন না। বাবার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না! বললেন, তোকে ডেকে দিতে!” ভাবি প্রস্থান করতেই আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। বাবা প্রশস্ত বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন। একজন শান্ত, সৌম্য মূর্তি! ভীষণ নিরীহ গোছের আমার এই বাবা জীবনে তাঁর দুই ছেলের সাথে একবার জোরে কথা বলেননি। তিনি আমাদের সাথে অনেকটা বন্ধুর মত। তারপরও তিনি হাইপারটেনশানে কেন ভোগেন, এটা একটা রহস্য!
আজ কপালে কোন অশান্তি আছে কিনা বুঝতে পারছি না। বাবা তাঁর পুরু কাঁচের চশমা পাঞ্জাবীর খুটে পরিষ্কার করছিলেন। আমাকে আসতে দেখে চশমা দ্রুত চোখে লাগালেন। “রুমে বসে কী করছিলি?” “বই পড়ছিলাম, বাবা।” “আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে আর তুই বই পড়ছিস!বাহ ! কেন জানতে পারি?” “বারট্রান্ড রাসেলের থিউরি ফলো করছি। উনি বলেছিলেন, দুঃখ ভুলে থাকতে হলে বইয়ের মধ্যে ডুব দাও। আমিও ডুবাডুবির চেষ্টায় আছি।” বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। “আদর দিয়ে তোদের মাথায় তুলেছি। না হলে বারট্রান্ড রাসেল এখন তোর মুখে মারতাম! লজ্জায় আমার জান যায় অবস্থা আর উনি ডুবাডুবি খেলছেন!”
বাবা কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। তিনি হেসে ফেলেছেন। এই হলো আমার নিরীহ বাবার অবস্থা। সারাজীবন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে আড়াই কাঠার উপর তিন তলা এই বাড়ীটা করেছেন। জায়গা কেনা ছিল দাদার আমলে। টপ ফ্লোরে আমরা থাকি, বাকি দুইটা ভাড়া। আমি বাবার হাঁটুর উপর মুখ ঘষতে ঘষতে বললাম, “বাবা, নো চিন্তা । আমি বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা বাদ দিয়েছি। একটা চাকুরী নিয়েই মায়ের ইচ্ছা পূরণ করব।” বাবা ঝুঁকে এসে আমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বললেন, “মেয়েটাকে আমারও পছন্দ হত না, বুঝলি? শুধু তোর মায়ের কথা ভেবে এগিয়েছিলাম। অবশ্য মুখের উপর না বলাতে একটু কষ্ট পেয়েছি! মেয়েটা তোর মায়ের পছন্দের। অসুস্থ মানুষ। মনে যখন যা আসে তাই বলে।তুই তাড়াতাড়ি একটা চাকরী নিয়ে নে। তোর মায়ের অবস্থা খুব বেশি ভাল না।” আমার মা আপাতত আমাদের সাথে নেই। তিনি মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে কেমোথেরাপিতে আছেন। ল্যারেঞ্জাইটিসে জটিল কিছু হয়েছে। গলার কিছু অংশ কেটে বায়োপসি করানো হয়েছে। কাটা অংশ থেকে হলুদ দুর্গন্ধযুক্ত আঠালো কী যেন বের হয়। কথা বলা বন্ধ। কাশি দিলে কাটা জায়গার নল থেকে বাতাস বের হয়! সারাক্ষণ নার্সিং প্রয়োজন। ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে হাসপাতালের কেবিনে রাখা হয়েছে।
কেমো সবাইকে স্যুট করে না। মায়ের ধারনা, তিনি বাঁচবেন না। ছোট ছেলের বউ দেখেই মরতে চান। এটা একদম নির্দোষ চাওয়া, আমি জানি। সমস্যা অন্য জায়গায়। বিবিএ, এমবিএ শেষ করে ইউরোপে এডভান্স স্টাডির জন্য যাওয়ার নেশায় আজ পর্যন্ত কোথাও চাকরীর জন্য যাওয়া হয়নি। বাঙ্গালি মেয়েরা বেকারের সাথে বড়জোর প্রেম করতে পারে – বিয়ে নয়। ইংল্যান্ডের পেমব্রুকশায়ারের একটা প্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটারের অপেক্ষায় ছিলাম। বিধি বাম ! এখন পড়ার অফার লেটারের বদলে বিয়ের অফার লেটার নিয়ে ব্যস্ত আছি! সবই কপাল! রাতে ঘুমোতে যাব, এমন সময় ভাইয়া এসে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। চিরকুট তাঁর এক বন্ধুর লেখা।
চাচাজান, পত্র বাহকের সংসার অতিশয় অভাব কষ্টের মধ্য দিয়া যাইতেছে। একাউন্টস-এ তার চাকুরীটা নিশ্চিত করতঃ কৃপা বিতরণে মর্জি হয়। আপনার স্নেহের শফিক ভাইয়া বরাবরই মৃদুভাষী। একটা সিএ ফার্মে আছে। ভালই কাটছে। আমাদের বয়সের ব্যাবধান প্রায় আট বছরের। তাঁর পরে আমার একটা বোন ছিল। বোনটা দেড় বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এরপর আমার জন্ম। আমার এই ভাইটা কথা কম বললেও কেন জানি না তাঁকে আমি একটু ভয়ই পাই। সংসারে কাউকে না কাউকে ভয় পাওয়া ভাল। ভাইয়া আমার বিছানার পাশে বসে ছোটখাট একটা বক্তব্য ঝেড়ে দিলো।
“আমি তোর ভাবির কাছে সবই শুনেছি। এতে মেয়ে পক্ষের দোষ দেখি না। রাতে সূর্য আর দিনে চাঁদ উঠছে, এটা মানা যায়, তবে বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার বন্ধু শফিকের এক চাচা রিয়েল এস্টেট বিজনেস-এ নেমেছেন। কথাবার্তা সবই শফিক বলে রেখেছে। চিন্তার কিছু নেই। ওর চাচা আজমল সাহেব বোর্ডে উপস্থিত থাকবেন। তুই শুধু পিওনকে দিয়ে চিঠিটা পৌঁছে দিবি। চাকরী হয়ে যাবে।ইনশাআল্লাহ্!” ভাইয়া কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কী ভেবে আবার বসে পড়ে বলল, “চিরকুটের লেখা নিয়ে মন খারাপের কিছুই নেই। মানুষের কাছে নত না হলে কিছু পাওয়া যায় না, বুঝলি? বেশিরভাগ মানুষ উপকার করতে নয়, করুণা করতে ভালবাসে, বুঝলি?” আমি ভাইয়ার দেয়া চিরকুট পকেটে রেখে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শফিক ভাই যখন বলেছে, তখন চাকরী হবেই। ভাইয়ার এই বন্ধুর সাথে আমার পরিচয় ভালই। নিপাট ভদ্রলোক। কাল সকালে চিরকুট নিয়ে মহাখালী ওয়্যারলেসের একটা অফিসে যেতে হবে। সেখানে আজমল সাহেব নামের এক ভদ্রলোক এই কাগজবাহকের অপেক্ষায় থাকবেন।
এ বছর মাতাল ফাগুণ সাথে করে বর্ষা নিয়ে এসেছে! সাতসকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছি। এইচআর ডিপার্টমেন্টের এক লোক এসে বায়োডাটা নিয়ে গিয়েছেন। ভাইয়ার কড়া নির্দেশ ছিল, টাই পরতে হবে। টাই এখনও বাঁধা হয়নি। আপাতত ঘাড়ের উপর ফেলে রেখেছি। বৃষ্টি আমেজের বাসন্তী পরিবেশ ভালই লাগছে। গলা ছেড়ে গান গাইতে পারলে আরও ভাল লাগত। গান গাওয়া যাচ্ছে না, কারন আমার কাছাকাছি আরও অনেক চাকুরী-প্রার্থী বসে আছে। প্রার্থীদের মধ্যে চশমাপরা একটি মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে। তাকে ভীষণ নার্ভাস মনে হচ্ছে। নার্ভাস মানুষের শরীরে একধরনের জড়তা কাজ করে। জড়তা কাটানোর জন্য তারা হাস্যকর কিছু কাজ করে। শরীরের আড়মোড় ভাঙে, আঙ্গুল ফোটায়। মাঝেমধ্যে পা দোলাতে শুরু করে। এই মেয়ে একটু পর পর হাতে হাত ঘষছে!
আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে একটা আহ্লাদী হাসি দিলাম। আমার হাস্যমুখ দেখে সে বলল, “আপনার সমস্যা কী? হাসছেন কেন?”আমি টাই দেখিয়ে আবার আগের মত হাসি দিলাম। “জি, সমস্যা এই টাইকে নিয়ে! এটা গলায় পরতে হবে।” “হুম, টাই তো গলাতেই পরবেন। এটা তো ফ্যানে ঝুলিয়ে ফাঁসি নেয়ার জন্য বানানো হয়নি!” “আমি টাইয়ের নট বাঁধতে জানি না। অতীতে অনেকবার শিখেছি আর ভুলেছি। আপনি বাঁধতে পারেন?” “না। আর পারলেও আপনাকে বেঁধে দিতাম, এটা ভাবা ভুল। এখানে এতগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, আপনি আমার কাছে এসেছেন টাই বাঁধতে? চাকরীর ইন্টার্ভিউ দিতে এসেও মেয়ে দেখলে ফ্লার্ট করতে মনে চায়, এটা কেমন কথা?”
‘জি, এটা ভাল কথা। আপনি যে একটু আগে পাশের ছেলেটার সাথে পিঠ ঘেঁষে বসে ছিলেন, ওটা বুঝি কিছু না?”
“হাউ ষ্টুপিড! কী বলছেন এসব যা-তা?”
মেয়েটা ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছে। তার চিৎকারে সবার কৌতূহল দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। সবাই হয়ত ভাবছে, আমরা একে অপরের পরিচিত। সম্বোধনটা আপনি হওয়ায় কিছুটা সন্দেহের সুযোগ আছে। আমি গলা নামিয়ে বললাম, “আমি আসলেই ঝোঁকের মাথায় অপরাধ করে ফেলেছি। আপনার নার্ভাসনেস কেটেছে? ফ্রি উপকার বলতে পারেন। এখন শরীরটা ঝরঝরে মনে হচ্ছে না, বলুন? এবার আপনার ইন্টার্ভিউ ভাল হওয়ার কথা।” মেয়েটা চেষ্টা করছে, না হাসতে। চেষ্টা সফল হলো না। সে চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি প্রায়ই এমন ছেলেমানুষি নাটক করেন?” “হু । জীবনে সুখি হতে হলে, কখনও কখনও নাটক করা জায়েজ আছে। কথাটা আমার নয়, এক আমেরিকান ভদ্রলোকের। নাম ডেল কার্নেগী। আপনার ইন্টার্ভিউ সিরিয়াল কত?” “ঊনষাট।” “আমারটা বত্রিশ। আপনার আগেই আমার কল পড়বে। আমার টাই টা যদি একটু ব্যাগে রাখতেন। আমি ব্যাগ-ট্যাগ কিছুই আনিনি।”
“এটা আপনি রিসিপসনেও রাখতে পারতেন। যাহোক, আমিই রাখলাম। শেষে ফিল্মী স্টাইলে আবার ফেলে যাবেন না দয়া করে। আমি কিন্তু স্ট্রেইট ডাস্টবিনে ফেলে চলে যাব!” বলেই মেয়েটা হাহা করে হেসে ফেলল। বাহ! এমন হাসিতে খুন হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়! কী অদ্ভুত! আমার মা ভয়াবহ অসুস্থ, আর আমি অন্য মেয়ের হাসিতে গলে যাচ্ছি! প্রকৃতির এই বিচিত্র খেলার কোন মানে হয়! কথোপকথনে বাধা পড়ল। বায়োডাটা সংগ্রহকারী ফিরে এসে বললেন, ” ইন্টার্ভিউ শুরু হতে ঘন্টা দুই দেরী হবে। এখানে কেউ জটলা না করে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কারেক্ট সোয়া এগারটায় এসে রিপোর্ট করলেই চলবে। এখন বাজছে নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট।” আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। ওয়্যারলেস মোড়ে এক চায়ের দোকানে বসে আছি। চায়ের কাপ খালি নেই, তাই একটা সিগারেট জ্বেলে আঙুলের ফাঁকে নিয়ে বসে আছি। গুলশান-১ এর দিকে চলে যাওয়া সোজা রাস্তায় চোখ পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুদূর হাঁটলেই টিবি গেইট মোড়। পাশেই ক্যান্সার হাসপাতালে আমার আরেক পৃথিবী দূরারোগ্য শয্যায় শায়িত! আমার মা!
রোজ পালা করে আমি, বাবা আর ভাইয়া তিন বেলা তাঁর কাছে এসে সময় দেই। ভাবি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় আসতে পারে না। মায়ের সাথে একজন সার্বক্ষণিক পেইড নার্স রাখা আছে। হাসপাতালের সার্ভিসের যা অবস্থা, তাতে খরচ সাপেক্ষ হলেও এর বিকল্প ছিল না। ইন্টার্ভিউ শেষ করে মায়ের কাছে যেতে হবে। আমার ভাবনা আর এগোল না। অফিস রুমের চশমাওয়ালী চলে এসেছে। তার মুখ হাসি হাসি। “এই যে কার্নেগীর শিষ্য, পাশে বসতে পারি?” “বসুন। চা খাবেন?” “হুম। মাথাটা খুব ধরেছে! আর হ্যাঁ, আমার নাম প্রমা। আমি সাধারণত কথা কম বলি। তবে পছন্দের মানুষ পেলে মন খুলে কথা বলি। কথা বলে মাথা ধরিয়ে দেয়ার রেকর্ডও আমার আছে! এত অপরিচিত মানুষের ভিড়ে আপনাকে পেয়ে ভাল লাগছে।” প্রমা পাশে বসতেই আমি আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। মেয়েদের পাশে বসে সিগারেট খাওয়াটা অস্বস্তিকর। আমি অবশিষ্টাংশ ফেলে দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম।
প্রমা ম্লান হেসে বলল, “আমি ইডেন থেকে ম্যাথমেটিক্সে অনার্স শেষ করেছি।কিছুদিন আগে রেজাল্ট হয়েছে। এটা আমার সেকেন্ড ইন্টার্ভিউ। প্রথম ইন্টার্ভিউটা ভাল হয়েছিল। অনার্সের রেজাল্ট না হওয়াতে মনে হয় জবটা হলো না। মেয়েটির বিষণ্ণ মুখ দেখতে ভাল লাগছে না। তার রেগে যাওয়া মূর্তি আর হাসিমাখা রুপ একটু আগে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখেছি। ঠোঁটের উপরে ডান পাশের তিল টা তার রূপ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসলে ছোট্ট একটা গজ-দাঁত চোখে পড়ে। আমি নিশ্চিত, এই মেয়ে হাসি দিয়ে অজস্র পুরুষের কল্পরাজ্য ওলটপালট করেছে! মেয়েটি কি তা বুঝতে পারে? আহা, এই মেয়েটা যদি বউ হত! আমি ওকে “প্র” বলে ডাকতাম! ও রেগে বলত, “তুমি আমাকে প্র বলে ডাকো কেন?” “তোমার নামের শেষাংশে “মা” জোড়া লাগানো আছে। বউএর নামের সাথে “মা” রাখা ঠিক না।” “তাতে কি? আমি তোমার বউ, কিন্তু তোমার বাচ্চাদের তো মা!” “হু, এ কথায়ও যুক্তি আছে।”
আমাদের কথা শুনে নাদুপুদু বাচ্চারা আলুবুলু ভাষায় কথা বলত আর হাসত। হাসার সময় ঠোঁটের কষ্ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ত। আহা! প্রমার গলা খাঁকাড়িতে আমার কল্পিত নাট্যমঞ্চে ছেদ পড়ল। “কী ব্যাপার,কোথায় হারিয়ে যান?” “হারাতে আর পারলাম কই! কাশি দিয়েই তো নাটাই ধরে টান মারলেন!”প্রমার নিরুদ্দেশ চাহনি আকাশের দিকে। সেদিকে চোখ রেখেই সে এক নিঃশ্বাসে মুখস্থ পড়ার মত বলা শুরু করল। “জানেন, চাকরীটা আমার ভীষণ দরকার। বাবা ছোট একটা বেসরকারি জব করে। বয়স হয়েছে, আর পেরে উঠছে না। মা বুটিকের কাজ জানে। সেদিন আঙুলে সুই ফুটিয়ে নিয়েছে। দৃষ্টিশক্তি আর আগের মত নেই। বড় বোন স্বামীর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমার কিছু একটা করতেই হবে।”
প্রমা আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। মানুষকে অদ্ভুত ভাবে আপন করে নেয়ার এক সম্মোহনী শক্তি আছে মেয়েটার মধ্যে! সে আবার বলল, “আমাকে দেখে অবশ্য তেমন কিছু বুঝবেন না। স্মার্ট হয়ে চলার চেষ্টা করি । ঢাকা শহরে নিজের দুর্বলতা কাউকে বুঝতে দেয়া উচিৎ না। স্যরি, আপনাকে বোরড্ করে দিলাম!” প্রমার হাতের চা শেষ হয়নি। এখনও অর্ধেক কাপ বাকি আছে। সে বাকি চা’টুকু ঢেলে দিলো পাশের ড্রেনে। আমি মেয়েটার দিকে আবার তাকালাম। এই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের রূপবতী মেয়েটা আমার কাছে কিছুক্ষণ আগেও ছিল অপরিচিতা। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম বোঝা দায়! আমি সহানুভূতির স্বরে জানতে চাইলাম, “মাথা ব্যথা কমেছে?” “ওসব নিয়ে ভাববেন না। চোখের পাওয়ারে সমস্যা আছে। একটা প্যারাসিটামল খেয়েছি। এলোপ্যাথি ওষুধ আমি সাধারণত এড়িয়ে চলি।”
“সারাক্ষণ গেলোপ্যাথিতে ভুগলে, এলোপ্যাথিতে কাজ হয় না। গেল রে, গেল রে কান্না বন্ধ করুন, দেখবেন সব ফিট। হা-হা-হা” “আপনার কখনও মন খারাপ হয় না?” “হুম হয়। ঋতুর বৈচিত্র আমাকে বিষণ্ণ করে দেয়। যেমন, একটু আগে আমার গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ রোগের একটা চমৎকার নামও দিয়েছে। রোগের নাম SAD ! মানে, Seasonal Affective Disorder! সুন্দর না নামটা?” “দারুণ তো! আপনি তো দেখছি অনেক কিছু জানেন!” “ভুল বলেছেন। আমি ছাত্র হিসেবে কখনই ভাল নই। বিবিএ তে দুই সাবজেক্ট রিটেক দিতে হয়েছিল! হা-হা-হা” আমার হাসির চেইন রিএকশান শুরু হয়েছে। বিষণ্ণকুমারীর মন ভাল হতে শুরু করেছে। সে ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে বলল, আচ্ছা, এটাই কি প্রথম চাকরীর বোর্ড ফেস করছেন? “না, আগেও করেছিলাম; একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পাবলিক রিলেশন অফিসারের জন্য। ভাইবা-তে সাইকোলজি টেস্টে আউট হয়ে গেলাম।” “ইন্টারেস্টিং! আউট হলেন কেন?”
“বোর্ডে তিন জন লোক ছিলেন। একজন ছিলেন টেঁকো। মাথায় পরে থাকা পরচুলা বোঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ তিনি বললেন, আপনি এমন কোন স্কিল শো করুন যা দেখে আমরা ইম্প্রেসড হই । আমি এক ঝটকায় টেঁকো ভাইয়ের পরচুলা খুলে ফেলে বললাম, “মাথা টাক, খুলে যাক! ব্যস, চাকরী ওখানেই শেষ!” কথাটা শুনে প্রমা প্রথমে একটু শক্ত হয়ে গেল, তারপর শরীর দুলিয়ে ঝড়ের বেগে হেসে ফেলে বলল, “ধুর্ , এমন করা যায়? আপনি মিথ্যা বলছেন, তাই না?” “হুম……।” – প্রমা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “থাক বুঝতে পারছি বারবার বানিয়ে কেন বলছেন। আপনার মধ্যে একটা অসাধারণ গুণ আছে, তা কি আপনি জানেন?” “জানি।” “আর কী জানেন?” “আর জানি, এ চাকরীটা আপনার হয়ে যাবে।” “এক্সকিউজ মি!” “আপনার এক্সকিউজ মি আপনার ব্যাগে পুরে রাখুন।”
কথাটা বলে আমি, আমার পকেটে রাখা চিরকুট প্রমার হাতে দিয়ে বললাম, কোন স্টাফকে দিয়ে এটা আজমল সাহেবের কাছে পৌঁছে দেবেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আপনাকে শফিক নামের একজন ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। আমার কাজ আছে, চলি।” প্রমার হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে, সে আমাকে কিছু বলার আগেই লাফ দিয়ে ৬ নম্বর বাসে উঠে পড়লাম। ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পারলে ভাল লাগত। কী ভাবলো কে জানে! ভরা সন্ধ্যায় আবারও বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরছি। সারাদিন শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। মায়ের কাছে অনেকক্ষণ কাটিয়েছি। তাঁর পায়ের উপর হাত রেখে তার উপর থুঁতনি গেড়ে বসেছিলাম। মা কথা বলতে পারেন না। ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমার আলুথালু চুল গুলো ঠিক করে দিলেন হাত দিয়ে। আঙুল দিয়ে ফাঁকা করে বাম পাশে সিঁথি করে দিলেন। ছোট বেলা থেকেই এটা মায়ের কমন অভ্যাস। শুধু রিমকির সাথে আমার বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াটা সঙ্গত কারনেই মায়ের কাছে প্রকাশ করিনি।
তারপর গিয়েছি শফিক ভাইয়ের অফিসে। প্রমার চাকরীটা যদি হয়েই যায়, তবে মেসেজ গ্যাপ রাখা ঠিক হবে না।
চাকরীর ঘটনা বলতেই শফিক ভাইয়ের মৃদু ধমক খেতে হয়েছে। সে মুখ ভার করে বলেছে, তোরা সবাই যে কি হয়েছিস,বুঝি না! এই বাজারে চাকরী এভাবে কেউ হাতছাড়া করে? সময় করে চাচীকে একদিন হাসপাতালে দেখতে যাব। মন খারাপ করিস না। দুঃসময় সবারই আসে।” বাসার গেটের সামনে আসতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম। ছাতা মাথায় একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি ছাতায় মানছে না। মেয়েটার নাম প্রমা। আশ্চর্য, প্রমা আমাকে দেখে মোটেও চমকাল না! কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আপনি তো ভারী ডেঞ্জারাস মানুষ! একজনকে চাকরী পাইয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। খুব কষ্টে একজনকে দিয়ে আপনার সিভি থেকে বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে আসতে হলো। দেখি ছাতার নীচে আসুন। আপনি ভিজে যাচ্ছেন।”
আমি ছাতার নীচে গেলাম না। অবাক হওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঘোর লাগা চোখে বললাম, “কৃতজ্ঞতা জানাতে এত দূর এসেছেন। ভাল।” “উহু। আপনার মত মানুষ কারও কৃতজ্ঞতার ধার ধারে না, তা আমি বুঝি। আপনার সাধের টাই ফেরত দিতে এসেছি। আচ্ছা, চাকরীটা আপনি নিজে করলেন না কেন?” আমি একটা নকল হাসি দিয়ে মিথ্যে করে বললাম, “আমার আরেকটা এপয়েন্টমেন্ট লেটার রেডি আছে।” প্রমা টাই ফেরত দিয়ে আর দাঁড়ালো না। আমার ফোন নাম্বার নিয়ে বলল, আমার চাকরীর কনফার্মেশন দিয়েছে। বাবা-মা টেনশন করছেন। আগামী শুক্রবার বনানী লেকে দেখা করব। অবশ্যই আসবেন।” বাসায় ঢোকার পর ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, রাস্তার সুন্দরি মেয়েটা কে? ডুবে ডুবে জল খাও আর একাদশীর উপোষ থাকো! ঘটনা কী খুলে বল।” “ঘটনা কিছুই না। পূর্বপরিচিতা।”
ভাইয়া অফিস থেকে ফিরেছে। ভাবি আমাকে আর খুব বেশি জোর করলেন না। এমনকি চাকরীর হাল হাকিকত নিয়েও কিছু বললেন না। শুধু মায়ের সংবাদ নিলেন। শেষে নিজের রুমে চলে গেলেন। আজ কাঙ্ক্ষিত শুক্রবার। বনানী লেকের এক পাশে প্রমাকে নিয়ে বসে আছি। ওকে প্রকৃতি-কন্যার মত মনে হচ্ছে। ফাগুণের খেয়ালী বাতাস খেলা করছে ওর কানের দুপাশের ঝুলে থাকা চুলে। জীবনানন্দ বাবু কী ভেবে লিখেছিলেন, “বসন্তের রাতে, যেমন দেখি সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে!!” সবিতা কেমন ছিল? প্রেমিক চোখ বড়ই অদ্ভুত। আমি নিরিখ করে প্রমাকে দেখছি। আজ সে লেমন ইয়েলো কালারের উপর চুনা প্রিন্টের একটা থ্রি কোয়ার্টার স্লিভের সুতি-জামা পরে আছে। একই রঙের লেইস দিয়ে অফ হোয়াইট মেশ ফ্যাব্রিকের ওড়না আর চুড়িদার অফ হোয়াইট স্যালোয়ারেই বেশ মানিয়ে গিয়েছে মেয়েটাকে। আমার চুপ করে থাকা দেখে প্রমা বলল,
“মুখ বাংলা পাঁচের মত করে আছেন কেন? পরিচয় অল্প হলেও আপনাকে আমি আমার শ্রেষ্ঠতম বন্ধু মানি। চাকরী পেয়েছি, তার জন্য নয়। নারীর প্রতি আপনার শ্রদ্ধাবোধ টের পেয়েছি আমি। জানেন তো, মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন আছে। তাই একটু বেশি অধিকারসুলভ আচরণ করছি।” “কৈফিয়তের কিছু নেই।” “আচ্ছা, আপনি কি কোন কষ্টে আছেন? অবশ্য আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আপনাকে রিড করার সাধ্য আমার নেই।” “উম, একটা জায়গায় যেতে হবে। আমার মায়ের কাছে। তিনি এখন হাসপাতালে।” “ওপ্স স্যরি! আমিও আপনার মাকে দেখতে যেতে চাই। কিন্তু একা নয়, আমার বর কে নিয়ে একবারে যাব।” বলেই প্রমা হেসে যোগ করলো, “আমি জানি আপনি আমাকে জোর করছেন না, তবু যেতে চাই। আপনার মায়ের দোয়া আমার খুব প্রয়োজন। কিন্তু, আজ সময় নেই। পারিবারিক একটা সিধান্তের জন্য বড় বোন তার হাজবেন্ড নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে।”
আমি প্রমার সুসংবাদে খুব বেশি আগ্রহ দেখালাম না। অনেকে রহস্য করতে ভালবাসে। প্রমা একটু হাসলো। শেষে বলল, “কিছু মনে করবেন না। মজা করলাম। সেদিন আপনি বকর-বকর করেছেন। আজ আমি করছি, তাই না?”
অনেকক্ষণ পর খেয়াল করে দেখলাম আসলেই তাই। আমি এত চুপচাপ কখনই ছিলাম না। সন্ধ্যার ঘোর লাগা শুরু হচ্ছে। বহুদিন পর হাতে ক্যান্ডি ফ্লস খেতে খেতে হাঁটছি। প্রমাও বাচ্চাদের মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাচ্ছে। আমি ওকে রিকশায় তুলে দিতেই ওর বিখ্যাত হাসি দেখলাম। গজ-দন্ত হাসি! অসাধারণ অনুভূতি। মায়ের কেবিনে বসে আছি অনেকক্ষণ হলো। মা ঘুমাচ্ছিলেন। শীর্ণ দেহ বিছানার সাথে লেগে আছে। মা জেগে ওঠার পর ইশারায় আমাদের পেইড নার্সকে ডাকলেন। ওয়াশ রুম সেরে এসে বিছানায় বসে নার্সকে বাইরে যাওয়ার ইশারা দিলেন। মেয়েটা ইশারা-অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। সব ইশারাই সে বুঝতে পারে।
মা আগের মত মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আমি তাঁর পায়ের আঙুল হাত বোলাতে বোলাতে বললাম,
“মা, তোমার ছোট পুত্র বধূর খোঁজ পেয়েছি। রিমকি না কিন্তু! মেয়েটার নাম প্রমা। তোমাকে দেখতে আসবে বলেছে।” মা আমাকে কাছে ডাকলেন। তাঁর চোখের পানিতে বৈদ্যুতিক আলো পড়ে তারার মত ঝিকমিক করছে। আমি ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে আছি। একটু আগেই, মন ভাল করা একটা সুসংবাদ পেয়েছি। শফিক ভাইয়ের জরুরী তলব ছিল। শফিক ভাইয়ের অফিস পাশেই – মনিপুরী পাড়ায়। অফিসের নতুন একটা ব্রাঞ্চ উত্তরায় লঞ্চ করছে। আমার চাকরীটা এই নতুন ব্রাঞ্চেই হচ্ছে। আগামী মাস থেকে জয়েন। শফিক ভাই ক্ষমতাধর কেউ জানতাম, তবে এতটা জানা ছিল না।
চাকরীর সংবাদটা কয়েকজনকে জানানো উচিৎ। আগে বাবা কে জানাতে হবে। রাত একেবারে কম হয়নি। প্রথমবারে কাউকে পাওয়া গেল না। দ্বিতীয় বার চেষ্টা করতেই বাবা রিসিভ করলেন। তাঁর কণ্ঠে ঘুমের জড়তা চলে এসেছে। আমার চাকরীর কথা শুনতেই খুশিতে কাঁপতে শুরু করেছেন। তাঁর কথা আরও জড়িয়ে যাচ্ছে। ফোন রাখার আগে বললেন, ” মাই সান, চাকরী পেয়েছ ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। Choose a job you love and you will never have to work a day in your life । কথাটা মহামতি কনফুসিয়াসের। ভীষণ মূল্যবান কথা! চাকরীকে ভালবাসলে কাজ সহজ হয়ে যায়। রাত হয়েছে, তাড়াতাড়ি বাসায় ফের।” প্রমার ফোনে রিং বাজতেই পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে, এই মেয়ে আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। “প্রমা, আগামী মাসে আমি জয়েন করছি। উত্তরা জোনাল অফিসে। স্টারটিং এ বিশ হাজার দিবে। খারাপ না, কী বলেন?” “কংগ্রাচুলেশান! আমিও আপনাকে একটা সুসংবাদ দিতে চাই।” প্রমার কথায় আমার হৃদয়ে কামারের হাতুড়ী পেটানো শুরু হলো। আমি একটু কেশে বললাম, “আমি অধীর আগ্রহে শুনছি। বলুন।”
“বন্ধুর কথা আগ্রহের সাথেই তো শোনা উচিৎ। তাছাড়া বিয়ে-শাদি বলে কথা! হাহা” আহা ! আমার কর্ণকুহর জুড়াইলো! আমি ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললাম, “বিয়ে? দারুণ! কখন?” “আগামীকাল। পাত্র আমেরিকায় থাকে। সেদিন আপনাকে বললাম না, আপা, দুলাভাই এসেছে? একারনেই এসেছিলেন। বাবা-মা ভীষণ খুশি।” “আপনি খুশি না?” আশ্চর্য! আপনি আসলেই বড্ড ছেলেমানুষ! হ্যান্ডসাম পাত্র। আমেরিকায় সিটিজেনশিপ! খুশি না হওয়ার কী আছে? হাহা” প্রমা হাসছে। আমি শুনছি! আসলে কি হাসির শব্দ শুনছি? জানি না। আমি মাথার উপরের মহাশূন্যে চোখ রাখলাম। হে ধরণী মাতা! তোমার কাছে এই জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই! বাসায় ফিরতে রাত দুইটা বেজে গেলো। শেষ রাতের দু-একটি মিরপুরগামী বাস পেয়েছিলাম। উঠতে মন চায়নি। সারা রাস্তা হেঁটে এসেছি ভীষণভাবে ক্লান্ত হব বলে!
ভাবি দরজা খুলে দিলো। আগ্রহ নিয়ে জানালো, রিমকির বাবা না কি নিজেই এসেছিলেন বাসায়। তিনি অনুতপ্ত। ভাবি কথায় কথায় এটাও জানতে চাইলো, রিমকির সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়েছে কি না। শেষে বলল, খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে। কাল মা-কে আমার আনতে যাওয়া কথা। খুব বেলা হয়েছে টের পাইনি। ভাবি এসে দরজা ধাক্কানো শুরু করেছে। বাড়ীতে আগুণ লাগলেও মনে হয় এমনভাবে কেউ ধাক্কায় না। দরজা খুলতেই বলল, “গাধা এক্ষুনি ওঠ। বাসায় অতিথি এসেছে। আমি আর তোর ভাইয়া ওদিকটা দেখছি। তুই তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে আয়। সাতসকালে কিসের অতিথি! ভাবি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বুকের মধ্যে ঢিব-ঢিব করছে। রিমকির বাবা-মা না তো! ড্রয়িং রুমে উঁকি দিয়ে দেখার রুচিও আমার হলো না। শুধু হাতেমুখে পানির ছিটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
আমাদের বাসার রাস্তার মাথায় এসে দেখি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে এসেছি! প্রমা দাঁড়িয়ে আছে। এসবের মানে কী? আবার কী সমস্যা, কে জানে! এই মেয়ের চাকরী আছে তো? কাছে আসতে প্রমা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “হাতে সময় নেই, জলদি চলেন।” “জলদি মানে? কোথায়?” “আপনার কি ধারনা আপনিই সব বুঝেন? আসলে ব্যাপারটা তা না মিস্টার প্রেমিক পুরুষ। অন্যদেরও ফ্লোর দিতে হয় মাঝেমধ্যে।” কথাটা বলেই প্রমা একটা রিকশা ডেকে তাতে চেপে বসল। আমাকে উঠতে বলে হেসে বলল, “আরে হাঁদারাম! আপনাকে আগেই বলেছিলাম, আমার বর কে নিয়েই আপনার মাকে প্রথম দেখতে যাব। আজ যাচ্ছি। আজ যাচ্ছি শুধু দেখতেই নয়, তাঁকে আনতে। ডাক্তারের স্পেশাল অনুমতি নেয়া আছে।”
ওর কথা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার না। এসব ব্যাপার আর যাই হোক, ছেলেখেলা নয়। ড্রয়িং রুমে কারা বসে ছিল কে জানে! আমি দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করতেই ও শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল। বলল, “আপনাদের ড্রয়িং রুমে আমার বাসার লোকজন এসেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সেদিন সন্ধ্যায় আপনি আসার আগেই আপনাদের বাসায় ঢুকেছিলাম। আপনার সব কাহিনী শুনেছি ভাবির কাছে। অসাধারণ একজন মহিলা। ঠিক তখন হঠাত ড্রয়িং রুমে শ্বেতশুভ্র বয়স্ক একজন মানুষ আসলেন। পরিচয়ে জানলাম, তিনি আপনার বাবা। আমাকে বললেন, শোন মেয়ে আমি তোমাকে আমার পুত্রবধূ হিসেবে চাই। তোমার আপত্তি না থাকলে আজই পরিবারের সাথে কথা বলবা। আমার ছেলেকে তুমি দেখেছ। কতটুকু দেখেছ, জানি না। তবে সে পছন্দ হওয়ার মত কেউ, তা জানি। হ্যাভ ইউ গট দা পয়েন্ট?” বিস্ময় আর অভিমান নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে গত রাতের ঐ আমেরিকান ছেলে কে ছিল? আই মিন, মিথ্যা বলেছেন কেন?” প্রমা প্রসন্ন মুখে জবাব দিল।
“সে রাতে আপনার বাবার কথা আমি মেনে নিয়েছিলাম, তবে একটা শর্ত ছিল। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমাকে চাকরীটা পাইয়ে দেয়াতে আপনার কোন স্থূল স্বার্থ ছিল কি না। তাই এই মিথ্যাটা বলতে হয়েছে। স্বার্থ থাকলে, আপনি আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন। আমি দুঃখিত!” আমার মস্তিষ্ক ঘটনার তীব্র আকস্মিকতায় থমকে গিয়েছে। মুখে কোন কথা জুগিয়ে উঠতে পারছি না। প্রমার হাত দুটো কি এখন ধরতে পারি আমি! ভীষণ মনে চাচ্ছে, ওর হাত দুটো নিয়ে আমার মুখে, কপোলে ঘষে দিতে। এক প্রাণের স্পন্দিত ইলেকট্রোন আরেক প্রাণে প্রবাহিত হতে সময় নেয় না। আমি এই প্রথম প্রমার মুখে কাঙ্ক্ষিত শব্দটি শুনলাম!
সে আমার মুখে হাত বুলিয়ে শেষে চুল স্পর্শ করল। বেশ মমতা নিয়ে বলল, “তোমার চুলগুলো বড্ড অগোছালো। দেখি আরেকটু গা ঘেষে বসো, চুলগুলো ঠিক করে দেই!” আমি প্রমার চারুশিল্পময় হাতখানি আমার কোলে টেনে নিলাম। এমনই এক জোড়া হাতের উষ্ণতা আমি আজন্মকাল বুকে লালন করেছি! আজ আকাশে কোন মেঘ নেই। তবু ফাগুণের বাতাসে কিঞ্চিৎ ভেজা ভেজা গন্ধ লেগে আছে। রৌদ্রজ্জ্বল একটি দিন। অথচ, অদ্ভুত হিম হয়ে আসা এক শিতলতায় হৃৎপিণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই কাঁপুনির উৎস আমার জানা নেই!