কাঠের বাক্স

কাঠের বাক্স

এমন বর্ষণমুখর দিনে ধুলোমাখা গানের ডায়েরীটা মুছে গুন গুন করে গান সাধতে চাইলেও আজ আর সুর ওঠে না। স্বরলিপিগুলোও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। হারমোনিয়ামের বাট টেনে সুর তুলতে চাইলে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। সেই রঙিন ছেলেবেলা আর ফিরে আসবে না!

তখন আমার বয়স চার কি সাড়ে চার হবে। দুপুরে মা ঘুমুচ্ছিলেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছিলাম। কী গান গাইছিলাম তা মনে নেই। পাশের বাসায় প্রতিদিন রাতে রেডিওতে গান বাজত। বেশীরভাগই রবীন্দ্রসংগীত। সেখান থেকেই শুনে শুনে একটু – আধটু শিখেছিলাম। আমার গান শুনে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। চুপি চুপি এসে পাশে দাঁড়ান। আমি লজ্জা পেয়ে থেমে যাই। মা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন, আর বলেন, ‘থামলি কেন?’ আমি আবার গাইতে শুরু করি। এরপর একদিন পাশের বাসার আন্টি শুনে মাকে বলেছিলেন, ‘ভাবী, মেয়ের গানের গলা তো ভালো। গান শেখালে ভালো করবে!’

বাবা খুব শৌখিন ছিলেন। মা গানের ব্যাপারে বলতেই, তার আগ্রহের সীমা রইল না। তবে আমার আগ্রহ ছিল শুধুই হারমোনিয়ামের প্রতি। কীভাবে একটা কাঠের বাক্সের মতো জিনিসের এক প্রান্ত ধরে টানলেই সুরেলা শব্দ হয়। গান তো শখ করে গুন গুন করতাম! বাবা গানের ওস্তাদ খুঁজতে লাগলেন। তারা বলতেন, ‘ভাই, আগে হারমোনিয়াম কিনতে হবে’। বাবা ফিরে আসেন। সরকারি চাকরী করতেন। তৎকালীন সময়ে আট হাজার টাকা বেতনের চাকরী। একটা ভালোমানের অর্গান হারমোনিয়ামের দাম ছিল পাঁচ হাজার টাকা। যা আমার মধ্যবিত্ত বাবার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। আমি প্রতিদিন আগ্রহ নিয়ে আপেক্ষা করতাম কখন বাবা বাসায় আসবেন। সাথে থাকবে সেই অদ্ভুত কাঠের বাক্স। হারমোনিয়াম! বাবা খালি হাতে ফিরতেন। আমি হতাশ হয়ে ঘুমুতে যেতাম। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘মা, কিনলে তো ভালোটাই কিনব। তাই না? আপাতত ভালো হারমোনিয়াম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অর্ডার দিয়ে এসেছি বানিয়ে দেবার জন্য। এজন্যই দেরী হচ্ছে।’

এভাবে সবাই ব্যাপারটা ভুলে গেল। আমিও ভুলে যেতে লাগলাম। তবে মনে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত অদ্ভুত কাঠের বাক্সটা ছোবার আকাঙ্ক্ষা থেকে গেল। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন দরজা খুলতেই দেখি বাবার হাতে বড়সড় কালো একটা ব্যাগ। আমার সমস্ত কৌতুহল ব্যাগটাকে ঘিরে। যখন বাবা ব্যাগটা খুললেন আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। হারমোনিয়াম! সেদিন জানতাম না, মেয়ের শখ পূরণ করতে আমার মা নিজের স্বর্ণের অলঙ্কারসামগ্রী বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর আমার মধ্যবিত্ত বাবা তা বিক্রি করে আমার জন্য এনেছিলেন সেই ‘কাঠের বাক্স।’ বাবা আমার জন্যে একজন ওস্তাদ রেখে দিলেন। সপ্তাহে চারদিন আসতেন। ভালোই চলছিল গান শেখা। কয়েক বছর পর বাবার বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা পুরো পরিবার যশোরে চলে আসি হই।

যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি আমি। কলেজে পড়ি। যশোরে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ।নতুন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে বেশ সময় লেগেছে। পড়াশোনার খরচও অনেক বেড়েছে। একা সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে বাবা হিমশিম খাচ্ছেন। নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাবার জন্য নিজেই টিউশন শুরু করি। আমার গান শেখা স্থগিত রইল। আর ততদিনে ঐ কাঠের বাক্সটার প্রতি আমার কৌতুহলও মিটে গেছে। ভুললে চলবে কেন এটা মধ্যবিত্ত সংসারের গল্প!

প্রায় তিন বছর হতে চলল বাবা গত হয়েছেন। আমার জন্য বাবার রেখে যাওয়া সমস্ত সঞ্চয়টুকু দিয়ে মা আমার বিয়ে দিয়েছেন। মা আমাদের সাথেই থাকেন। আমার একটা মেয়ে হয়েছে। ওর নাম রেখেছি ‘লীলাবতী’। বয়স দেড় বছর। কাঠের বাক্সটা আমি অনেক যত্ন করে রেখেছি। এটা দিয়েই আমি আমার মেয়েকে গান শেখাব। তার বাবা আমার বাবার মত মধ্যবিত্ত নয়। আমি চাই সে আমার বাবার কষ্টটুকু বুঝতে পারুক। বুঝুক আমি কখনো তার মতো চাইলেই পেয়ে যাইনি। অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভালো থাকুক সব বাবা-মায়েরা। সন্তানের সুখের জন্য যারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে যাচ্ছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত