মনোয়ারা বেগমের এই বাসাটাতে কেন যেন অস্বস্তি লাগে। ছেলে তার বড় ডাক্তার। ছেলে তাকে ভাল ও বাসে। তবু কেমন জানি খাপছাড়া লাগে। আজ পাঁচদিন হলো মনোয়ারা বেগম এসেছেন। একদিন ও ছেলের সাথে ভাত খাননি। দিনে ছেলে বাসায় খেতে আসে না। সকালে নাকি ছেলে তার নাস্তা খায় না। লেবু দিয়ে পানি আর এক কাপ চা খেয়ে হসপিটালে যাওয়ার সময় ” মা যাচ্ছি ” বলে বেরিয়ে যায়।রাতে বাচ্চাদের সাথে খান মনোয়ারা। দুই বাচ্চা মনোয়ারার বৌমার। একটু ডাল আর দুই পিস মুরগির মাংস দিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে বাচ্চারা খায়। উনি একা টেবিলে বসে ভাত খান। মনোয়ারার বড় লজ্জা লাগে। আজ ছেলে কাকে দিয়ে যেন, টিকিট কেটে এনেছে। পরশু উনি চলে যাবেন। রাতে বৌমাকে নিয়ে ছেলে খেতে বসেছে।
মনোয়ারা ভয়ে ভয়ে খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ বাবা পরশু চলে যাচ্ছি। দুইটা ইলিশ মাছ কিনে দিবা! আম্মা, আমিতো বাজারে যাইনা, আপনার ছেলের বৌ আনিয়ে দেবে। ছেলে ইতস্তত করতে করতে বলে।
ছেলের বৌ ইংরেজিতে ছেলেকে বলেন, ‘ তোমার মা কি টেবল ম্যানার্স্টুকুও জানে না? সারাদিন পরে একটু দুজন খেতে খেতে কথা বলছি, এটুকুও সহ্য করতে পারে না ? উনি দ্রুত চলে যেতে চাইলেন, ছেলে কি মনে করে জিজ্ঞেস করে ‘ রাতে খেয়েছো মা? ‘ শুধু এইটুকু কথাতেই মনোয়ারার চোখে জল এসে যায়। আজ প্রথম ছেলে তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করলো। মনোয়ারার ছেলের বউ তৃষা চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ তার মানে কি বলতে চাও? তোমার মা’কে খেতে দেই না আমি? আমার বাচ্চাদের আগে টেবিলে তোমার মায়ের খাবার দেয়া হয়। রাগ করে বৌমা উঠে চলে যায়। লজ্জিত মনোয়ারা দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে শুয়ে পড়েন।
প্রায় পুরোরাত ঘুম হয় না। ফজরের সময় বারান্দায় এসে দেখেন, ছেলে চোখ লাল করে বারান্দায় বসে আছে। হয়তো রাতে ঘুমায়নি। উনি শুধু বলতে চান, থাক বাবা ইলিশ মাছ লাগবে না। এর মাঝেই ছেলের বউ এসে ঢোকে। দুদিন পর পর এসে আমার সংসারে আগুন লাগিয়ে কি শান্তি পান আপনি? সারারাত ঘুমাইনি একটু শুয়েছি, আর ছেলের কাছে, যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছি আপনার ছেলের সংসার ছেড়ে । তারপরে যা ইচ্ছে করুন।
হতম্ভব মনোয়ারা কি বলবেন ভেবে পাননা। বৌমা সত্যি সত্যি একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে বাচ্চারাও স্কুলে চলে গেল।
একা মনোয়ারা কি করবেন ! বাচ্চারা ফিরে কি খাবে ভাবছেন। রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন বুয়া রান্না রেডি করেছে। কি মনে করে উনি আজ নিজ হাতে রাঁধতে বসেন। মুরগি একটু ঝালঝাল করে কাঁঠালের বিচি দিয়ে। মুসুর ডালে আস্ত শুকনা মরিচ দিয়ে বাগার দিলেন। পোস্ত বাটা দিয়ে ঝিঙে রাঁধলেন। ছোট মাছের বাটি চচ্চড়ি। বেশি করে কাঁচামরিচ কুঁচি দিয়ে মাখোমাখো করে মৌরল্লা মাছ। একপিঠ ভেজে তেল কৈ, মনোয়ারার ছেলের খুব প্রিয়। বাচ্চারা বাসায় ফিরলে তাদের গোসল করিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। রাতে ছেলে’কে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন – বাবা, যাও বৌমাকে নিয়ে আসো। আমিতো কাল চলেই যাবো। বাচ্চাদের এই বয়সে বাবা মায়ের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। তুমি যাও বৌমার রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসো। মধ্যরাতে টের পান, ছেলে বৌ নিয়ে এসেছে। ফ্লাট বাসা এ ঘর ও ঘর প্রায় সব কথা না হলেও টুকরা টাকরা ভেসে আসে।
” তোমার মাকে আর এ বাসায় আনবে না। ” ” আচ্ছা ঠিক আছে। ” “মাসের টাকা এবার কমিয়ে দাও। এখানেই তো সাতদিন থেকে গেল। ” ” হুম, তাতো বটেই। চলো ঘুমাই। “ছোট একটা কথা কাটাকাটিও যেন শুনতে পান ” একেবারে ফজরের সময় ঘুম ভাঙে মনোয়ারার। নামায পড়েই তৈড়ি হয়ে নেন। কাজের মেয়েটি তাড়া দেয়। ছয়টায় বাস। গাড়ি আপনারে বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে, আবার সাহেব কে অফিসে নিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি করেন। মনোয়ারা বেগম ছেলের রুমের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বাসা থেকে বের হতে যান। রুম থেকে চিৎকার করে ছেলের বৌ চেঁচিয়ে বলে, টেবিলে গ্লাস চাপা দেয়া টাকা আছে, উনাকে নিয়ে যেতে বল!
মনোয়ারার চোখে এবার জল আসে। যাওয়ার সময় ছেলের মুখটাও একটু দেখা হল না। বাসে পুরোটা সময় চোখের পানি মুছতে মুছতে আসেন বড় আদরের ছেলে তার। ছেলের পরীক্ষার ফি দিতে গয়ে কানের মাকড়িটাও বেঁচেছিলেন তিনি। অথচ আজ ফেরার সময় ছেলের মুখটাও দেখতে পেলেন না। বাস থেকে নামতেই, হৈ হৈ করে অতীন এসে তাকে হাত ধরে নৌকায় তোলে। অতীনের কাঁধে ওর পাঁচ বছরের ছেলে গোপাল। ছেলেকে কাঁধ থেকে নামিয়ে অতীন বলে, নে ব্যাটা পন্নাম কর! আমগো আম্মা, শহর থাইকা নিজ গেরামে ফিরা আইছে। নৌকা ছাড়তে ছাড়তে অতীন বলে ‘ ও আম্মা, ভাইজান নি আপনেরে আইতে দিতে চায় না! তাই এত্তো দেরি করলেন তাইনা আম্মা!
আমরা তো ডরাই গেছিলাম আমগো আম্মা আর গেরামে না ফিরা আহে। চুপচাপ বসে শোনে মনোয়ারা। বহু আগে এই গ্রামে সে বৌ হয়ে এসেছিল। অনেক সাধ্য সাধনার পরে এক সন্তান তার। বটতলার নিমাই ঘরামীর কাজ করতো, সাত বছরের অতীন কে রাখে বউটা মরে যায় নিমাইয়ের। নিমাইয়ের ভাত রাঁধার কষ্ট দেখে, মনোয়ারার স্বামী তাকে বান্দা হিসাবে রেখে নেয়। নিজের ছেলে তখন ঢাকায় কলেজে পড়ে। তারপর থেকে অতীন মনোয়ারাকে আম্মা ডাকে। বহু চেষ্টা করেও ক্লাস ফাইভের বেশি পড়াতে পারেননি অতীন কে। বাপ মারা যাবার পরে জমিজমা সেই দেখাশোনা করে। ছোটখাটো কি একটা ব্যবসাও করে। পালটি ঘড় দেখে অতীনের জন্য বউ এনেছেন। সুশীলা বড় লক্ষ্মী মেয়ে। বড় গুছিয়ে ঘর করে সে। দেখেও ভাল লাগে। বাড়ি এসে চোখ জুড়িয়ে যায় মনোয়ারার, পুরো বাড়ি উঠোন সব লেপে রেখেছে সুশীলা। ঘাটে যাবার রাস্তায় নতুন ইট বিছিয়েছে। কাগজী লেবু গাছে ফুল ধরেছে। কি মিষ্টি, কি পবিত্র চারদিকে। সুশীলা এসে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে।
” মা, তুমি বুঝি শহরের শিক্ষিত বৌমার আদর পেয়ে, তোমার এই মেয়েকে ভুলে ছিলে! চোখ জলে টলমল করছে। সুশীলাকে বুকের কাছে টেন আনেন মনোয়ারা। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অতীন ফেরেনি। এদিকে আকাশে মেঘ। আজ আসলে খুব করে বকবেন। মনে মনে ভাবেন মনোয়ারা। মেঘ ডাকছে, এই বুঝি বৃষ্টি আসে। কি জোড়ে একটা বাজ পড়লো ! দৌড়াদৌড়ি করে হাঁসগুলো তুলছে সুশীলা। ঠিক তখনই বাড়ি ঢোকে অতীন। হাতে জোড়া ইলিশ। সুশীলা দৌড়ে গিয়ে হাতে নেয়। ” এক্কেবারে জোড়া ইলিশ! অনেক দাম না! ” অতীন হেসে বলে “পুরা হাপ্তা পরে আম্মা আইছে আমার তো মন চায়, পুরো বাজারডাই তুলে নিয়া আসি। যা যা দিগ করিস না। বটি আন, আম্মা মাছ কাটবে, আমি দেখবো। ”
বারান্দায় বসে মাছ কাটছেন মনোয়ারা, বৃষ্টি নেমেছে। অতীন বৃষ্টিতে ভিজছে আর গান গাইছে ” মায়ের মত আপন কেহ নাই, মা জননী নাইরে যাহার এই ভুবনে তাহার কেহ নাই রে। ” এদিকটায় বৃষ্টির ছাঁট কম আসে। মনোয়ারা ইচ্ছে করে একটু সরে বসলেন। বৃষ্টির জল থেকে যেন অন্য কোন জল আলাদা না করা যায়। সত্যিই কি তাই! বৃষ্টির জল কি সব জল কে এক করতে পারে ! মেঘের জল আর মনে জমে থাকা কান্নার জল, সব কি এক রঙেরই হয়!