অবহেলা

অবহেলা

আজকে হাসপাতাল থেকে আসার সময় আমার পাশে একটা পনেরো ষোল বয়সী বছর বয়সী মেয়ে বসলো । মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি ছোট খাটো একটা চমক খেলাম । এরকম মিষ্টি চেহারার মেয়ে মনে হয় রূপকথার গল্পতে হয় । কিছুক্ষনের জন্য মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার একটু হিংসে হলো । আমি কেন যেকোনো মেয়েরই হিংসে হবে । আমি আড় চোখে ভালো করে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছি । আমার এত কৌতুহলের কারণ মেয়েটার সাথে আমার ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে । আচ্ছা মেয়েটা কোথায় গিয়েছিলো কিছু কি জিজ্ঞেস করবো ? মেয়েটা একদম চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে ।

আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে । এরকম একটা মেয়ে বড়দের মত আচরণ করলে কেমন যেন লাগে । আমার নিজের মধ্যেও বেশ ছটফটানি ভাব আছে । আর এই মেয়ে এরকম কেন ? এই বয়সী মেয়েদের এত গম্ভীর ভাব মানায় না । জড়তা ভেঙে মেয়েটাকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম । ” নাম কি তোমার মেয়েটা একটু চমকে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো , ” এলিজা বাহ ! খুব সুন্দর নাম তো । আর আমার নাম হাবিবা । কোন ক্লাসে পড়ো তুমি ? নাইনে  গুড , কোথায় গিয়েছিলে ? আম্মু আর ভাইয়ার সাথে হাসপাতালে  অহ কে অসুস্থ তুমি ?” হ্যাঁ কি হয়েছিলো ?

” আমার গলা ব্যথা আর জ্বর , ডাক্তার ঔষুধ দিয়েছে আর সাথে কি যেন টেষ্ট করাতেও বলেছিলো কিন্তু সেটা করাতে পারিনি ” করাও নি কেন ? আমারও গলা , কান ব্যথা ছিল টেষ্ট করার পর টনসিল ধরা পড়েছে ” এই পর্যায়ে মেয়েটা চুপ করে রইলো । আমি উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম , ” শোনো অসুখ বিসুখ নিয়ে অবহেলা করবে না “মেয়েটা আবারো চুপ করে রইলো । আমি আর কিছু বললাম না । বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে । মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টির কণাগুলো এসে গালে ছুঁইয়ে দিচ্ছে , ভীষণ ভালো লাগছিলো । আমি পার্স থেকে ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড ঘুরতে লাগলাম ।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি মেয়েটির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে । আশেপাশের মানুষজন মেয়েটার দিকে বারবার আড় চোখে তাকাচ্ছে । মেয়েটা মনে হয় এসব খেয়াল করলো । তাই দ্রুত চোখের জল মুছে নিলো । কিন্তু আবারো মেয়েটার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো । যেন মেয়েটা খুব চেষ্টা করেও কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না । দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো । মনে হচ্ছে ওর কষ্টটা যেন আমিও উপলব্ধি করতে পারছি । আমি আকাশ পাতাল ভাবতে শুরু করলাম এতটুকু একটা মেয়ের কি এমন কষ্ট থাকতে পারে । প্রেম টেম করে না তো আবার ? ছি ছি এসব আমি কি ভাবছি । কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে এসব ভাবাটা অন্যায় । তারচেয়ে ভালো হয় মেয়েটাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি । এলিজা কি হইছে তোমার , কাঁদতেছো কেন ? মেয়েটা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো , ” কিছু নাহ , এমনি ” তোমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে আমাকে বলতে পারো । কারো সাথে কিছু শেয়ার করলে কষ্ট কমে যায় । তোমার ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না ”

মেয়েটা বেশকিছুক্ষন চুপ থেকে বললো , ” আমি কি তোমাকে আপু ডাকতে পারি ? ” ” হ্যাঁ অবশ্যই পারো ” ” জানো আপু আমার খুব কষ্ট হয় আমার কেন একটা আপু নেই ” ” তুমি আমাকে আপু ডেকো । আচ্ছা তোমার মা আর ভাইয়া ওনারা কোথায় ? ” এলিজা পিছনে ঘুরে হাত উচু করে বললো , ” ওইযে মা আর ভাইয়া । সিট ফাঁকা ছিল না বলে পেছনে বসেছেন ” পিছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের চার সিট পরে সুন্দরমত একজন মহিলা আর একটা আঠারো উনিশ বছরের ছেলে পাশাপাশি বসে আছে ।” ওয়াও এলিজা ! তোমার মা তো দেখতে একদম তোমার মতন । আই মিন তুমি দেখতে একদম তোমার মায়ের মতো হয়েছো । ” হ্যাঁ সবাই বলে ”

এলিজা কথা বলছে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে । যাক মেয়েটা এখন তো একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে । কিছুক্ষণ আগে মাত্র মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়েছে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কতদিনের ঘনিষ্ঠ আমরা । অবশ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে যে কারো সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে ।আমি স্মিত হেসে জবাব দিলাম , ” তোমায় তো তাহলে তোমার মা খুব ভালোবাসেন ” এলিজার মুখটা কালো করে সাথে সাথে মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ালো । আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম । মেয়েটা তখন ওইভাবে কেন কাঁদছিলো । হয়তো এলিজাকে ওর মা বকা টকা দিয়েছে । তাই মুখ গোমড়া করে রেখেছে । এইজন্যই বোধহয় মায়ের সাথে বসে নি । আমি আর তাই বিষয়টাকে পাত্তা দিলাম না ।

এলিজা এবার নিজে থেকে প্রশ্ন করলো , ” তুমি কোথায় থাকো আপু ? ” নারায়ণগঞ্জ থাকি এলিজা , তোমরা ? ” শনি আখড়া আপু কখনো যদি যাও তাহলে আমাদের বাসায় যেতে হবে কিন্তু । বাস থেকে নামার আগে আমি তোমাকে ঠিকানা লিখে দিবো । ” আচ্ছা দিও , কিন্তু এলিজা হাসপাতাল আসলে টেষ্ট করালে না কেন সেটা বললা না তো ? ” এলিজা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালো । একদম নিচু স্বরে বললো , ” মা করাতে চায় না ” ” সেকি কেন ? ” ” মা বলেছে এত টাকা দিয়ে টেষ্ট করাতে পারবে না ” শুনে আমার একটু খারাপ লাগলো । আমি মাথায় হাত রেখে বললাম , ” মন খারাপ করো না , হয়তো টাকার প্রবলেম দেখো পরে করিয়ে নিবে ”

এলিজা হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো । আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম । লক্ষ করলাম মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে । আমার বুকের ভিতরে কেমন জানি একটা চিনচিনে ব্যথা হতে লাগলো । ” কি হয়েছে এলিজা , গলা ব্যথা করছে ? তোমার মাকে ডাকবো ?
এলিজা অস্ফুট স্বরে বললো , ” না না প্লিজ মাকে ডেকো না । মা দেখলে বকা দিবে । মা আমাকে একটুও ভালোবাসে না । আমার অসুখ হলেও মায়ের কিচ্ছু যায় আসে না “” ভালোবাসে এলিজা , তুমি হয়তো বুঝতে পারো না । প্রথিবীর সব মায়েরাই তার সন্তানকে প্রচন্ড ভালোবাসে । কিন্তু তারা সেটা প্রকাশ করে না । বাবা মায়ের ভালোবাসা সবসময় সন্তানেরা উপলব্ধি করতে পারে না ” এলিজা উঠে বসতে বসতে বললো , ” ঠিকই বলেছো আপু , মা আমাকে ভালোবাসে আর আমিই হয়তো বুঝি না । জানো আপু আমার জ্বর হয়েছে বলে মায়ের সাথে কোনো কাজকর্মে সাহায্য করতে পারি না বলে মা খুব বকাবকি করে । ”

আমি অবাক হয়ে বললাম , ” তুমি কাজ করতেও পারো ? ” হ্যাঁ অল্প সল্প পারি । ” জানো বাবা ছাড়া আমাকে আর কেউ সাপোর্ট করে না । আমার যে জ্বর হয়েছে বাবা বলেছে বলেই মা আমাকে হাসপাতাল নিয়ে এসেছে । হয়তো টেষ্টও করাতো কিন্তু তাহলে ভাইয়ার জন্য জুতা কিনতে পারতো না এইজন্যই করায় নি । ”

আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না । মানুষ এত পাষাণ হয় কি করে ? টেষ্ট করানোর থেকে জুতা কেনা অবশ্যই বড় নয় । ছেলে যদি ওনার হয় মেয়েও তো ওনারই । এলিনা হাসিমুখে বললো , ” তুমি সত্যি বলেছো আপু , কারো সাথে কিছু শেয়ার করলে কষ্টটা আসলেই কম হয় । তুমি যদি সত্যি আমার বোন হতে খুব ভালো হতো । আমাদের বাসার আশেপাশে গল্প করার মত কেউ নেই তাই সারাক্ষণ একা একাই থাকতে হয় । ”

এতক্ষন এক ধ্যানে এলিজার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম । আমার যেন কিছুতেই এলিজার কথাগুলো বিশ্বাস হতে চাইলো না । পৃথিবীতে কি এরকম কোনো মা আছে যে নিজের সন্তানকে এতটা অবহেলা করে ? হয়তো আছে , কিন্তু আমরা জানিনা । এই রহস্যময় পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি । তবে যেসব বাবা মা তাদের সন্তানদেরকে অবহেলা করেন তারা একদমই ঠিক করেন না । ওইসব সন্তানদের ভবিষৎ নিয়েও অনেক ঝুঁকি থাকে । দুনিয়ার সকল মানুষ অবহেলা করলেও বাবা মায়ের অবহেলা কোনো সন্তানই সহ্য করতে পারে না ।

আমি কিছু বলার আগেই হেলপার শনি আখড়া বলে হাক ছাড়লো । এলিজার আম্মু আর ভাই বাস থেকে নেমে যাচ্ছে । এলিজাও তাদের পিছু পিছু নামছে । মহিলা একবারও এলিজার দিকে তাকালেন না । এলিজা পিছনে আছে কি নেই মহিলার সেই খেয়ালটুকুও নেই । এর মধ্যে বার কয়েক মেয়েটা পিছনে তাকিয়ে আমাকে দেখলো । বাস থেকে নামার আগে এলিজা আমাকে হাত ইশারা করে বায় বায় বললো । আমিও হাত ইশারা করলাম আর মনে মনে বললাম ভালো থেকো এলিজা । তোমার মত মিষ্টি একটা মেয়েকে আল্লাহ আমার বোন বানিয়ে পাঠালে কি হতো ? হঠাৎ আমার বা চোখে জল আবিষ্কার করলাম । ওইটুকু জল মুছতেই আবিষ্কার করলাম সব বাঁধ ভেঙে চোখের জল যেন উপচে পড়তে চাচ্ছে ।

পুরো রাস্তা আমার শুধু এলিজার কথা মনে পরে ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো । ওকে ফোন নাম্বারটা ও দেওয়া হলো না । আচ্ছা এলিজার সাথে কি আমার আর কোনোদিন দেখা হবে ? যদি দেখা হয় এলিজা কি করবে ? দৌড়ে এসে কি আমাকে আপু বলে জাপটে ধরবে ?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত