প্রকৃতির রং বদলায়,মানুষের বদলায় মন।মুনীর চৌধুরী বলেন,“মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায় বদলে যাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।সর্বদা বদলে যেতে কোন কারণ লাগেনা। প্রকৃতির গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় এমনিতেই বদলে যায়।
“যা ঘটেছে তা গ্রহণ করাই দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম ধাপ।” – উইলিয়াম জেমস কিন্তু দুঃখবিলাসী মানুষগুলো বদলে যাওয়া মানুষটির মায়ার মোহে পড়ে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেন না।আর তাই তাঁরা অভিযোগ তুলেন। প্রশ্ন তুলেন।স্বার্থপরের মতো প্রিয় মানুষটি এভাবে বদলে না গেলেও তো পারতো?কেন এমনটা করলো?একটুও কি মনে পড়ে না?এসব ভেবে অামরা বোকার মতো শোকাহত হয়ে পড়ি।
এসব হলো চলে যাওয়া মানুষটির মায়ার মোহে পড়ে নিজের দুর্বলতা,এখনে “সেই তুমি কেনো এত অচেনা হলে….” এ গানের লিরিক এর মতে নয় “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না অাসে তবে একলা চলো রে..” রবি ঠাকুরের এ গানের লিরিক এর মতো মনোভাব গড়ে তোলা উচিত। এখন প্রশ্ন হলো,আসলেই কি মানুষ হঠাৎ করেই বদলে যায়? অামার মতে নাহ!অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, হঠাৎ করে কিছু বদলায় না।মানুষের এই বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরেই চলতে থাকে।এত ধীরে ধীরে চলতে থাকে যে, আমরা বুঝতে পারিনা।
কখন, কিভাবে, মানুষগুলো বদলাতে শুরু করে ,তা হয়তো সে নিজেই জানেনা। পরিবর্তন আসে কখনো সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে,কখনো প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্হিতিতে পড়ে,কখনোও বা স্বীয় স্বার্থে বা চাহিদার কারণে।মানুষের স্বপ্ন ভেঙে গেলে যেমন বদলায় তেমনি স্বীয় স্বপ্ন পূরণেও বদলে যেতে পারে।অাবার কথায় অাছে,”গিরগিটি রং বদলায় আত্মরক্ষার জন্য।আর মানুষ রং বদলায় স্বার্থরক্ষার জন্যে।।”শুনতে তিক্ত হলেও এরকমটাই বেশিরভাগ ঘটে।
কারণ যাই হোক, বদলে যাওয়া … একজনের জন্য মঙ্গলকর হলেও,অন্যের জন্য তা হয় ভীষণ পীড়াদায়ক। ধরুণ,এক সময় যে মানুষটার সাথে অাপনার দিন রাত কথা হতো,নিজের খুঁটিনাটি তুচ্ছ ব্যাপারেও শেয়ার করতেন,নিজেকে খোলা বইয়ের মতো করে নিজের ব্যাপারে তাঁর সহিত বকবক করতেন,একদিন তাহার সহিত কথা বলতে না পারলো মনে হতো অজস্র সময় পিছিয়ে যাচ্ছে,যার সুখে অানন্দিত এবং দুঃখে ব্যাথিত হতেন।এবং সেও নিয়মিত খোঁজ খবর নিতো।এমনকি অাপনি যেন তাঁকে ভুলে না যান সে ভয় করতো এমনই একজন যদি হঠাৎ করে বদলে যায়,পূর্বের মতো যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এমনকি বদলে যাওয়ার কারণটি বলতেও অনিচ্ছুক হয়।
অাবার এরকমও হতে পারে যে,অাপনার পূর্বে করা এমন কিছু ভুল যা করা উচিত ছিলো না হয়তো অনিচ্ছায় অভিমান করে করেছেন কিন্তু কিছুদিন পর তা নিজেরই মনে নেই এমনই কারণ ধরে কিছু না বলেই বদলে যায়।এবং অাপনার সহিত বিরূপ অাচরণ করতে শুরু করে,তখন কেমন লাগবে?
নিশ্চয়ই মর্মাহত,ব্যথিত হবেন এবং বিষয়গুলো ভীষণ পীড়াদায়ক হয়।
যারা এরকম কোনো মানুষকে বিনা অপরাধ বা ছোটখাটো কারণে এভাবে কষ্ট দেয় এবং অপরকে কষ্ট দেওয়ার অন্যান্য কারণ যাতে অপরজন কষ্ট পায় তাঁদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আহজাবের ৫৮নং আয়াতে এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন নর-নারীদের কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। উক্ত অায়াত দ্বারা বোঝা যায়,কারও মনে গুরুতর কারণ ছাড়া কিংবা যেখানে স্বাভাবিক অাচরণ করলেই অপরজন কষ্ট পায় না তবুও কষ্ট দেওয়া অনুচিত।ইসলামী দৃষ্টিতে অপরকে কষ্ট দেওয়া জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।এটি হীনম্মন্যতা বিশেষ।
কিছু মানুষের মন অাসলে স্কুইড বা অক্টোপাসের মতো যা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয় কিংবা অাষাঢ় মাসের মতো এই মেঘ এই বৃষ্টি এরকমটা হয়ে থাকে।এক জৈনিক দার্শনিক বলেছেন,”অামরা সবথেকে বড় বোকামি করি মানুষের মন বুঝতে গিয়ে।যেখানে কিনা একটা ক্ষুদ্র পিপীলিকার জীবন রহস্য পুরোপুরি বুঝতেই দুবার জন্মানো দরকার,সেখানে কিভাবে পৃথিবীর সবথেকে জটিল জিনিস স্বল্প সময়ে বুঝতে চাই।”
মনের সচরাচর বাস কোথায়? কেউ কি বলতে পারে? বেদ অনুযায়ী মনের আসক্তি যদি কেবল সংসারে হয়, তবে মনের বাস কোথায়? মহাবিশ্বের বাস যদি মনে হয়, তবে মনের বাস কোথায়? কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ তার মনের বিস্তার দেখেছিলেন অসীম শুন্যে। বিদ্রোহী নজরুল তার দ্রোহী মনের রঙ রাঙিয়ে গিয়েছিলেন পলাশ জবা অশ্বথের বনে। লালন বলেন, “মন তোর আপন বলতে কে আছে?”
প্রিয় মানুষগুলো হঠাৎ করেই বদলে যায়।সুখের মুহূর্তগুলো হঠাৎ করেই নাগালের বাইরে চলে যায়।পড়ে থাকে স্মৃতিগুলো যা চাইলেও ভোলা যায় না।তবে যারা স্বার্থপর ছলনাময়ী তাঁরা ঠিকই ভুলতে পারে নতুন কাউকে নিয়ে।ঐ যে একটা গান অাছে না,যখন তোমার কেউ ছিলো না তখন ছিলাম অামি,এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি অামি।অনেকটা এরকম প্রতিদিন আমি দেখি মানুষের বদলে যাওয়া,দেখি কি বিচিত্র কারণেই না সম্পর্ক বদলে যায়। এসব উপলব্ধি করার ব্যার্থ চেষ্টা করি, কারণে অকারণে এসব ভেবে অামি বিষণ্ন বায়োলিন হয়ে যাই, নিরার্থক এসব ভেবে চিন্তার জগৎ এ ডুব দেই, মনের জানালাই নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়,কেন এমনটা হয়?কারণ খুঁজতে গিয়ে শতবার নিরাশ হই- তবুও মানুষের রং বদলের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাই না। জীবন এমনই । বড় রহস্যময়। সব রহস্যের সমাধান পৃথিবী আজো করতে পারেনি। পারবেও না।
তবে যতযাই বলি,দিনশেষে বদলে যাওয়া প্রিয় মানুষটির প্রতি অজান্তেই মনের জানালায় প্রশ্ন জাগে,”ওগো এমন ভাবে বদলে না গেলেও তো পারতে।” “কিছু বিষয় থাকে যেখানে আমরা নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারিনা, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়। কিছু সময় থাকে যেখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করাই সবচেয়ে বড় সমাধান।” – ডেনিস ডীডারট
আমরা যা পছন্দ করি না বা চাইনা তা মেনে নেয়া সত্যিই অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।তবুও আমাদের জীবনে অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে।তা মেনে নিয়ে সেগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া এবং পরিবর্তন কে ইতিবাচক ভাবে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ ।
সকলের জীবন সুখী হোক এবং সকলে যেন সব পরিস্থিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এবং নিজের বদলে যাওয়ায় যাতে কাছের অপর মানুষ কষ্ট না পায় এই কামনা ও দোয়া করছি। শেষ করছি ডঃ এ পি জে আব্দুল কালাম এর উক্তি দিয়ে-“আমি যা পরিবর্তন করতে পারবো না আমি তা গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।” – এ পি জে আব্দুল কালাম।