নেওয়াজ আলী জমি চাষের জন্যে মাটি খুরছিলো। হঠাৎ তার কোদাল মারতে যাবে চোখের সামনে ধাতুর তৈরী কোন কিছু নজরে পড়লো কিন্তু কোদাল ততক্ষণে চালিয়ে দিয়েছেন! আর সেই ধাতুর তৈরী জিনিসটা গায়ে লেগে কর্কশ এক শব্দের সৃষ্টি হলো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখলো কিনা! চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কাউকেই দেখতে পেলেন না! ভাবলেন কোন গুপ্তধনই হবে!
কোদালের আচরে কিছু মাটি সরিয়ে নিশ্চিত হলেন এটা একটা ধাতুর কলসি! আর ধাতুটা যে পেতল তা বুঝতে পারলেন কোদালে কেটে কলসির খানিকটা চকমক করছে দেখে ! হঠাৎ দেখে মনে হয় সোনার কলস! কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় সেটা পেতল! কি করবেন এখন নেওয়াজ আলী? তা ভেবে ঠিক করতে পারছেন না! কতক্ষণ চুপ করে চিন্তা করলেন সেখানে বসে! এখন যদি সেটা তুলতে যান তবে জমির মালিক এসে পড়লে সেটা তাকে দিয়ে দিতে হবে! এটা সে মেনে নিতে পারবে না! তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে সে এটা দেখতে পেয়েছে! কেন তবে সে এটা জমির মালিক কে দিতে যাবে?
নিজের মন কে সে নিজে বোঝাতে লাগলো! কিন্তু মন তাকে বলছে তোর তো জমিন নয়! কেন তবে তুই এটা ভোগ করার চিন্তা করছিস! কিন্তু সে মনকে আচ্ছা করে শাসন করে! জমি তার নয়তো কি হয়েছে গুপ্তধনটা তো সে পেয়েছে! তবে সেটা কেন সে নেবেনা! কারো জমির উপর কেউ যদি পড়ে থাকা অনেকগুলি টাকা পায় তবে কি সেটা জমির মালিক কে গিয়ে দিয়ে আসবে? কেউ কি দেয়? সারাজীবন অনেক মেহনত সে করছে পরের জমিতে! আজ সেটার পুরস্কার সে পেতে যাচ্ছে! তাও বেয়াহায়া বেয়াড়া মনটা বাঁধা দিতে চায়! শুনবে না কোন কথা সে! নিজের মনকে সে তার বসে নিয়ে আসে। এখন সে ভেবেই চলেছে কি করা যায়? এমন সময় দেখতে পেল জমির মালিক তদারকি করতে আসছে তার কাছে! তড়িঘড়ি করে সে কলসের মুখের উপর মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয়! এবং সেই জায়গায় সে বসে পড়ে!
জমির মালিক কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কি রে কাজ রেখে বসে আছিস যে বড়ো? নেওয়াজ আলী আমতা আমতা করে বলে, মন্ডল সাব! শরীরটা খুব ভালো নেই! খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম! মন্ডল সাব তার কথায় খুব একটা খুশি হতে পারলেন না! বললেন, তোদের কামলাদের এই এক স্বভাব ছুতো পেলেই কাজে ফাঁকি দেওয়া চাই! বিঁড়ি খাবার ভাব করে ১ ঘন্টা, প্রস্রাব করার কথা বলে আধ ঘন্টা এএই হলো তোদের এক স্বভাব! আরে পয়সা যখন নিবি কাজ করে হালাল করে নে। তা শরির যখন ভালো নেই তখন কাজে আসার কি দরকার ছিল? না! না! আমি সেই রকম নই ! কাজে কখনো ফাঁকি দেই না! হ্যা সেই জন্যই তো তোকে কাজে রাখলাম কিন্তু এখন দেখি সব রসুনের একই গিট!
নেওয়াজ আলী অনুনয় করে বিনয়ের সাথে বলে, আমি রাত হলেও আপনার কাজ করে দিয়ে যাবো! তবুও আপনি রাগ করবেন না! নেওয়াজ আলীর মনে ভয় এখন যদি জমির মালিক তাকে জমি থেকে রাগ করে উঠিয়ে দেয়। তবে বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে তার! মন্ডলের অনেক রাগ ! রাগ করে অনেক কামলা কে সে কাজের মধ্যে থেকে তুলে দেয়!
সে কাজ ভালো করে দেখে তাকে উনি একটু আলাদা চোখে দেখেন এই যা ভরসা! এখন যদি তার জায়গায় আরেক কামলা এনে কাজ করায় তবে সব শেষ! মন্ডল সাব বললেন, ঠিক আছে শরীর নিয়ে কথা! কাজ করে যা, যাবার সময় বেতন নিয়ে যাস! নেওয়াজ আলী মনে মনে বলে, তোর কাজের নিকুচি করি আজ এই গুপ্তধন নিয়ে যেতে পারলে আমার চেয়ে ধনী এ গাঁয়ে আর কে থাকবে? তখন তোর কয়টা কামলা আমার থাকবে!
মন্ডল চলে যায়! সে আস্তে আস্তে কাজ করে,যায়! কাজের প্রতি তার মন কি আর আছে? মন তো পড়ে রয়েছে মাটির তলায় পেতলের কলসির কাছে! আবার চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখে কেউ আছে কি না? নাহ কাউকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না! ভাবে কলসিটা তুলে কলাগাছের ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রাখবে, পরে রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন সময় বুঝে নিয়ে যাবে! এখানটা প্রায় সব সময় নিড়ব থাকে লোকজন বেশি একটা আসে না। শুধু জুয়াচোর কয়েকটা বাজে ছেলে ছাড়া! তাও ওদের উৎপাত এখন কম পুলিশের ভয়ে! পুলিশ ইদানীং কয়েকটাকে ধরে নিয়ে গেছে তাই ভয়ে বাকি গুলো ঘাপটি মেরে রয়েছে!
ওদের এখানে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে! পুনরায় চারদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে কলসটা খুঁড়ে উঠানোর কথাই ভাবলো। সেই উদ্দেশ্যে খুঁড়তে শুরু করেছে এমন সময় হইহই হট্টগোল করে বখাটে ছেলেদের দলও এসে জুটলো! তারাতাড়ি আবার অর্ধেক বের করা কলস মাটি চাপা দিয়ে দিলো! ভাবলো যা কপালটাই মন্দ! শালারা আসার আর সময় পেলনা! বেছে বেছে এই সময় এসে জুটলো আমার কপালে! এখন নেওয়াজ আলী ওদের দিকে নজর রাখে আর আলতো করে কোদাল চালায়! কাজ থেকে তার মন কখন উঠে গেছে! কিন্তু কি আর করা কলসি না নিয়ে সে তো যেতে পারছেনা!
বখাটে ছেলেদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে উঠে এসে তার নিকট দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে , কি ব্যাপার নেওয়াজ ভাই? সে চমকে উঠে বলে, কি আর ব্যাপার হবে! ছেলেটার নাম গোপাল! নওয়াজ আলী বলে, কেন কি হয়েছে? গোপাল বলে, তোমার মনটা কি খারাপ? কাজে দেখছি মন নেই শুধু এদিক সেদিক তাকিয়ে কি যেন ভাবছো! নাহ কিছু না! যা নিজের চরকায় তেল দে! বাহ রে নওয়াজ আলী ভাই তোমার দেখি সত্যি কিছু একটা হয়েছে! কথা বার্তা কেমন কঠিন স্বরে বলছো! নওয়াজ বলে,যা তো ভাই বিরক্ত করিসনা ” গোপাল হেসে বলে, কি ভাবীর সাথে ঝগড়া করে আইছ নাকি?
হু করলে তোর কি রে ছেমড়া! আমার বউয়ের সাথে ঝগড়া করি আর আদর সোহাগ করি সেটা নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে! যা এখন চোখের সামনে থেকে! জ্বালাতন করিসনা! গোপাল বলে, তোমার তো কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই নয়লে এমন ব্যাবহার তুমি করছো আমি মানতে পারছি না! এই তোদের না পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল! ছাড়িয়ে আনলো কোন আহাম্মকে! যাচ্ছি! যাচ্ছি এতো রাগ দেখিয়ো না। গোপাল চলে যাবে এমন সময় ওর চোখ মাটি থেকে বেড়িয়ে থাকা কালো হয়ে যাওয়া পেতলের কলসের কিঞ্চিৎ দেখতে পেল! ও তৎক্ষনাত বললো, নওয়াজ ভাই ওটা কি দেখা যাচ্ছে? মাটি থেকে বেড়িয়ে আছে! উঠাও তো দেখি কি জিনিস? নওয়াজ আলী তারাহুরো করে মাটি দিয়ে কলস ঢাকতে গিয়ে খেয়াল করেনি যে কলসির খানিকটা বেড়িয়ে আছে! সে গোপাল কে এক ধমক দিয়ে বলে, এই আমি কি তোর কামলা!
যে তোর কথা মতো কাজ করতে হবে? গেলি এখান থেকে এই বলে সে কোদাল উঁচিয়ে ধরে! গোপাল দৌড়ে দূরে গিয়ে বলে, ভাবীকে আজ বলবো, তোমার সাথে যেন আর ঝগড়া ঝামেলা না করে, কেমন? এএই বলে বখাটে ছেলেদের দলও হেসে উঠে! নওয়াজ আলী ভাবে এখন কি করবে এরা না গেলে তো দেখছি কিছুই করতে পারবোনা! ওদের দেখিয়ে সে কাজের ভান করে কিন্তু কাজের চেয়ে চিন্তাই বেশি!