সৎ মা

সৎ মা

বউ মারা যাওয়ার চল্লিশ দিনও হয়নি তার আগেই নতুন বউ নিয়ে হাজির সামাদ মিয়া। যুবতী একটা মেয়ে, বয়স উনিশ কী বিশ হবে । অথচ তার মেয়ের বয়স চৌদ্দ চলে। নতুন বউ নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে সামাদ মিয়া। মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান খেয়ে জাবর কাটছে। মুখের কোনে রঙিন হাসি।

– হাসু,,, ঐ হাসু তোর নতুন মারে ঘরে তোল । আর কতক্ষণ উঠানে দাঁড়ায় থাকবো?

হাসু দরজার দাঁড়িয়ে দেখতে পায় তার বাপজান বউ সাজে এক মেয়েকে নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটা কেন যেন সে সহ্য করতে পারেনা, নিজের অজান্তেই চোখ ছলছল করে উঠে । বাবজানের পাশে সে নিজের মাকে দেখে সবসময় অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর এত অল্প দিনের ভেতর তার বাপজান আবার বিয়ে করতে পারে সেটা তার কল্পনার অতীত।

– কি হইলো, ডাকি কানে যায় না ?  হাসু কোন কথা বলেনা, রাগে তার দাঁত কটমট করে উঠে। এবার ঘরের ভেতর চলে যায়। বাঁশ কাটার দা নিয়া দরজার সামনে আবার দাঁড়ায়।

– এই ঘর আমার মায়ের, এই ঘরে আমি আর কাউরে ডুকতে দিমু না। হাসুর হাতে দা দেখে সামাদ মিয়া কিছুটা চুপসে যায় কিন্তু পরক্ষণেই মেজাজ চরে উঠে ।
– কী এত বড় সাহস তোর, তুই দাও দিয়া আমারে ভয় দেখাস। তোর একদিন কী আমার একদিন, এ কথা বলেই সামাদ এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু পেছন থেকে তার বিয়ে করা নতুন বউ আছিয়া হাত টেনে ধরে।
– থাক পোলাপান মানুষ, এত কিছু বুঝে না, চলেন আমরা অন্য ঘরে যাই।

চোখ লাল লাল করে সামাদ তার নতুন বউকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। আর হাসু দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বিয়ে না করে অনেক পুরুষ ত্রিশ বছর থাকতে পারে কিন্তু বিয়ের পরে ত্রিশ দিনও বউ ছাড়া থাকতে পারে না । এটা যেন অনেক পুরুষদের বেলায় অঘোষিত নিয়ম। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই, আঁধার নেমেছে চারিদিক। আর আধার নেমেছে হাসুর বুকে,কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে একাকার । হাসু হারিকেন হাতে তুলে নেয়, এগিয়ে যায় মায়ের কবরের পাশে, সামান্য পরিমান ভয় তাকে স্পর্শ করে না। আবার মায়ের কবর জড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর মায়ের কাছে পৌঁছে দেয় তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের খবর। সকাল হতেই নতুন মাকে হাসু আবিষ্কার করে পাকের ঘরে রান্নার জোগার জ্যান্ত করছে।

– কি ও বেটি, মন খারাপ ? মন খারাপ কইরাই বা কী হইব। তুমি মনে করছ ঐ বুইড়া বেটারে আমি ইচ্ছা কইরা বিয়া করছি ? মোটেও না। বাপজান আমারে জোর কইরা বিয়া দিছে। মেলা ডাংগর হইছি কিন্তু যৌতুকের লাই কেও বিয়া করতে চায় না, আর গায়ের রঙ ও তো ধলা না যে রাজ পুত্তুর আইসা আমারে বিয়া করব। তাই বুইড়া বেটার গলায় ঝুইলা পরছি। তয় মন খারাপ কইর না। আমি তোমাকে কষ্ট দিমু না, আমিও মা মরা মাইয়া। আমি মায়ের কষ্ট বুঝি । ভেতরে আইস। না, তবুও হাসু ভেতরে যায় না। মন খারাপের ভাব এখনও তার মন থেকে কাটেনি। তবে তার মনে হয় মানুষটা খুব বেশি খারাপ না। সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয় কিন্তু হাসু এখনও মুখে খাবার তোলেনি, এমনকি রাতেও খায়নি । সে তার মায়ের ঘরে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে। কিন্তু কারো পায়ের শব্দে সে চমকিত হয়। দরজার সামনে ভাতের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছিয়া।

– তোমার ঘরে কী একটু আইতে পারি মা ?  হাসু না বলতে চেয়েছিল কিন্তু কেন যেন মুখ দিয়ে কথাটা আসে না।
– আহেন
– তুমি তো গতকাল থাইকা এহনো কিছু খাইলা না। এই নাও ভাত কয়ডা খাইয়া লও। তুমি কইলে আমি এই বাড়ি থেকা চইলা যামু। তবে কই যামু জানি না। বাপে বাড়িতে জায়গা দিত না। তাও তুমি আমার উপর রাগ কইরা না খাইয়া থাইকো না। ভাত রেখে চোখের পানি লুকিয়ে আছিয়া চলে গেছে। আর হাসু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভাত গুলো গিলছে অনেক কষ্টে, অনেক যন্ত্রনায়। বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় হাসু ঘরের পিরায় বসেছিল, তার দৃষ্টি ছিল দূর আকাশে, আর ভাবছিল মায়ের কথা কিন্তু পেছনে কে যেন এসে বসলো

– মাথাটার অবস্থা দেখছ ? কয়দিন ধইরা চুলে তেল দেও না বেটি ? চুল তো এক্কারে পাখির বাহা বানায় ফেলছো।
আহ মাথায় তেল দিয়া দেই। অনুমতির অপেক্ষা না করে আছিয়া হাসুর মাথায় তেল দিতে থাকে। তারপর চিরুনি দিয়ে আঁচড় কাটে। সুন্দর করে বেনি করে দেয় মাথার চুল।

– শোন মাইয়া সব সময় মন ভার কইরা রাখবা না। হাসি খুশি থাকবা। তোমার নাম নাকি হাসু? তো হাসুর মুখে হাসি নাই ক্যান? একটা ছড়া কাটি শোন । ‘গাছে উঠে গাছুনি, হাইয়ে ডাকে নাছুনি। হাইর আতো গামছা, হাইয়ে দেখে তামশা  এবার হাসু খিলখিল করে হেসে উঠে। দূর থেকে সামাদ মিয়া মেয়ের হাসি দেখা কিছুটা স্বস্তি পায়। আহারে কতদিন পর মাইয়াটা একটু হাসলো।

এভাবে তাদের দিন গুলো সুখে দুঃখে কেটে যায়। সৎ মায়ের যে আচরন সেটা কখনোই আছিয়ার মাঝে ফুটে উঠেনি। তবে হাসু কখনোই আছিয়াকে মা বলে ডাকেনি, এতে অবশ্য আছিয়ার কোন দুঃখ নেই। তবুও তো মেয়েটা তাকে মেনে নিয়েছে। আর সেও কখ‌নো হাসুুর মনে দুঃখ দেয়নি। কারণ সে জানে মেয়ে হয়ে জন্মান কতটা কষ্টের কতটা যন্ত্রনার। দেখতে দেখতে হাসু হাতে পায়ে বড় হয়ে গেছে। খুব বড় ঘর থেকে বিয়ের ঘর না এলেও একাবারে ফেলনার নয় সেগুলো । আছিয়ার এক কথা, আমার মাইয়ারে আমি ভালা জায়গায় বিয়া দিমু, দরকার হইলে ধানি জমি বেইচা দিমু, তবুও মাইয়া যেন সুখে থাকে। পাশের গ্রামের একাব্বর মাদবরের ছেলে খোরশেদের সাথে হাসুর বিয়ে ঠিক হয়। ছেলে ভাল, গঞ্জে দোকান আছে। টাকার কমতি নাই। সুখেই থাকব হাসু।

হাসুদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন, আজ হলুদ, কাল বিয়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে গ্রামের মহিলারা সুর করে গীত গায় কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে বাপ দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে। পরের দিন বিয়ের অনুষ্ঠানে, গ্রামের প্রায় সকলে দাওয়াত দিয়েছে সামাদ মিয়া। সবার আনন্দ করে খাচ্ছে। সামাদ মিয়ার সামান্য ফুছরত নেই। একটা মাত্র মেয়ে তার। গ্রামের সবাইরে না খাওয়াইলে হয়? বর এসে গেছে পোলাপান হইচই করে, কলা গাছ দিয়ে সাজানো গেটে ফিতা ধরে।

গীত থেমে গেছে, থেমে গেছে সকল আয়োজন। বিয়ে শেষে হাসুকে তার স্বামীর বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। এর ফাঁকে হাসু চলে গেছে মায়ের কবরের পাশে, সেখান থেকে তাকে আনা হয়েছে। এখন আছিয়ার বুকে মুখ লুকিয়ে হাসু চিৎকার করে কাঁদছে । আছিয়ার গা থেকে মায়ের গন্ধ ভেসে আসে হাসুর নাকে । কেন যেন আজ আছিয়াকে মা ডাকতে ইচ্ছে হয় খুব। শুধু যাওয়ার আগে একবার বলে যায়।

মা তুমি আমারে দেখতে যাইও, আর বাপজানরে দেইখা রাইখ। মা, ডাকে আছিয়ার বুক কেমন করে উঠে। দৌড়ে গিয়ে আবার হাসুকে বুকে টেনে নিয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। আজ যেন একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের বাঁধন তৈরি হয় । কিন্তু সে বাঁধন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। না চাইলেও হাসুকে বিদায় নিতে হয়। কারণ মেয়েরা মায়ের বুকে সারা জীবন থাকার অধিকার রাখে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত