ইফতির ডায়েরি

ইফতির ডায়েরি

আমাদের বিয়ের ২ বছর হয়ে গেছে। তনুর সাথে ঝগড়া হলেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। সেইটা যত রাতই হোক না কেন! অদ্ভূত কিচ্ছা কাহিনী নিয়ে আমাদের ঝগড়া লাগে দেরি করে বাসায় ফেরা নিয়ে। সময় না দেওয়ার জন্য। ঘুরতে না নেওয়ার জন্য।অনেক ছোট ছোট কারণ নিয়েই ঝগড়া লাগে।তাকেআমি সবসময় স্বাধীনতা দিয়েছি। সে একা ঘুরুক তা না, তার আমার সাথেই ঘুরতে হবে! ঘরে কোন কাজ করা লাগেনা। বুয়া আছে সে যাক বাইরে সে ও যেয়ে ঘুরে বেড়াক। না তো করছি না। এমন অদ্ভুত ভাবভঙ্গি করার কি আছে এসব নিয়ে? যেমন আজকের ঘটনা টা নিয়েই ভাবি। শেষ কয়দিন ধরে ওর সাথে কথা হয় না। ঝগড়া ঝাটির চেয়ে ভালো কথা না বলা। সে বলে সে আর অবহেলা নিতে পারছে না। না নিতে পারলো .. ছেড়ে চলে যাক।

ভালো লাগে না।এই বলতেই কান্না কাটি শুরু! মেয়ে মানুষ বড় অদ্ভুত! শুধু ঝগড়া করার কারণ খোঁজে আর চোখে যেন পানি লেগেই থাকে! আর আমি এইদিক দিয়েয়ে বের হয়ে গেলাম এসব নিয়ে ভেবে হাঁটতে হাঁটতে কোত্থেকে কই চলে এসেছি টের ই পাইনি। রাতের বাজে তখন ১.০৯  রাস্তাও খালি। একটা রিক্সা দেখতে পেলাম। ভাবলাম কিছুক্ষণ রিক্সায় ঘুরি। বললাম এক ঘন্টা আমাকে ঘুরাতে। রিক্সাআলা ছেলেটার ২৪/২৫ বছর হবে। খুব বেশি না। রিক্সায় উঠার পর খেয়াল করলাম তার কানে হেডফোন ..গান ও বাজছে। সে একটু হালকা হালকা করে গান ও গাইছে। খুব ফুড়ফুড়া মন। বিয়ের আগে আমার ও এমন ফুড়ফুড়া মন ছিলো। ওকে দেখে খুব লোভ লেগেছিলো পুরানো দিনের কথা মনে করে। নিশ্চয়ই আনমেরিড তাই এত সুখ মনে। ভাবলাম ওর কাছ থেকে সুখে থাকার কিছু টিপস্ নেই।

– তোমার নাম কি?
-( হেডফোন কান থেকে সরিয়ে)
ভাই, আমার নাম রাসেল।
-কই থাকো? বাসা কই?
– কাওরান বাজার বস্তিতে থাকি ভাই।
-আচ্ছা .. এক রুমে কয়জন থাকো?
– ২ জন থাকি।
– আরেকজনও রিক্সা চালায়?
– আরে না ভাই, বৌ রে দিয়ে রিক্সা চালামু নাকি?!
– (থতমত খেয়ে গেলাম ছেলেটা বিবাহিত) ওহ আচ্ছা। তো রাত বেরাতে রিক্সা চালাও বৌ কিছু বলে না?
– হাহাহা, ভাই কি যে বলেন! বৌ বাসায় থাকলে কি আর রাইতে বের হইতাম রিক্সা চালাইতে?বৌ বাসায় নাই। হের লাইগা রাইতে বাইর হইছি।
-(তার মানে শুধু আমার বৌ না দুনিয়ার সবার বৌ ই পেরাদায়ক। বৌ বাসায় নাই এই খুশি তে সেলিব্রেট করতে বের হয়েছে মনে হয়) আচ্ছা বৌ কোথায় গেছে?
– ওর বড় ভাইয়ের অসুখ। দেখতে গেছে। আমারে ছাড়া যাইতে চায় নাই। আমি সহ গেলে রিক্সা কে চালাইতো কন? জোড় কইরা একা পাঠাইছি।
– বৌ দের কে জোড় করেই মাঝে মাঝে পাঠানো উচিৎ ..নিজের একটু শান্তির ও তো দরকার আছে।
-ভাই আমার তো ওর সাথেই শান্তি।

গতকাল রাইতে ট্রেনে উঠায়া দিছি বৌ টারে। যাওয়ার সময় কানতেছিলো। আসলে আমার নিজেরও তারে ছাড়তে ইচ্ছা করতেছিলো না। কিন্তু ওর ভাইয়ের ওসুখ ওর যাওয়া তো দরকার .. আজকে বাসায় ফিরা ওরে দেখতাম না। মনডা খুব খারাপ হইত শরমের কথা তাও আপনেরে কই, ওরে ছাড়া আমার ঘুমও হইত না হের লাইগা রাইতের বেলা ই রিক্সা নিয়া বাইর হইছি। (কথাটা শুনে আমি খুব ধাক্কা খেয়ে গেলাম)

-আচ্ছা। কতদিন হয়েছে তোমাদের বিয়ের? আচ্ছা তোমাদের ঝগড়া হয় না?
– বিয়ে হইছে ২.৫ বছর ভাই। ঝগড়া অয়। অনেক অয়।
-কি নিয়ে ঝগড়া হয়?
-হাহাহাহা সে আমাকে টাকা বাঁচাইতে বলে। আর আমি ডেলি অর লাইগা লেসফিতা আলার কাছ থিকা চুরি টিপ কানের দুল কিন্না নেই। এইয়ার লইগ্গা ঝগড়া করে। আরো বহু কারণ আছে।
– জন্মদিন,বিবাহবার্ষিকী এগুলো ভুলে গেলে চিল্লা পাল্লা না?
– ভাই, আমাগো জন্মদিন কবে হেডাই জানি না। আমগো লাইগা ডেলিই এসব বার্ষিকী। এগুলা নিয়া আমরা চিল্লাই না।

– তো কি সব নিয়ে চিল্লাও?
– আমি চিল্লাই। মাঝে মাঝে এত রাত হয়া যায় বাসায় ফিরতে। ফিরা দেখি এহনো না খায়া আছে। কতবার কইছি খায়া নিতে তাও আমার লাইগা বোইয়া থাকে। অর খিদা নিয়া বোইয়া থাকার করার দরকার আছে কন?
-আচ্ছা তোমরা ঝগড়া লাগলে কি করো?
-গরীবের আবার ঝগড়া ভাই!!

প্রথমে বকা দেই। পড়ে নিজেই ভাত মাখাইয়া এক পেলেটে খাইয়া উঠি। বাস আর কিসের ঝগড়া। বৌ খুশি আমিও খুশি। (আমি যত শুনছিলাম খুব অবাক হচ্ছিলাম। এত শান্তি ওদের মধ্যে)

-বড় সড় ঝগড়া লাগে না? তখন কি করো?
– বড় হোক আর ছোট হোক। আমরা তো ভাই গরীব মানুষ। ঝগড়া লাগলেও ঠুসাঠুসি কইরা ঐ ছোট্ট চৌকিতেই ঘুমাইতে হয়। ঝগড়া কইরা শুইলে রাতে ঘুমের মধ্যেও কারো না কারো হাত আরেকজনের শরীরে লাইগা গেলেই ঝগড়া বাদ দিয়া দুইজন দুইজনরে ধইরা ঘুমায়া যাই। কপাল ভালো আমরা গরীব। আমাদের অনেক গুলা রুম নাই যে আমরা ঝগড়া কইরা আরেক রুমে গিয়া ঘুমামু। ঘুইরা ফিরা সে আমার কাছে আমি তার কাছে। ভালোবাসা ছোট ঘরের মধ্যেই দৌড়াদৌড়ি করে। হাহাহাহাহা (ছেলেটার হাসিতে অনেক সুখ। এত সুখী আমি কখনো হই নাই। অবশ্য আমি কখনো এভাবে চেষ্টা ও তো করি নাই)

-তোমরা ঘুরতে যাও না? সময় দেওয়া নিয়ে ঝগড়া লাগে না?
– আমি হারাদিন রিক্সা চালাই। ও আমারে কোন জোর করে না। একদিন আমি অর জন্য সময় রাইখ্খা দেই। ঐদিন রিক্সা চালাই না। ঐদিন আমরা মধুমিতা হলে যাই।সিনেমা দেখি। সিনেমা শেষে রাস্তায় হালিম খাই। রাস্তার লাল নীল বাত্তিতে বৌ এর খুশি হওয়া চোখ দুইটা অনেক দারুনলাগে (খেয়াল করলাম ছেলেটা হাত দিয়ে চোখ মুছতেছে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে চোখে পানি আমারও)

-আচ্ছা রাসেল আমাকে একটু ধানমন্ডি ১৫ নাম্বার নামিয়ে দিতে পারবা?
– হুম ভাই, চলেন। নামাইয়া আসি। ১ ঘন্টা হইছে না?
-না রে মাত্র ৪৫ মিনিট হয়েছে।
– হায়রে বৌ নাই দেইখা সময়ও কাটে না। (রাসেল দীর্ঘশ্বাস ফেলল)

আমি রিক্সায় বসে ভাবলাম ও আমার চেয়ে কম ইনকাম করে, কম খায়-পড়ে অথচ ওদের মাঝে কত সুখে আছে। কারণ সে সুখে থাকার উপায় জানে। আমি কখনো ওভাবে তনু কে নিয়ে ভাবিনি।কিছু হলেই কথা বন্ধ করে দেই। ও যে কষ্ট পায় সেটাও পাত্তা দেই না। শুধু নিজে অশান্তিতে আছি এটাই মুখ্যম ভাবি। ভাবতে ভাবতে বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম।

রাসেল কে ১২০ টাকা ঘন্টা ভাড়া করসিলাম। কিন্তু আজকে রাতে ও আমাকে না বুঝিয়েই অনেক শিক্ষা দিয়ে দিয়ে গেছে। তাই ওকে ২০০০ টাকা হাতে দিয়ে বললাম ” আজকে তুমিও রিক্সা না চালিয়ে তোমার বৌ এর কাছে যাও। এই নেও টাকা”। রাসেল রাখতে চাইলো না কিন্তু খুব জোড় করে ওর হাতে দিলাম। রাসেল চলে গেলো। আমি বাসায় উঠে গেলাম। এক্সট্রা চাবি সবসময়ই থাকে কারণ আমি তো প্রায়ই রাগ হয়ে বের হয়ে যাই। বাসার গেইট খুলে দেখলাম তনু ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে বোঝা যাচ্ছে ও ঘুমানোর আগে কান্না করছে। চোখ ফোলা।

আস্তে করে গুটি গুটি পায়ে বিছানার আরেক পাশে যেয়ে শুয়ে পড়লাম। আর তনুর গায়ে হাত টা রাখলাম। একটু ভয় লাগতেছিলো যদি রেগে যায়? কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম তনুও আমার দিক ঘুরে আমার বুকে এসে মাথা রাখলো। আজ এক অদ্ভুত শান্তি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো তনু কে ঘুম থেকে তুলে ভোরের আকাশ দেখতে ছাদে নিয়ে যাই। কিন্তু ওর ঘুম ভাঙ্গাতে চাই না। কাল ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। আসলেও মাঝে মাঝে অনেক অবহেলা করে ফেলি খুব বেশি তনুর কপালে চুমু খেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। ধন্যবাদ রাসেল তোমাকে। তোমাদের মত মানুষের কাছে আমাদের মত মানুষের অনেক কিছু শিখার আছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত