– তোমার হাতে কী হয়েছে আমেনা? স্বামীর কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে হাত পিছনে লুকিয়ে ফেলল আমেনা বেগম। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না কারণ আফজাল সাহেব স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে স্ত্রীর হাতে ব্যান্ডেজ করা। আফজাল সাহেব আবারও বলল –কী হলো হাত পিছনে নিয়ে গেলে কেন? বল কী হয়েছে তোমার হাতে? মাথা নিচু করে আমেনা বেগম বলল – আমার হাতে কিছু হয়নি তো।
– তাহলে পিছনে লুকিয়ে নিলে কেন? বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমেনা বেগম বলল – আপনি মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। আগে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। তারপর না হয় কথা হবে।আমেনা বেগম যা-ই বলুক না কেন, আফজাল সাহেব তার কথা মানতে পারছে না। সে আমেনা বেগম এর হাত না দেখে কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। তাই বলল – দেখ, আমি এক কথা বার বার বলতে পছন্দ করি না। তাই ভালো ভাবে বলছি হাত টা দেখাও। না হলে, আমি জোর করে হাত দেখবো বলে দিলাম।
আফজাল সাহেব যে হাত না দেখে শান্ত হবে না। তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে আমেনা বেগম। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই পিছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা আফজাল সাহেবের সামনে আনলো। আফজাল সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেল আমেনা বেগম এর হাতের অবস্থা দেখে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল – কী হয়েছে হাতে? আমেনা বেগম নিচের দিকে তাকিয়ে বলল – গরম পানি হাতের উপর পড়ে গিয়েছিল। তাই রিফাত ব্যান্ডেজ করে দিছে। আমেনা বেগম এখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলার সাহস তার নেই। তার দিকে তাকালে লুকিয়ে রাখা চোখের জল ধরা পড়ে যাবে। তাই মাথা নিচু করে নিজের বানানো দু’টো লাইন মিথ্যে কথা বলে দিল।
আমেনা বেগম এর কথায় আফজাল সাহেব সন্তুষ্ট নয়। তার মন বলছে, আমেনা বেগম কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে। তাই সে আবার বলল – আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি কথা বল। আফজাল সাহেবের কথার কোন সারা দিল না আমেনা বেগম। এতে আফজাল সাহেব রেগে গিয়ে আমেনা বেগম কে খুব জোরে একটা ধমক দিল। আফজাল সাহেব ধমক দেওয়ার সাথে সাথে আমেনা বেগম কেঁপে উঠলো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে এখন? স্বামীকে কীভাবে শান্ত করবে আমেনা বেগম? আফজাল সাহেব স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে বলল – সত্যি কথা বল কী হইছে তোমার হাতে? আমার মন বলছে তুমি সত্যি কথা বলছো না। হঠাৎ করে আমেনা বেগম এর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। এতক্ষণ যে ভয়টা পাচ্ছিল আমেনা বেগম, ঠিক সেটাই হলো।
আমেনা বেগম এর চোখের জল দেখে আফজাল সাহেব আরো অস্থির হয়ে বলল – দয়া করে বল, কে তোমার এই অবস্থা করেছে? আমেনা বেগম আর কিছু লুকাতে পারল না। আফজাল সাহেব কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। স্ত্রীর এরূপ অবস্থা দেখে আফজাল সাহেব খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বুক থেকে স্ত্রীর মাথাটা তুলে নিজের হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর বিছানায় বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল – এবার বলো কী হয়েছে তোমার? হাতে এভাবে আঘাত কীভাবে হলো? আমেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল – রিফাত আজ সন্ধ্যায় নেশা করে বাড়িতে এসেছিল। তারপর আমার কাছে ৩০০০ টাকা চায়। কিন্তু আপনি তো ভালো করেই জানেন আমার কাছে এখন টাকা নেই। সেলাই করে যা টাকা পাই। সব ও চুরি করে নিয়ে যায়। আর সেই টাকা দিয়ে নেশা করে, খারাপ কাজ করে। আজ যখন আমি টাকা দিতে পারছিলাম না। তখন ও সিগারেটের আগুন দিয়ে আমার হাত পুড়িয়ে দেয়।
এ’কথা বলে আমেনা বেগম আবার কেঁদে উঠল। এইসব কথা শোনার পর আফজাল সাহেব ও স্তব্ধ হয়ে গেল। কথা বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বলে বাবা -দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল আফজাল সাহেব। নিজের জন্মস্থান এর মায়া ত্যাগ করে ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে চলে এসেছিল ঢাকা নামক ব্যস্ত শহরে। যেখানে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। দশজনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আফজাল সাহেব বার বার ব্যর্থ হয়। কোনো রকমে দিন পাড় করতে থাকে। এর মধ্যে তাদের জীবনে চলে আসে “আল্লাহর” দেওয়া ছেলে সন্তান নামক এক উপহার। দু’জনে মিলে ছেলের নাম দেয় রিফাত। অনেক পরিশ্রম করে আস্তে আস্তে রিফাত কে বড় করতে থাকে আফজাল সাহেব আর আয়শা বেগম।
একমাত্র ছেলেকে ভালো স্কুল, কলেজে পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। প্রথমে ঠিক থাকলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে রিফাতের মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এলাকার কিছু বাজে ছেলেদের সাথে মিশে একটু একটু করে খারাপ পথে পা দেয়। প্রথমে সিগারেট খাওয়া তারপর মদ খাওয়া। এভাবে আস্তে আস্তে সব ধরনের নেশা সে গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু তাতেও সে থামেনি। মা’র কাছ থেকে প্রতিদিন টাকা নিয়ে খারাপ কাজ করে। টাকা না দিলে মায়ের সাথে বাজে ব্যবহার করে। একসময় সেটা শরীরে আঘাত করাতে রূপ ধারণ করে। একমাত্র ছেলে বলে আফজাল সাহেব এবং আমেনা বেগম কিছু বলতে পারে না। কিছুদিন আগে আফজাল সাহেবের চাকরি চলে যায়। সরকার থেকে সিল মেরে অফিস বন্ধ করে দিছে। আর এই বয়সে অন্য কোন অফিস ও তাকে চাকরি দেয় না।
স্ত্রী, সন্তান কেউ তা জানেনা। সারাদিন বাহিরে থাকে। যখন যে কাজ পায়, সেই কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। সারাদিন তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরে , কীভাবে স্ত্রী-সন্তান কে সুখে রাখা যায়। মনে হাজারো স্বপ্ন বুনে রেখেছে সে। পরিবারের সদস্য নিয়ে সমাজে আর দশটা মানুষের সাথে উঁচু গলায় কথা বলবে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে গর্ব করবে। কিন্তু সব কিছুতে তিনি ব্যর্থ হয়। তবুও পিছিয়ে না গিয়ে সুন্দর পরিবার তৈরি করার আশা নিয়ে আজও বেঁচে আছেন তিনি। বাবা হিসেবে সফল হওয়ায় চেষ্টা করে যাচ্ছে অনবরত। হয়তো এভাবেই আশা নিয়েই বেঁচে থাকবে যতদিন না শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।