ডিভোর্স

ডিভোর্স

সুজাতা আজ আর অফিস যায় নি। অঞ্জনের সাথে গোয়া গিয়েছিল গত বুধবার। গোয়ায় তিন দিন থাকার কথা ছিল। তিন দিনই থেকে কালকে শুক্রবার ফিরেও এসেছে। কিন্তু সুজাতা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল চার দিন। সে ভেবে ছিল গোয়া থেকে শুক্রবার ফিরে পরদিন শনিবার আর অফিস যাবে না আর তারপর দিন তো রবিবার, এমনিতেই ছুটি। একবারে টানা পাঁচদিন একটু বিশ্রাম হয়ে যাবে। দুদিন ঘরেই একটু রেস্ট নেবে। সুজাতা চাইলে অঞ্জনের সাথে শনিবার পর্যন্ত থাকতে পারতো, কারণ অমরেশ তার অফিস ট্যুর থেকে ফিরবে রবিবার দুপুরে। অঞ্জনও চেয়েছিল শনিবার পর্যন্ত গোয়াতেই থাকতে। কিন্তু সুজাতা রাজি হয় নি। তার যেন মনে হয়েছিল এতে হয়তো অমরেশের মায়ের মনে কোনো সন্দেহ হবে। যদিও সুজাতাও ঘরে বলেছিল সেও অফিসের কাজে দিল্লী যাচ্ছে।

বেলা এগারোটা বাজে। তার শরীরে যেন এখনও বেশ ব্যথা। সে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে বসে সেই গায়ের ব্যথাটা যেন বেশ উপভোগ করছিল। ঘরে থাকলে তার কোনো কাজ থাকে না। তার শ্বাশুড়ি এখনও বেশ কর্মক্ষম আছেন। তিনিই রান্না-বান্না, সবাইকে খেতে দেওয়া সব সামলান। এমনকি সুজাতার তিন বছরের ছেলে পুপুনকে দেখাশোনার দায়িত্বও তিনি নিয়ে নিয়েছেন।

সুজাতা ভাবছিল গত তিন দিনের কথা। অঞ্জনের সাথে বেশ কেটে গেছে। প্লেনে যাতায়াত থেকে, হোটেলে এক বিছানায় শোয়া, অঞ্জনের আদর উপভোগ করা, অঞ্জনের কিনে দেওয়া বিকিনি পরে জীবনে প্রথম সমুদ্রে স্নান করা, তাও আবার অনেকটা সময় অঞ্জনের কোলে চড়ে, বালির ওপর পাতা আরাম কেদারায় বিকিনি পরে রোদ পোহান, সবতেই যেন ছিল একটা নতুন স্বাদ। যেন সুজাতার এখন মনে হচ্ছে সে তিন দিন স্বপ্নের দেশে ছিল। কলিং বেলটা বেজে উঠতেই সুজাতার চিন্তায় ছেদ পড়লো। সে উঠে পড়ল। ব্যালকনি থেকে ড্রইং রুমে পৌঁছে দরজা খুলে দেখে পোস্ট ম্যান দাঁড়িয়ে আছে। সুজাতাকে চেনে পোস্ট ম্যান। তাই হেসে বলল,’ আপনার নামে রেজিস্ট্রি চিঠি। কালকে দিতে পারি নি, মাফ করবেন। তবে আজকে ছুটি হলেও, কালকের পেন্ডিং কাজটা সেরে নিচ্ছি।’ তারপর পোস্টম্যান নিজের পেনটা সুজাতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ নিন সই করুন।’ সুজাতা সই করে বাদামি খামটা নিয়ে ফিরে এলো ব্যালকনিতে। ইজি চেয়ারে বসে চিঠির খামটা খুলে একটু অবাক হলো। ইংরেজিতে টাইপ করা একটা চিঠি। ভালো করে দেখে বুঝলো যে সেটা সাধারণ কোনো চিঠি নয়। একটা কোর্টের নোটিস। সুজাতা পড়তে শুরু করলো।

পড়া শেষ হতে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো। অমরেশ তাকে ডিভোর্স দিতে চায়! সে সরাসরি উকিল মারফত কোর্টে ডিভোর্সের মামলা করেছে। সুজাতা মনে মনে ভাবল, সে যেটা চাইছিল, সেটাই অমরেশ তার আগেই করে ফেলল। কিন্তু সুজাতা ভেবে পেল না, অমরেশ কেন তাকে ডিভোর্স দিতে চায়। তবে অমরেশ কি তার আর অঞ্জনের ঘনিষ্ঠতার কথা সব জেনে গেছে? অবশ্য জানতেও পারে। সুজাতা যে ভাবে অফিস থেকে ফেরার পথে অঞ্জনের সাথে ঘুরে বেড়াতো, তাতে অমরেশের না জানার কোনো কারণ নেই। অনেকবারই সে আর অঞ্জন পরিচিত বন্ধু বান্ধবের সামনা-সামনি পড়ে গেছে। তাছাড়া বেশ কয়েকবার অঞ্জন তাকে ছাড়তে তার ফ্ল্যাটেও এসেছে। অঞ্জনের সাথে অমরেশ আলাপও করে গেছে একবার। একে একে সুজাতার সব পুরোনো কথা গুলো মনে পড়লো।

সুজাতা তখন মফস্বল শহরের কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সুজাতার রূপের আগুনের আঁচ নিতে তখন কলেজের অনেক ছেলেই সুজাতার আশেপাশে ঘোরে। কেউ কেউ মোটর সাইকেল নিয়ে সন্ধ্যের পর সুজাতাদের পাড়ায় চলে আসে। সুজাতাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চক্কর কাটে। সুজাতাদের বাড়ির গেটের সামনে মোটর সাইকেল স্লো করে দিয়ে ইচ্ছেকৃত ভাবে হর্ন বাজায় এই আশায়, হর্ন শুনে সুজাতা যদি ব্যালকনিতে একবার আসে। কেউ কেউ সুজাতার চোখের আড়ালে তার ক্লাস নোটের মধ্যে প্রেম পত্র গুঁজে দিয়ে যায়। কেউ কেউ তো আবার সুজাতার নামে প্রেম পত্র তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠায়। কয়েকজন তো আবার এমনও ছিল যারা সরাসরি সুজাতার কাছে এসে সুজাতাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসার জাহির করতো। কিন্তু সে সব নিয়ে সুজাতা মাথা ঘামাত না। এড়িয়ে চলতো।

কিন্তু সুজাতা নিজেই, মৌমাছি যেমন মধুর পেছনে দৌড়ায়, ঠিক তেমনি ভাবেই অমরেশের পেছনে দৌড়তে থাকলো, তাকে প্রথম দেখার পর থেকে। সুজাতা, অমরেশকে প্রথম দেখেছিল কলেজের সোস্যালে। অমরেশ তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজের সোস্যালে সে ছিল সঞ্চালক। সঞ্চালনার ফাঁকে ফাঁকেই সে তার উদাত্ত কণ্ঠে কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবার কখনও জয় গোস্বামীর কবিতা আবৃত্তি করে শোনাছিল। সেই সোস্যালে সুজাতাও অংশ নিয়েছিল। সুজাতা নিজেই ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে রুমা গুহঠাকুরতার ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের সেই বিখ্যাত গান ” ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম..” এর সাথে নেচেছিল। সমবেত কণ্ঠের গানটাও গেয়েছিল সুজাতার ক্লাসের বন্ধুরা। সুজাতাদের ওই নাচের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল সোশ্যালের উদ্বোধন। তারপর কিছু বক্তৃতা আর শেষে কলকাতা থেকে আসা শিল্পীদের গান। সেই নাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সুজাতার বন্ধুরা ড্রেস চেঞ্জ করে, মেকআপ তুলে ফিরে গিয়েছিল দর্শকদের জন্য বরাদ্দ আসনে। কিন্তু সুজাতা স্টেজের পাশে গ্রীন রুমেই থেকে গিয়েছিল। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল অমরেশকে।

স্টেজে তখন এক গায়ক গান গাইছেন। অমরেশ গ্রীন রুমে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেতাদের সাথে চা খেতে খেতে কথা বলছিল।হঠাৎই সুজাতাকে চমকে দিয়ে অমরেশ হাতে এক ভার চা নিয়ে সুজাতার কাছে এসে বলল,’ নাও চা খাও। তুমি অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছো দেখছি। তোমার এরপর কখন প্রোগ্রাম?’ এই কথা বলে অমরেশ চায়ের ভারটা সুজাতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, প্রোগ্রাম লিস্টের ওপর চোখ বোলাতে লাগলো। সুজাতা বলল,’না, না, আমার আর কোনো প্রোগ্রাম নেই।’ অমরেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে তাকালো। তার চোখের প্রশ্ন সুজাতা বুঝতে পেরেছিল। অমরেশ যেন জানতে চাইছিল, প্রোগ্রাম যখন হয়ে গেছে, তখন সুজাতার এখানে থাকার তো কথা নয়। সুজাতা সাহস করে বলেই ফেলল,’ আসলে আপনার সাথে পরিচয় করার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। আপনার অনুষ্ঠান সঞ্চালন আর আবৃত্তি শুনে ও দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি।’

অমরেশ একটু লজ্জা পেয়ে বলল,’তুমি বোধ হয় একটু বাড়িয়ে বলছো। এনি ওয়ে, তোমার নাম সুজাতা আর ফার্স্ট ইয়ারে পড়, সেটা এই লিস্ট থেকেই জেনেছি। আমার নাম অমরেশ। থার্ড ইয়ার ম্যাথস। তোমার কি সাবজেক্ট? সুজাতা বলল,’ হিস্ট্রি অনার্স।’ অমরেশ বলল,’ এখন কথা বলার সময় তো পাবো না। কাল কলেজে কথা হবে। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা। তোমাদের প্রোগ্রাম ভালো হয়েছে আর আপনি নয়, তুমি। কলেজে এসব আপনি, আপনি চলে না।’ এই কথা বলে অমরেশ স্টেজের ভেতরে গেল। যে শিল্পী গান গাইছিলেন, তার গানের পালা শেষ। এবার নতুন শিল্পীকে অমরেশ ডাকবে। সুজাতা মুগ্ধ হয়ে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে অমরেশের দিকে তাকিয়ে ছিল।

পরদিন থেকে কলেজে সুজাতা অমরেশের সাথে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। এমনকি সুজাতা নিজের ক্লাস কামাই করে অমরেশের অফ পিরিয়ডে অমরেশদের ক্লাসের সামনের লবিতে দাঁড়িয়ে অমরেশের জন্য অপেক্ষা করতো। ক্লাসের ভেতর থেকে সুজাতাকে লবিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অমরেশ বেরিয়ে আসতো। সুজাতার সাথে গল্পও করতো। এ ভাবেই চলছিল। সুজাতা অমরেশকে ভালোবাসলেও, অমরেশ, সুজাতাকে ভালোবাসে কি না, তা সুজাতা বুঝতে পারতো না। সুজাতাও সাহস করে তার মনের কথা অমরেশকে কখনও বলতে পারতো না। দেখতে দেখতে অমরেশের কলেজের শেষ দিন এগিয়ে এলো।

সেদিন ছিল অমরেশদের শেষ ক্লাস। সুজাতা সে দিন মনের থেকে তৈরি হয়েই কলেজে গিয়েছিল। ভেবেই রেখেছিল যে, সে তার মনের কথা আজ অমরেশকে বলবে। কিন্তু তার আর দরকার পড়লো না। তখন সবে সাড়ে এগারোটা। সুজাতা অমরেশদের ক্লাসের বাইরের লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল। হটাৎ অমরেশ ক্লাস থেকে বেরিয়ে লবিতে সুজাতার কাছে এসে বলল,’ তোমার সাথে কথা আছে। চারটে নাগাদ কলেজ গেটে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’ শুনে সুজাতার মাথা আর কাজ করছিল না। সে শুধু ঠিক আছে বলে নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সুজাতার মনে তখন ঝড় শুরু হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবছিল তাহলে কি অমরেশ তাকে আজ প্রপোজ করবে, না কলেজের শেষ দিন, তাই একটু বেশি গল্প করতে চায়? সুজাতা পরের ক্লাস গুলো এটেন্ড করলেও, তার মাথায় কিছু ঢুকলো না। সে শুধু বার বার হাত ঘড়ি দেখছিল। এমনকি সে টিফিন খেতেও ভুলে গিয়েছিল।

সুজাতার প্রথম ধারণাটাই সত্যি হলো। পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তোরাতে বসে কফি খেতে খেতে অমরেশ সুজাতাকে বলল,’ জানি না, তুমি কি ভাবে আমার কথাটাকে নেবে। তবে আমার ধারণা, আমি বোধ হয় ভুল করছি না। কারণ চোখের ভাষা কখনও মিথ্যা হয় না। আমি তোমার চোখের ভাষা অনেক দিন আগে থেকে, ইনফ্যাক্ট সেই কলেজ সোশ্যালের দিন থেকেই পড়ে আসছি। সেই চোখের ভাষা যদি সত্যি হয়, তাহলে আজ আমার কথা তোমার ভালোই লাগবে। জানি না, সেই দিন থেকে তুমি আমার চোখের ভাষা পড়েছ কি না?’ অমরেশ একটু থামলো। সুজাতার চোখের দিকে তাকালো।

সুজাতা এতক্ষন এক দৃষ্টে অমরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অমরেশ সুজাতার চোখের ওপর চোখ রাখতেই, সে চোখ নামিয়ে নিল। তার বুকের ভেতরটা তখন যেন কেমন করছিল। অমরেশ আবার বলতে শুরু করল,’ হুঁ, যে কথাটা আমি বলতে চাইছিলাম। যদি আমার কথা শুনে ভালো না লাগে, অবশ্য নাও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাকে তোমার মনের কথাও স্পষ্ট করে বলবে।’ অমরেশ আবার থামলো। তারপর, সুজাতার দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,’অনেক দিন ধরে বলতে চাইলেও, বলতে পারি নি। আজ বলছি। আমি তোমাকে ভালোবেশে ফেলেছি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে..’ অমরেশকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুজাতা তার হাত দুটো ধরা অবস্থায় নিজের বুকের কাছে টেনে এনে বলল,’আমিও।’

সেই শুরু। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয় নি। সুজাতা এম এ পাস করার পর, যখন অমরেশ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে, তখন দুজনের বাড়ির মত নিয়েই ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর অমরেশের উৎসাহেই সুজাতা ইউ পি এস সি র পরীক্ষায় বসে আর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে শুরু করেছিল। বছর তিন ঘুরতেই পুপুন এসে যায় ওদের দুজনের মধ্যে। অমরেশ আর সুজাতার সুন্দর জীবনে ছন্দপতন ঘটলো যখন সুজাতা অফিসে তার কলিগ অঞ্জনের সংস্পর্শে এলো।

সুজাতা ভেবে পায় না, অঞ্জনের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা ওকে চুম্বকের মতো টানে। এমনকি সেই টান, তার আর অমরেশের সুন্দর বোঝাপড়া, ভালোবাসার সংসারটার মধ্যেও ফাটল ধরিয়ে দিল। সুজাতার চিন্তায় ছেদ পড়ল। ভেতর থেকে শাশুড়ির গলা,’ সুজাতা! অনেক বেলা হয়ে গেছে। এবার স্নান করে নাও। আমি খাবার রেডি করছি।’

রবিবারের রাত দশটা। সুজাতা রান্না ঘরের ওয়াশ বেসিনে রাত্রের এঁটো বাসন গুলো মেজে বাথরুমে ঢুকেছে। সুজাতা রোজই রাত্রে ওই একটা কাজই করে। আর করেই স্নান করতে ঢোকে। শাশুড়ি পুপুনকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। পুপুনকে গল্প শোনায়। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত এগারোটা নাগাদ সুজাতা পুপুনকে ঘুমন্ত অবস্থায় নিজের ঘরে নিয়ে আসে। ততক্ষণে অমরেশ খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে বিছানায় বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে শুরু করে।

সুজাতা ভাবছিল অমরেশের কথা। দুপুরে অমরেশ ফেরার পর থেকে সুজাতার সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাবার্তা বলেছে। যেন কিছুই হয় নি। কিন্তু সুজাতা অমরেশের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে নি। গতকাল সারা রাত সে দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। তার যেন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল কাল রাতে। সে ভাবছিল অমরেশ কি ভাবে এত স্বাভাবিক আচরণ করছে? সুজাতা জানে সেই বিয়ের আগে প্রেম করার দিন গুলোতে অমরেশ তাকে যেমন ভালোবাসতো, আজও তার সেই ভালোবাসায় কোনো খামতি নেই। তাও সে কেন অঞ্জনের সাথে এরকম ভাবে জড়িয়ে পড়ল। সে তো চেষ্টা করেছিল প্রথম দিকে। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, সুজাতা যেন অঞ্জনের এক অমোঘ আকর্ষণে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে।

সুজাতা স্নান করতে করতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সে ভেবে পাচ্ছে না, সে কি করবে? অথচ গোয়ায় বসে সে তো নিজেই অমরেশকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন অমরেশ যখন নিজে থেকেই তাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে, তাতে সুজাতার কেন মনের ভেতরে কষ্ট হচ্ছে? সুজাতা ভেবে পায়না, তাহলে সে কি এখনও অমরেশকে আগের মতোই ভালোবাসে? আর অঞ্জনের সাথে তার এই ঘনিষ্ট মেলামেশা কি তাহলে শুধুমাত্র শারীরিক স্বাদ বদলের আরেক নাম। কে জানে! সুজাতা স্নান সেরে, এটাচড ড্রেসিং রুমে গিয়ে, গায়ে গাউন চড়িয়ে ফিরে এলো নিজের বেড রুমে। তখনও অমরেশ এক মনে খবরের কাগজ পড়ে চলেছে।

সুজাতা আলমারী থেকে ডিভোর্সের নোটিশটা বের করে অমরেশের কোলের ওপর রেখে ভারী গলায় বলল,’ এটার মানে কি?’ অমরেশ কাগজটা নামিয়ে তার কোলের ওপর পড়ে থাকা বাদামি খামটা একবার দেখলো, তারপর আবার খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরে বলল,’ মানে তো তুমি আমার চেয়ে বেশি জান। কেন তুমি কি এই নোটিস পেয়ে খুশি হওনি? আমি তো তোমার জন্যই এই কাজটা করেছি। আমি চাই তুমি খুশিতে থাকো। চিরকাল এটাই চেয়েছি, আজও চাইছি আর ভবিষ্যতেও চাইবো।’ সুজাতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অমরেশকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ আমায় ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছি। এই ভুল আর কোনোদিন করবো না।’

অমরেশ খবরের কাগজটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে ভাঁজ করে পাশে রেখে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল,’ কে বলেছে যে তুমি ভুল করেছ? কাউকে ভালোবাসাটা কখনও ভুল হতে পারে না। আমরাও তো এক সময় একে অপরকে ভালোবেসে ছিলাম। সেই ভালোবাসাটাও যেমন ভুল ছিল না, ঠিক তেমনি আজকাল তুমি আর অঞ্জন যে একে অপরকে ভালোবাসছো, তাতেও কোনও ভুল নেই। তবে আমাদের সমাজের চোখে সেটা হয়তো অন্যায় বা পাপ। কিন্তু আমি তা মনে করি না। কিন্তু তা হলেও, আমাকে সেই সমাজের মধ্যেই থাকতে হয়, সেই সমাজটাকে তো আমি অস্বীকার করতে পারি না। আবার তোমার ভালোবাসাকে আটকে রাখা বা বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। তাই ভাবলাম, সমাজের নিয়ম মেনেই চলি।

তোমাকে স্বাধীন করে দিই, যাতে তুমি অঞ্জনকে নিয়ে সুখী থাকতে পারো। আর আমারও তো একটা ব্যাপার আছে। গত ছমাস ধরে রাত্রে বিছানায় তোমার, আমার আদরের প্রতি অনীহা বা অবহেলা আমার আত্মসন্মানে আঘাত করছিল। আবার বলছি, তুমি কোনো ভুল, অন্যায় বা পাপ করোনি। তোমার জীবনে যেমন অঞ্জন এসেছে, ঠিক তেমন ভাবেই অনেক বিবাহিত মহিলার জীবনেও অঞ্জনের মতোই অনেক পুরুষ আসে। কিন্তু তারা সামাজিক সমালোচনার ভয় বা লজ্জায় তাদের ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে আসে। কিন্তু তোমাকেও যে তাই করতে হবে, এমন তো নয়। তুমি একজন চাকরি করা শিক্ষিত মহিলা। তুমি তোমার মনের কথা শুনেই চলবে। আর সেটাই একজন শিক্ষিত স্বাবলম্বী মহিলার পরিচয়।

আমি এই সিদ্ধান্তটা শুধু তোমার কথা ভেবে নিইনি। আমি বাবা, মা, পুপুনের কথাও ভেবে নিয়েছি। একবার ভাবো, আমি বাড়িতে নেই। তুমি পুপুনকে দুটো বুড়ো মানুষের ভরসায় রেখে তিন দিনের জন্য বাইরে চলে গেলে। যদি কোনো বিপদ-আপদ আসতো, তাহলে? আমি জানি অঞ্জনের জন্য তুমি এতটাই পাগল যে, তোমার শুধু আমার ওপর নয়, পুপুনের ওপর থেকেও টানটা যেন চলে গেছে। তাই এটা নিয়ে আর আলোচনার দরকার নেই। কোর্টের নির্দেশ মতো কোর্টে হাজির থেকে ডিভোর্সটাকে মেটিরিয়ালিজ করে দাও। তবে তোমার যখন মন চাইবে, অবশ্য যদি চায়, তুমি এসে পুপুনকে দেখে যাবে।’

সুজাতা আবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো আর তারপর বলল,’ আর তুমি? তুমি কি করবে?’ অমরেশ বলল,’আমি? আমার পুপুন, মা, বাবা আর তোমার স্মৃতি নিয়ে জীবনটা কাটাতে খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, তোমার জীবনে যেমন অঞ্জন এসেছে, আমার জীবনেও তো কেউ হটাৎ করে চলে আসতে পারে!’ সুজাতা বলল,’এখনও আমাকে অপমান করে চলেছ?’ অমরেশ সুজাতার চোখের ওপর চোখ রেখে বলল,’ তুমি আবার ভুল বুঝছো আমাকে। তোমার জীবনে যা ঘটেছে, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। খুব স্বাভাবিক। সমাজ যাই বলুক, আমার চোখে এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, যে কোনো বিবাহিত মহিলা বা পুরুষের জীবনে ঘটতে পারে। চলো, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আর হ্যাঁ, তোমার আর অঞ্জনের বিবাহিত জীবনের জন্য আমার শুভ কামনা রইলো।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত