কথা রাগে গজগজ করতে করতে ঢুকলো একটা রেস্টুরেন্টে। কাচ্চি বিরিয়ানি আর একটা কোক অর্ডার করলো।সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকিয়েছে।আসলে খুব বেশি রেগে গেলে কথার কান্না চলে আসে।রাগের কারণ আহামরি কিছুই নয় আবার খুব একটা তুচ্ছও নয়।কথা এবার মাস্টার্র’স করছে সমাজবিজ্ঞানে।ছোটো থেকেই একমাত্র মেয়ে হওয়ায় কথা যথেষ্ট ছাড় পেয়ে এসেছে।কাজ-কর্ম, রান্না-বান্না বলতে গেলে পারেই না।কিন্তু এখন বাসা ছেড়ে থাকতে হচ্ছে তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে পড়েছে বেজায় সমস্যায়।কথা আর তার ভাই থাকে একটা ভাড়া বাসাতে।বলা বাহুল্য কথার ছোট ভাই কথার চেয়েও অলস আর কুঁড়ে।কদিন যাবত তাদের রান্নার খালার অসুস্থ আর রাইস কুকারও হয়ে গেছে নষ্ট।অনেক কষ্টে দুদিন কথা আর ওর ভাই মিলে রান্না করে চোখ মুখ বুজে গিলেছে।কথা নিজের মতন কিছু কিছু রেসিপি ট্রাই করেছে কিন্তু সেগুলো নিজের গলা দিয়েই নামেনি ওর।এখন কথা আর পারছেনা কিছুতেই।জীবনে এই প্রথম তার রান্না না শিখার জন্য আফসোস হচ্ছে শুধু আফসোসই না তার সাথে ক্ষুধায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।
রান্নার হাত খারাপ হওয়ায় হোটেল থেকেই খাবার আনা হচ্ছে কিন্তু দুদিনে মুখের রুচি এতটাই বেস্বাদ হয়ে গেছে কথা সে খাবারও খেতে পারছে না।কথা তার আম্মুকে বলেছে খাবার রান্না করে নিয়ে আসতে যদি তার মেয়ের তাজা মুখ দেখতে চায়।কারণ ৩/৪ দিন যাবত না খেয়ে থাকতে থাকতে কথার মনে হচ্ছে এই বুঝি সে জ্ঞান হারাবে।আর তাই ভাইটাও তেমনি বোন কি খাচ্ছে,কেমন আছে তা জানার বোধহয় ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই।যথারীতি সকালে কথা তার আম্মুকে কল করেছে কিন্তু আম্মু বলেছে আজ আসতে পারবেন না তার আব্বুর জরুরি কাজ পড়ে গেছে।এদিকে কথা তার ভাইকে ডাকতে ডাকতে গলার জোর টুকুও শেষ করে ফেলেছে। নবাবজাদা পাউরুটি আর কফি গিলে বের হয়ে গেছে।
কথাও তাই রেডি হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে রেস্টুরেন্ট এ দিয়ে কাচ্চির কথা বললো।ওয়েটার যথারীতি কাচ্চি আর কোক দিয়ে গেলো টেবিলে।কথা কান্না আটকে খেতে শুরু করলো কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখনই।আর কোন টেবিল খালি না থাকায় ওয়েটার এসে কথাকে রিকুয়েস্ট করলো “ম্যাম যদি কিছু মনে না করেন তবে দাঁড়িয়ে থাকা স্যার কে কি এই টেবিলে বসতে বলতে পারি!আসলে উনি আমাদের রেগুলার কাস্টমার।”কথা দেখলো চারিদিকে তাকিয়ে আসলেও কোন টেবিল খালি নেই আর ছেলেটাও হয়তো ওর মতই খিদেয় মরছে তাই কথা অনুমতি দিয়ে দিলো অনুরোধের ঢেকি গিলে।ছেলেটা বসতে বসতে কথাকে খুব আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ দিলো।কথা ওদিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে জাস্ট ইটস ওকে বলে খাবারে মনযোগ দিলো।
কয়েক চামচ খাবারের পর কথার আম্মু কল দিলো। কথা রাগে ২ বার ফোন কেটে দিয়েছে।বলবে না কথা আর ঠিক করেছে বেশ কিছুদিন। বুঝুক একটু মেয়ের কষ্টটা।কিন্তু কথা নিজেও জানে সে আম্মুর সাথে কথা না বলে থাকতে পারবেনা কিছুতেই।আর কল না ধরা অবধি তিনি কল করেই যাবেন।অগত্যা বাধ্য হয়েই এক সাগর অভিমান নিয়ে রাগ নিয়ে চাপা কান্না নিয়ে কথা ফোন রিসিভ করলো কিন্তু করেই বললো “কি কেন!করেছো ফোন,আমাকে আর ফোন দিবানা,আমি তোমার কেউ না।থাকো তোমার জরুরি কাজ নিয়ে।আমি মরি,বাচি তাতে তোমার কি তাইনা!”
কথা শেষ অবধি কান্নাটা আর আটকাতে পারল না।সামনে বসে থাকা ছেলেটা শুধু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে হয়তো মনে মনে ভাবছে বিএফ এর সাথে ঝামেলা বা ঝাড়তেছে।কথা কল কেটে ফোন অফ করে দিলো।ক্ষুধা যে মানুষের মস্তিষ্ক এমন ভাবে অচল করে দেয় কথা ভালভাবেই বুঝতে পারলো।আচমকা কথার নজর ছেলেটার দিকে পড়লো ছেলেটা তখনো হাবার মত তাকিয়ে আছে কথার দিকে।এইবার কথাকে পায় কে একে তো ক্ষুধা দুইয়ে মায়ের উপর রাগ সব একসাথে সেই ছেলের উপর ঝাড়লো।কথা বললো “কি হয়েছে টা কি!এমনে তাকিয়ে আছেন ক্যান,চোখ তো বের হয়ে যাবে এক্ষুনি মনে হচ্ছে। মেয়ে দেখেন নি নাকি?তাদের কথা এর আগে কখনো শুনেননি!টেবিলে বসতে দিয়েছি তাই বলে কি মাথায় উঠে নাচবেন নাকি হুম”ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো “ইয়ে মানে সরি আপু ভুল হয়ে গেছে আরকি, প্লিজ ভাইয়াকে এভাবে বলবেন না” কথার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।কথা উত্তরে বললো_”ওই ছেলে ওই তোর আপু কে রে!আমি কি তোর সাত জনমের আপু লাগি আর ভাইয়া কে! ভাইয়া কে!”
কথার ধমকে আশেপাশের টেবিলের মানুষজনও খানিক তাকালো। কথা বুঝতে পেরে গলা নিচে করে বললো “আসলে বাঙালির সমস্যা হচ্ছে দু লাইন বেশি বুঝা আর আপনিও তাই বুচ্ছেন” ছেলেটা বললো আসলে ফোনে তো মনে হলো বিএফ কে ঝাড়লেন তাই বললাম। কথা টেবিলে হাত চাপড়ে বললো_ “হোয়াট ননসেন্স!সি ইজ মাই মাদার, নট বিএফ ইডিয়ট” ছেলেটা তখনি, “অহ স্যরি স্যরি করতে লাগলো।আরো বললো যে সে আসলে কথা শুনে বিএফ মনে করেছে” স্যরির সারি শুনতে শুনতে কথা পুনরায় বিরক্ত হয়ে ঝাড়ি দিলো।যাক এই ঝাড়িতে কাজ হয়েছে।বলদটা চুপ করেছে অন্তত। কথা মনে মনে খুশি হয়ে খাবারের প্লেটে মন দিলো।খেতে খেতে কথা বললো অন্য টেবিল খালি হলে দয়া করে এখান থেকে উঠে গিয়ে আমায় উদ্ধার করুন।এমনিতেই মেজাজ আমার চরম খারাপ আর আপনি সেটা আরো খারাপ করে দিচ্ছেন।ছেলেটা আচ্ছা বলে চুপ করে রইলো।ছেলেটা ওয়েটার কে কোন খাবারের কথা বলেনি তাই কথা জিজ্ঞেস করেই ফেললো অর্ডার করেছেন না যে! ছেলেটা বললো ওরা জানে নিয়ে আসবে এক্ষুণি। আমি ধরতে গেলে ওদের রেগুলার কাস্টমার।কথা ও বলে খাওয়ায় মন দিলো আবার।
আচমকা ছেলেটা বলে উঠলো কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি!কথা ইশারায় খেতে খেতে বলতে বললো। ছেলেটা বললো “মিস আপনার চোখদুটো কিন্তু দারুণ মায়াবী। কাজল কালো চোখে কান্নার জলে আরো মুগ্ধ লাগছে তাই তখন ওভাবে তাকিয়ে ছিলাম”
ছেলেটার বলার ভঙ্গিটা এমন ছিলো যে কথা রাগবে না খুশি হবে তাই নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলো।কথা শুধু বললো_ “এর মধ্যে আমার চোখও গবেষণা করে ফেলেছেন” ছেলেটা আমতা আমতা করতে লাগলো। ছেলেটার অবস্থা দেখে কথার হাসি পেলো খানিকটা হেসেই দিলো।কথাকে হাসতে দেখে ছেলেটাও হাসলো।এখন ছেলেটার উপর একটু মায়া হচ্ছে কথার।এতক্ষনে খেয়াল করলো ভাল করে।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে অফিসিয়াল ড্রেস,দেখতেও মন্দ না।বেশ কিছু কথাও হলো তাদের মাঝে।ছেলেটা কথাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলো। কথা বললো আমার নাম হচ্ছে কথা।ছেলেটা বললো বাহ মিস কথার কথা তো শুনতে দারুণ লাগছে।কথা চোখ রাঙানো দেখে ছেলেটা আবার চুপ হয়ে গেলো।কথা বললো, “শুনুন মিঃএসব ফালতু ফর্মূলা অন্য জায়গায় ট্রাই করবেন কেমন। আপনি আমার কয়টা কথা শুনছেন যে বলতেছেন দারুণ লাগছে”
“ছেলেটা এবার হেসে বললো যেটুকু শুনেছি সেটুকু থেকেই বললাম। আর আমি কোন ট্রাই মারছিনা সো বি কুল ইয়াং লেডি” কথা হুহ বলে কোকের গ্লাসে চুমুক দিলো।খাওয়া প্রায় শেষ কথার।এর মধ্যে ছেলেটার খাবারও চলে এসেছে।ছেলেটা এবার বললো তার নাম কাব্য।কথার চোখ কাব্যের চশমা পড়া চোখের দিকে একবার তাকালো আর বললো নাইস নেইম।তারপর কাব্য জানতে পারলো কথার বিড়ম্বনার কথা খাবার নিয়ে।কাব্য নিজেও একি পরিস্থিতির স্বীকার। সে মেসের বুয়ার রান্না খেতে পারেনা নিজের ও সময় হয়না রান্নার জন্য। কথায় কথায় কথা বললো সে এবার কুকিং ক্লাস জয়েন করবে। ভেবেছিলো জামাই বেটা হয়তো রেঁধে খাওয়াবে ওকে কিন্ত এই কয়দিনে খুব শিক্ষা পেয়েছে সে আর ইমারজেন্সি কুকিং শিখে রাখলে ক্ষতি নেই তার মতে।কাব্য ও যথেষ্ট উৎসাহ দিলো।কথা ওয়েটার কে আরেক প্যাকেট কাচ্চি প্যাক করে দিতে বললো তার ভাইয়ের জন্য। শত হোক ভাইতো।কথা আবার অতটা নিষ্ঠুর হতে পারেনা। বিল দিয়ে কথা যখনি উঠতে যাবে কাব্য ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো, “মিস কথা ইয়ে মানে কিছু যদি মনে না করেন,তবে কি আপনার ফোন নাম্বার বা ফেবু আইডি পেতে পারি!”
কথা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই কাব্য বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে লাগবে না এমনি চাইলাম যদি আমিও আপনার সাথে কুকিং ক্লাসে যেতে চাই তাই আরকি” বেচারার সাফাই দেয়া দেখে কথা পুনরায় হেসে দিলো। এই ছেলেটা আজ তাকে দু’বার হাসিয়েছে।এমিনিতেই এই কদিন মেজাজের যা অবস্থা। কথা ফেবু আইডি টা বলে মুচকি হাসি চলে গেলো।আর বলেও গেলো অল টাইম যেন ছ্যাঁচড়াদের মতন টেক্সট না করে।কাব্য মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝেছে জানিয়ে দিলো। তখনি ফোন অন করায় কথার আম্মু আবার কল দিলো এবার কথা খুব অভিমানী গলায় সুন্দর করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো।কথার যাওয়া শেষ অবধি চেয়ে থাকলো কাব্য।তারপর কথার আইডিতে গিয়ে প্রো পিক দেখে মাঝারি একটা ক্রাশ খেলো কিন্তু যেই কভার ফটোতে ক্লিক করেছে ওমনি লিখা কিরে কাজ নাই,এইখানে কি আমার প্রোফাইলে হুম,যাবি না দিমু থাবড়া!
কভার ফটো দেখে গলা শুকিয়ে গেছে কাব্যের। একটু পানি খেয়ে মুচকি হাসলো। কাব্যের চোখে এখনো কথার সেই মায়াবী চোখ আর হাসিটা ভাসছে। কাব্য ভাবলো একটা টেক্সট করবে কিন্তু পরক্ষণেই কথার ওয়ার্নিং মনে পড়ে গেলো।সে চশমাটা ঠিক করে নিলো আপাদত সে আর ঝাড়ি খেতে চাচ্ছেনা। কথার কথায় সে হারাতে চার কিন্তু কটু কথায় না।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা সেন্ড করে সে বেরিয়ে পড়লো কথার কথা কানে বাজিয়ে।ঠিক তখনি নামলো শহর জুড়ে ঝুম বৃষ্টি।কথার রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে আর কাব্য হাঁটছে কদম গাছটার নিচ দিয়ে।শুধু বিধাতা জানে ওদের আবার কবে কখন কোথায় কথা হবে! আদৌ কথা হবে কিনা..!!